রাত-দিন ডুকরে কাঁদছেন রাজধানীর রামপুরার বিখ্যাত আল কাদির রেস্টুরেন্টের মালিক ফিরোজ আলম সুমন। বৈষম্যবিরোধি ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই ছাত্রদের খাবার, পানি ও অন্যান্য সহায়তা করে আসছিলেন তিনি। একাধিকবার পুলিশের ধাওয়া খেয়ে ছাত্ররা আশ্রয় নিয়েছিলেন তার রেস্টুরেন্টে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর রাস্তায় দায়িত্ব পালনকারী ছাত্রদের তিনবেলা নিজের রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়ান সুমন। কিন্তু অপতথ্য ছড়িয়ে ছাত্র-জনতাকে উত্তপ্ত করে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছেন তারই আপন ছোট ভাই ইফতিখারুল আমিন।
ফিরোজ আলম ছিলেন বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির প্রথম যুগ্ম মহাসচিব। বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত তিনি। সংগত কারণেই সাবেক সরকারের বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে ওঠাবসা ছিল তার। ঘটনার সূত্রপাত গত ১৪ আগস্ট। আসিফ নেওয়াজ নামের এক ব্যক্তি ফেসবুকে ফিরোজ আলমের কিছু পুরোনো ছবি দিয়ে একটি পোস্ট করেন। সেই পোস্টে লেখা ছিল, ‘ফিরোজ আলম সাবেক সরকারের দালাল, আওয়ামী লীগের কর্মী এবং ছাত্র হত্যার সঙ্গে জড়িত।’
ফিরোজ আলমের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবারসহ নানা ধরনের সহায়তা পাওয়া ছাত্ররা ফেসবুকে এমন পোস্ট দেখে অবাক হন। এরপর ছাত্ররা খুঁজে বের করেন সেই পোস্টদাতা আসিফ নেওয়াজকে। তারা আসিফ নেওয়াজের কাছে জানতে চান কেন তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন ছবি এবং লেখা পোস্ট করেছেন। তখন আসিফ নেওয়াজ জানান, এসব ছবি ও লেখা তাকে পাঠিয়েছেন ইফতিখারুল আমিন নামের এক ব্যক্তি। তার কথাতেই এটা ফেসবুকে দিয়েছেন তিনি।
আসিফ নেওয়াজের দাবি, তার ফেসবুকের পোস্ট দেখে ছাত্র-জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে আল কাদির রেস্টুরেন্টের মালিক ফিরোজকে গণপিটুনি দেবে। এতে তার মৃত্যুও হতে পারে। এমন পরিকল্পনাই করেছিলেন ইফতিখারুল আমিন। কিন্তু ইফতিখারুল আমিন যে ফিরোজ আলমের ছোট ভাই এটা জানতেন না তিনি।
নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফেসবুক পোস্টটি ডিলিট করে দেন আসিফ নেওয়াজ। এতে ক্ষিপ্ত হন ইফতিখারুল আমিন। বারবার তাকে চাপ দিতে থাকেন আবারও ফেসবুকে পোস্ট দিতে। কথা মতো কাজ না করায় একসময় আসিফ নেওয়াজকে হুমকি দেওয়া শুরু করেন ইফতিখার আমিন ও তার লোকজন। এ ঘটনার পর প্রথমে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং পরে আদালতে মামলা করেন আসিফ নেওয়াজ।
যেভাবে ষড়যন্ত্র ফাঁস : আসিফ যখন ফোনে কথা বলছিলেন, তখন ফিরোজ আলমও বসে ছিলেন তার পাশে। নিজের ভাইয়েরা কীভাবে তার ব্যবসায়িক ক্ষতির পাশাপাশি তাকে হত্যার চেষ্টা করছেন—সেটা নিজের কানেই শুনেছেন তিনি। তাদের কথোপকথনের অডিও ও ভিডিও রয়েছে কালবেলার হাতে। সেই ভিডিওতে শোনা যাচ্ছে, ইফতিখার আমিন ফোনে যা বলছেন—
ইফতিখারুল আমিন: ফেসবুক থেকে পোস্ট ডিলিট করলেন কেন?
আসিফ নেওয়াজ: ভাই, পোস্ট তো আমি ডিলিট করি নাই। অটো রিমুভ হয়ে গেছে।
ইফতিখারুল আমিন: অন্যভাবে পোস্ট করেন। লেখেন সুবিধাভোগী আওয়ামী লীগের নেতা। ছবিগুলো ব্যবহার করেন।
এটা ফেসবুকে পোস্ট করলে আসিফকে টাকা দেওয়ার অফারও দেন ইফতিখার আমিন।
যা বলছেন আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্ররা: ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া ঢাকা ইম্পেরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী সৈয়দ রাইয়ান আহমেদ বলেন, আল কাদেরিয়া রেস্টুরেন্টের মালিক ফিরোজ আলম শুরু থেকেই আমাদের অনেক সহায়তা করে আসছিলেন। তিনি হয়তো ব্যবসায়িক কারণে সাবেক সরকারের বহু মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। কিন্তু তিনি সরাসরি ছাত্রদের আন্দোলনে সমর্থন করেছেন এবং সহায়তা করেছেন।
রোবায়েদ হোসেন অভি নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা ছাত্ররা তার রেস্টুরেন্টে থেকে সহায়তা পেয়েছি অনেক রকমের। এমন সময় গেছে উনি দুবেলা আমাদের খাইয়েছেন। তিনি বলেন, ইফতিখার আমিন আসলে তার ভাই ফিরোজ আলমকে হত্যার মতো অবস্থায় ফেলতে চাইছিলেন ছাত্রদের ব্যবহার করে।
ইফতিখারুল আমিনের বক্তব্য: আপন বড় ভাইকে হত্যার পরিকল্পনার অভিযোগের বিষয়ে ইফতিখারুল আমিন কালবেলাকে বলেন, ফিরোজ আলম আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। তিনি ছাত্র হত্যায় যুক্ত। তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। ফিরোজ আলম ছাত্র হত্যায় জড়িত এমন কোনো ছবি, ভিডিও বা প্রমাণ আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কাছে কোনো ছবি বা প্রমাণ নেই। তবে শুনেছি অনেকের কাছে। রামপুরা এলাকায় খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন।