শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়লেও ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে আছেন তারা। ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট তীব্র হওয়ায় নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ আরও সংকুচিত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে এসএমই খাতে ঋণের অন্তত ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে মোট ঋণের ৬ শতাংশের কিছু বেশি পেয়েছেন তারা। এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নারীদের ঋণ দেওয়ার পরিমাণ বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বাড়াতে হবে। যদিও নানা কারণে লক্ষ্য পূরণে খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্লেষকদের মতে, নারী উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণ না পাওয়ার কয়েকটি কারণ হলো—ট্রেড লাইসেন্স সমস্যা, ব্যবসার প্রমাণাদি না থাকা, ঋণ তারা কীভাবে ব্যবহার করবেন, তা না জানা, দুজন পুরুষ গ্যারান্টার এবং দোকান না থাকলে বাড়িতে মালপত্র রাখার বিষয়টিও রয়েছে। এ ছাড়া স্টোর বাবদ বাড়িওয়ালাকে ভাড়া দেওয়া হলেও এর কোনো লিখিত প্রমাণ এবং মাসিক ট্রানজেকশন কম হওয়াটাও প্রভাব ফেলছে। এসব কারণে নারী উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন না। নারায়ণগঞ্জের মাসদাইরে হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান রূপাইয়ের উদ্যোক্তা শারমিন আক্তার বলেন, ব্যবসা বাড়াতে ২ লাখ টাকা ঋণ দরকার ছিল। কাগজপত্রের জটিলতার কারণে ঋণ নেওয়া হয়নি।
রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণ খানের কালেমস ক্রাফটসের মুক্তা আক্তার বলেন, ৫ লাখ টাকা ঋণের আবেদন করেছিলাম। সব কাগজপত্র দেওয়ার পর ব্যাংক মাত্র ২ লাখ টাকা ঋণ দিতে চেয়েছিল। এই টাকায় ব্যবসা সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। তা ছাড়া ৯ শতাংশ সুদ অনেক বেশি হয়ে যায় একজন নারী উদ্যোক্তার জন্য। এসব কারণে ঋণ নেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের কাছে ঋণের জন্য যেসব তথ্য চায় স্বল্প শিক্ষিত নারীর পক্ষে অনেক সময় তা দেওয়া সম্ভব হয় না। এ কারণে অনেকেই ঋণ নিতে ইচ্ছুক হলেও তা থেকে সরে আসেন। ব্যাংকের ইতিবাচক আচরণের অভাবে অনেকে ঋণ নিতে আগ্রহ হারান। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানে অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের আগ্রহও কম থাকে। ফলে তারা উচ্চ সুদে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেন। এতে ব্যবসায় তাদের লাভের পরিমাণ কমে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা উভয়কেই সমঝোতা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু টার্গেট দিলেও তৃণমূল পর্যায়ের ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানে আগ্রহী নয়। কারণ তারা নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়ে ঝামেলায় যেতে চায় না। নারী উদ্যোক্তারা কেন ঋণ পাচ্ছেন না, তা গুরুত্বসহকারে মনিটরিং করা দরকার।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের নারী শাখার একজন ম্যানেজার বলেন, ঋণ গ্রহণে নারী উদ্যোক্তাদের আমরা নিরুৎসাহিত করি না। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে কিছু বিষয়ও নির্ধারণ করা আছে। সবকিছু মিলে গেলে আমরা ঋণ দিই।
উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, ঢাকার ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানে সহায়ক হলেও ঢাকার বাইরের ব্যাংকগুলোতে বিপরীত চিত্র দেখা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ থাকলেও নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানে নারী ডেস্ক নেই। উদ্যোক্তারা ব্যাংকে গিয়ে সঠিক তথ্য না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছোট-বড় সব ঋণের ক্ষেত্রেই ব্যাংকাররা ঝুঁকি নিতে চান না। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে শুধু নির্দেশনা দিলেই হবে না। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে নানাভাবে উৎসাহিত করতে হবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমই) মহাব্যবস্থাপক ফারজানা হক বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি ও আস্থার যে সমস্যা রয়েছে, তা দূর করতে হবে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তারাই বরং বেশি নির্ভরযোগ্য হন। কারণ তারা কাস্টমাইজড পণ্য ভালো তৈরি করতে পারেন। আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা রয়েছে। তাদের ঋণ দিলে ব্যাংকের বরং সুবিধা হবে। কারণ তারা ব্যবসা থেকে দ্রুত সরে যান না। এই ব্যাপারগুলো ব্যাংককেও খেয়াল করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক কালবেলাকে বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে বিশেষ কয়েকটি স্কিম চলমান রয়েছে। বেশিরভাগ নারী উদ্যোক্তা কোম্পানি সংক্রান্ত তথ্য এবং আর্থিক বিবরণীতে কিছুটা দুর্বল থাকেন। সেই জায়গাগুলো ঠিক করার চেষ্টা হচ্ছে। সেগুলো ঠিক হলে আরও সুবিধাজনক অবস্থানে যাবেন নারী উদ্যোক্তারা।
তারল্য সংকট সম্পর্কে তিনি বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেওয়া হয়। কাজেই এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।