চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে বর্তমানে ৫ হাজারেরও বেশি মামলা রয়েছে। এ সংখ্যা বেশি হওয়ায় এর ফায়দা নেন প্রভাবশালী ঋণখেলাপিরা। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি থেকে শুরু করে সাজা পরোয়ানা তামিল—সবকিছুই পড়ে থাকে বছরের পর বছর। তবে এবার মামলাজটে সুযোগ নেওয়ার দিন শেষ হতে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে চট্টগ্রামে গঠন হচ্ছে আরও দুটি অর্থঋণ আদালত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খবর বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধ না করা খেলাপিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
জানা গেছে, ব্যাংক ও অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ আদায়ে চট্টগ্রামে আরও দুটি অর্থঋণ আদালত গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। প্রতিটি আদালতের জন্য একজন করে যুগ্ম জেলা জজ ও পাঁচজন সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট ৩০টি পদ অনুমোদন করা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে এসব আদালত গঠনের বিষয়ে এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ খবর পেয়ে আদালতপাড়ায় দেখা দিয়েছে স্বস্তি।
জানা গেছে, শীর্ষ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে অপেক্ষমাণ থাকা ওয়ারেন্ট তামিল নিশ্চিত করতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেন অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান। তবুও শীর্ষ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ইস্যুকৃত গ্রেপ্তারি পরোয়ানাগুলো যথাসময়ে কার্যকর হচ্ছে না। ফলে অর্থঋণ আদালতে দায়েরকৃত মামলাগুলো আইনের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। এতে আদালতের গুরুত্বপূর্ণ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।
এরই মধ্যে নতুন আরও দুটি অর্থঋণ আদালতের খবরে প্রভাবশালী ঋণখেলাপিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী। তিনি কালবেলাকে বলেন, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে তিনটি অর্থঋণ আদালত গঠনের পরিকল্পনা সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এতে বিচারপ্রার্থী জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ হতে চলেছে। তিনি আরও বলেন, ‘পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতগুলোতে আইন সংশোধন কিংবা প্রজ্ঞাপন জারি করে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কৌঁসুলি নিয়োগ দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়াটাও খুবই জরুরি।’
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন চৌধুরী অবকাঠামোর উন্নয়ন ও এজলাস সংকট সমাধানে জোর দিয়ে বলেন, ‘নতুন আদালত ভবনের ওপরে পঞ্চম তলায় একটি ফ্লোর করা যাবে এবং যে সিভিল কোর্টটি নিচে রয়েছে সেখানে এক-দুটি ফ্লোর করা যাবে। এতে এজলাস সংকট কেটে যাবে। কোর্ট সংখ্যাও বাড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামে অর্থঋণ, সিএমএম আদালতসহ আরও কিছু আদালতের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ১৬ মে জেলা বারের অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতির কাছে বিষয়গুলো উত্থাপন করেছিলাম। চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে প্রচুর মামলার জট। এ ক্ষেত্রে তিনটি আদালত হলে বিচার যথাযথভাবে চলবে। কোর্টের ওপর চাপ কমবে।’
চট্টগ্রামের সিনিয়র আইনজীবী জিয়া হাবীব আহসান বলেন, চট্টগ্রামের এই একটি অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা এত বেশি যে, যথাসময়ে মামলা নিষ্পত্তি খুবই দুরূহ। তাই নতুন দুটি আদালত প্রতিষ্ঠা ফলপ্রসূ হবে। তিনি আরও বলেন, অর্থঋণ আদালতে মামলার চেয়ে জারি মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসময় ব্যয় হয়। এ জন্য অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩-এর জারির বিধান ধারা ২৮-৩২-এর অধিকতর সংশোধন প্রয়োজন।
চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের পেশকার রেজাউল করিম বলেন, অর্থঋণ আদালতে পাঁচ হাজারের অধিক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরেই জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে মামলা হয়েছে ৩৯১টি। তার মধ্যে অর্থঋণ ২০৮টি, জারি ১৬৭টি ও মিস মামলা ১৬টি। চার মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪১৬টি মামলা। ১০ বছরের পুরোনো মামলা ছিল ১৭টি। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে অর্থঋণ মামলা ২৯২, জারি মামলা ১১৫ ও মিস মামলা ৯টি।
২০২০ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান যোগদান করার পর আদালতের মামলাজট কমিয়ে আনতে বেশ কিছু সাহসী উদ্যোগ নেন বলে জানান রেজাউল করিম।
অর্থঋণ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী আলী আজগর চৌধুরী বলেন, ‘মামলা জট কমিয়ে আনার বিষয়ে বিচারকের ভূমিকাই মুখ্য। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুত সমন জারি করেছেন। আসামিরা যতই প্রভাবশালী হোক, ছাড় দেননি। বড় ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। অনেকে এখন কারাগারে রয়েছেন। অনেক আসামির বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এ কারণে ঋণখেলাপিরা ভয়ে মামলা নিষ্পত্তিতে এগিয়ে আসছেন। এখন আরও দুটি আদালত প্রতিষ্ঠা হওয়া মানেই প্রভাবশালীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়বে।’
সিনিয়র আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাসময়ে ওয়ারেন্ট তামিল না হওয়ায় জনগণের হাজার কোটি টাকা আদায় হচ্ছে না। আদালতের আদেশ তামিল না হওয়া আদালত অবমাননার শামিল। এখন ওয়ারেন্ট তামিলের জন্য পুলিশের একটি বিশেষ শাখা গঠনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগপৎ উদ্যোগ নেওয়া দরকার।