বগুড়া কারাগারের কনডেমড সেল থেকে চার ফাঁসির আসামি পালানোর ঘটনার পর থেকেই কারাগারের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। জেলখানায় উচ্চবিত্ত হাজতি বা কয়েদিদের অসুস্থতার অজুহাতে জেল হাসপাতালে রাখা, বাইরের খাবার ও মাদক সরবরাহসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
১৮৮৩ সালে বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকায় চুন-সুরকির গাঁথুনি দিয়ে জেলা কারাগার নির্মাণ করা হয়। জেলখানার আশপাশে অনেক সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করা হলেও কেউ বাধা দেয়নি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ১৯ অক্টোবর বগুড়া কারাগার চত্বরে একরামুল হক নামে এক রক্ষীর মরদেহ পাওয়া যায়। তিনি মাদক সংশ্লিষ্টতায় মারা যান। ২০১৭ সালে বগুড়া কারাগারে থাকা ছাত্রী ধর্ষণ, মাসহ ছাত্রীকে ন্যাড়া করে দেওয়া মামলার প্রধান আসামি শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারকে দর্শনার্থী কক্ষে স্যালাইনের পাইপ দিয়ে ফেনসিডিল সেবন করানোর অভিযোগ ওঠে। তার লোকজন দক্ষিণ পাশ দিয়ে ফেনসিডিলের বোতল জেলের ভেতরে নিক্ষেপ করে। কারারক্ষীরা ওইসব বোতল কুড়িয়ে তুফানের কাছে পৌঁছে দেন। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে তুফানকে বগুড়া থেকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া ধর্ষণের শিকার ওই তরুণীর সঙ্গে কারাগারে তুফান সরকারের সাক্ষাৎ করানোর সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে সাবেক জেল সুপারের বিরুদ্ধে। অনেক প্রভাবশালী হাজতির কাছে মদের বোতল, ভাতের মধ্যে নেশাদ্রব্য পাঠানোর অভিযোগও রয়েছে।
কারাগারে মাদক যায় দুভাবে। একটি হচ্ছে কারাগারে কর্মরতদের মাধ্যমে, অন্যটি কারাগারের পশ্চিম পাশের দেয়ালের ওপারে পৌরসভার সামনে থেকে মাদক ছুড়ে ভেতরে পাঠানো হয়। এখান থেকে কাগজ বা পলিথিনের মধ্যে গাঁজা, ইয়াবার সঙ্গে ঢিল তুলে হাজতির নাম লেখা চিরকুটসহ তা ছুড়ে মারা হয় কারাগারের মধ্যে। কারাগারের অভ্যন্তরে দায়িত্ব পালনকারী কারারক্ষীরা তা পেয়ে হাজতিদের কাছে টাকার বিনিময়ে পাঠিয়ে দেন।
কারাগারে খাবারের মান খুবই নিম্নমানের বলে জানিয়েছেন একাধিক হাজতি। জেলার ফরিদুর রহমান রুবেল জানান, বন্দিদের সকালে রুটি ও ডাল, দুপুরে সবজি-ডাল-ভাত এবং রাতে সবজি-ডাল-ভাত-মাছ বা মাংস খেতে দেওয়া হয়। বন্দিরা জেলারের এ দাবি সঠিক নয় দাবি করে বলেন, খাবার খুবই নিম্নমানের। সকালে রুটির সঙ্গে লাউয়ের পাতলা ঝোল দেওয়া হয়। রুটিও খুব পাতলা। দুপুরে লাউয়ের পাতলা ঝোল, সবজি ও ভাত আর রাতে ছোট আকৃতির এক পিস সিলভার কার্প বা তেলাপিয়া মাছ।
একাধিক বন্দি জানান, তালিকায় রুই, কাতলাসহ বিভিন্ন মাছ খাওয়ানোর কথা থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই দেওয়া হয় পুকুরে চাষ করা পাঙাশ, তেলাপিয়া ও বিভিন্ন কার্পজাতীয় মাছ। আর মাঝেমধ্যে যে মাংস খাওয়ানো হয়, তা-ও পরিমাণে খুব কম।
বগুড়া কারাগারের জেল সুপার আনোয়ার হোসেন বলেছেন, বগুড়া কারাগারে কোনো অনিয়ম নেই। কোনো দুর্নীতি প্রশ্রয় দেওয়া হয় না।
এদিকে চার ফাঁসির কয়েদি পলায়নের ঘটনায় মামলা এবং তদন্ত চলমান রয়েছে। দুটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। এর মধ্যে কারা অধিদপ্তর গঠিত তদন্ত কমিটি গত বুধবার থেকেই কাজ শুরু করেছে। জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটিও বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে কাজ শুরু করেছে।
তদন্তের ব্যাপারে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল সুজাউর রহমান বলেন, আমরা চার কয়েদির সঙ্গে কথা বলেছি। কীভাবে ঘটনা ঘটল, সেটি তদন্ত করা হচ্ছে। অবকাঠামোগত বা প্রশাসনিক কোনো দুর্বলতা ছিল কি না, কর্তব্যে অবহেলা ছিল কি না, সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত শেষে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
অন্যদিকে কারাগারে কনডেমড সেলে থাকা ২৬ কয়েদিকে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কক্ষে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি ১০ জন এবং বাকি ১৬ জন জঙ্গি ও দুর্ধর্ষ কয়েদি। নিরাপত্তার স্বার্থেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।