বঙ্গীয় শিল্পকলার মূল সমস্যা হলো সে অপপ্রচারের নির্মম শিকার। ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজের ইউরোপের প্রতি যে অন্ধবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তাকে ভেদ করে বাংলার শিল্পকলার মাথা তুলে দাঁড়ানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। ইউরোপ সর্বশেষ এবং সবচেয়ে সার্থক শিকারি হলেও এর আগে থেকেই সম্পদশালী ও অহিংসায় আস্থাশীল বঙ্গভূমির সন্তানরা হয়েছেন লোভনীয় এবং নিরাপদ লক্ষ্যবস্তু; সম্পদশালী হওয়ায় তাকে লুট করা, দখল করা লাভজনক এবং অহিংসায় বিশ্বাসী বলে সহজ প্রতিপক্ষ। দখলদারদের পরিকল্পনা সবসময়ই বহুমুখী ছিল, এর একটি হলো বঙ্গীয় মননকে কলুষিত করে বিষিয়ে তোলার মাধ্যমে বঙ্গবাসীর নিজেদের সম্পর্কে বৈরী ও ভুল ধারণা তৈরি করা। এই প্রকল্পে কমবেশি সফল হয়েছেন দখলদারদের সবাই। যেমন তন্ত্রের মতো বস্তুবাদী একটি জীবনদর্শনকে করে তুলেছেন পুরোপুরি আধ্যাত্মিক একটি অতীন্দ্রিয়বাদী ধর্ম। পরবর্তী বঙ্গীয় তাত্ত্বিক, গবেষকরা এমনই বিভ্রান্ত হয়েছেন যে, তারা একে নির্দ্বিধায় ধর্ম হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আহমদ শরীফের মতে, ছকে ফেলে বাংলার তান্ত্রিক ধর্মের বিবর্তন এরূপ দাঁড়ায়: মিথুন ও প্রজনন = সাংখ্য+তন্ত্র+যোগ = শৈব-শাক্ততন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্র = যোগতান্ত্রিক বৌদ্ধ মহাযান মত = বজ্রযান, কালচক্রযান, সহজযান। বজ্রযান, কালচক্রযান থেকে তন্ত্র = বাউল মত হিন্দু তান্ত্রিক ধর্ম। আবার সহজযান থেকে মিথুনাত্মক যোগচর্চা = বৌদ্ধ সহজিয়া প্রকৃতিবর্জিত যোগসাধনা = বৌদ্ধনাথ পন্থ। বৌদ্ধ সহজিয়া প্রকৃতিবর্জিত যোগসাধনা থেকে বৈষ্ণব সহজিয়া। বৌদ্ধ সহজিয়া প্রকৃতিবর্জিত যোগসাধনা = বৌদ্ধনাথ পন্থ থেকে আধুনিক বাউল মত। বৌদ্ধনাথ পন্থ থেকে যোগী শৈবধর্ম। (আহমদ শরীফ ২০১৪: ২৯)। আমাদের বিবেচনায় আহমদ শরীফের ভাবনায় প্রধান সমস্যা হলো তিনি তন্ত্রকে একটি ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করছেন। ফলত এর দার্শনিক দিকটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। দার্শনিক দিকটি উপেক্ষিত হওয়ার ফলে অনেক বিবেচনাই সঠিক পথে ধাবিত হতে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন দেহতত্ত্বের বিষয়টি একেবারেই সাদামাটা কামাচারী অথবা কামবর্জিত বলে বিবেচিত হওয়ায় এটি একটি আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। অথচ এর সঙ্গে প্রকৃতি-পুরুষের মূল বিবেচনাকে আমলে না নিয়ে এখানে লৈঙ্গিক দেহকে প্রতীকায়িত করে এর মূল আবেদন নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রভাব এড়িয়ে মূল তান্ত্রিক আদর্শের দিকে তিনি দৃষ্টি দেননি। তাই তন্ত্র সম্পর্কিত সকল অপপ্রচারেই তিনি কমবেশি আস্থাশীল থেকে তার বক্তব্যকে বিস্তার করেছেন। ফলত তন্ত্র বিদ্বেষীদেরই বর্ণনাকে তিনি তন্ত্রবর্ণনার উৎস হিসেবে গ্রহণ করে স্বাধীন মতামতের সুযোগটি হারিয়েছেন বলে মনে করা যায়। আহমদ শরীফের মতোই বাউলতত্ত্ব ও দেহতত্ত্ব সম্পর্কে বিদ্বান সুধীর চক্রবর্তী তার ‘বাংলা দেহতত্ত্বের গান’ গ্রন্থে দেহতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। দেহতত্ত্বের আলোচনায় তিনি যেসব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, তা মারাত্মক বিভ্রান্তি তৈরির সম্ভাবনায় পূর্ণ। তিনি বলেন, ‘দেহতত্ত্বের গান যারা লিখেছেন সেই অত্যন্ত দরিদ্র শোষিত মানুষের (শোষণ দ্বিস্তরের-উচ্চবর্ণের ও সামাজিক অর্থনীতির) দেহ ছাড়া আর কীইবা নিজের ছিল? তাদের জীবন ছিল অনিশ্চিত, শস্য সম্ভাবনাও অনিশ্চিত, জমি ও বাস্তুও অনিশ্চিত।’ সুধীর চক্রবর্তী কীভাবে এমন নিশ্চিত হলেন? বলা চলে সমগ্র বঙ্গভূমিই একসময় দেহতাত্ত্বিক মতানুসারী ছিলেন, তারা লোকায়তিক, চার্বাক, তান্ত্রিক, যোগী ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত হতেন। পুরো দেশ যেখানে দেহতাত্ত্বিক মতাবলম্বী সেখানে দেশের সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থাকে (ইতিহাসে যার পর্যাপ্ত পরিমাণ সাক্ষ্য রয়েছে) উপেক্ষা করে তিনি কীভাবে সিদ্ধান্তে আসেন যে, ‘দেহই ছিল তাদের নিজের একতম সম্পদ। তাই দেহের উপমাতেই তারা জীবনকে বুঝেছেন এবং অন্যকে বুঝিয়েছে।’ তার মন্তব্যের সমর্থনে অশোক সেনকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, শ্রীঅশোক সেন যেমন বলেছেন যে, ‘লোকধর্মে দেহতত্ত্বের প্রাধান্য নিয়ে অনেক আলোচনা একটি বিশিষ্ট লক্ষণকে সচরাচর গুরুত্ব দেয় না। লোকজীবনের যে অবস্থায় নিঃস্ব দরিদ্রজনের পক্ষে বাইরের কোনো উপকরণের অধিকার নিতান্তই সাধ্যাতীত, সেখানে নিছক দৈহিক সত্তাকে মানুষ বড় করে আঁকড়ে ধরে, তার মধ্যেই জীবনের সব সত্যকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে চায়। সেরকম মানুষই তো বারবার লোকধর্মের আশ্রয়ে ইহকাল পরকালের অবলম্বন খুঁজেছে।’ (বারোমাস, এপ্রিল ১৯৮৭)। সুধীর চক্রবর্তী এবং তার সমর্থনে উদ্ধৃত অশোক সেন অত্যন্ত অবিবেচক এবং অজ্ঞতার উদাহরণ তৈরি করেছেন দেহতাত্ত্বিক সাধকদের নিয়ে এমন মতামতের মাধ্যমে। সুধীর চক্রবর্তী আরও বলেন, ‘নিম্নবর্গের হতদরিদ্র গ্রামীণ মানুষের বুভুক্ষা, সন্তান সংখ্যার বাহুল্য, অসহায় অস্তিত্ব ও করুণ মৃত্যুর যে নিত্য চলমান রূপ যুগে যুগে দেখে চলেছে সমব্যথী মানুষ, দেহতত্ত্বের গান সেই ক্ষতে যেন শুশ্রূষা আর সান্ত্বনার মতো। এ গান তাই যতটা ধর্মসম্পৃক্ত তার চেয়ে অনেক বেশি জীবনস্পর্শী’ (সুধীর চক্রবর্তী ১৯৯০: ৪২-৪৩)। এখানে প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, অর্থনীতি, দর্শন, সমাজ কাঠামো সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে দেহতাত্ত্বিকদের প্রতি অত্যন্ত অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়েছে। কেননা আমরা ভালো করেই জানি এখানকার নিম্নবর্গীয় সৃষ্টির ইতিহাস; চার্বাক, সাংখ্য, তন্ত্র ও যোগ দর্শনের মৌলিক বিষয়গুলো। ব্রাহ্মণরা এসে কীভাবে একটি সামগ্রিক জনগোষ্ঠীকে সেবাদাসে পরিণত করেছে সেসব জানা থাকার পরেও কীভাবে সম্ভব এমন মন্তব্য করা? বঙ্গীয় মানুষের সম্পদ কারা কীভাবে লুণ্ঠন করেছে সেসব তো ইতিহাসে বিস্তারিতই রয়েছে। আর এখানে মানুষের মতাদর্শিকভাবে প্রকৃতি-পুরুষের একীভূত শক্তি বা দেহতত্ত্বে আস্থাশীলতা তো নতুন কোনো ঘটনা নয়; সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পরে সে দেহতাত্ত্বিক হয়ে উঠেছে? সমস্ত তথ্য-উপাত্ত বলবে এখানকার দেহতাত্ত্বিকতার সঙ্গে কোনোভাবেই বিত্তবৈভবের সম্পর্ক নেই, কিন্তু তিনি নিশ্চিত হয়েই এমন সিদ্ধান্ত করে বসেছেন যে, তাদের দেহই একমাত্র সম্পদ হওয়ায় তারা বাধ্যতামূলকভাবে দেহতাত্ত্বিক! আহা পাণ্ডিত্য! তাহলে মূর্খতা কীসের নাম? স্থানীয় এবং আগত বহু পণ্ডিতের এমন আজগুবি পাণ্ডিত্যে আমাদের নিজেদের বিষয়ে কোনো যথার্থ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্প-সংস্কৃতি-অর্থনীতি-দর্শন সবক্ষেত্রেই একই সমস্যা। আমাদের কী আছে কী নেই, থাকলে সেটি কোন মাত্রায়, কোন মানে, কোন অবস্থায় রয়েছে? কেন রয়েছে? এমন কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে, কোনো কিছু তলিয়ে না দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়াসহ এমন বহুবিধ সংকট আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে।
এখানে শিল্পকলা আছে কি নেই, প্রথমত সেই প্রশ্ন নিয়ে আমরা বসে আছি; দ্বিতীয়ত যা আছে সেটি কি আদৌ নান্দনিক বিবেচনায় মানসম্পন্ন কি না? তারপর তার শিকড়ের প্রশ্ন। সেই শিকড় তান্ত্রিক না বৈদিক? তান্ত্রিকে বৈদিকে আদতে কোনো পার্থক্য আছে কি না, এমন অনেক গুরুতর প্রশ্ন আমরা সমাধান না করেই শিল্প শিল্প করছি। তাই শিল্প যা হওয়ার কথা, শিল্পের যে সুফল থাকার কথা তার কিছুই আমাদের সামনে নেই। এর পেছনে পুরোটাই অপরাজনীতি, সেই রাজনীতি কারা কোন স্বার্থে করেছে; কারা লাভবান হচ্ছে, কারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে—এ বিষয়ে ধারণা না থাকলে শিল্প বিষয়ে সব আলোচনাই অর্থহীন বাকবিস্তারে পরিণত হবে। এই রাজনীতি একটি চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছায় বঙ্গীয় অঞ্চল ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণাধীন সময়ে। ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পরে নিয়ন্ত্রণ শিথিল তো হয়ইনি, উল্টো আরও শক্ত হয়ে আমাদের মগজে আটকে গেছে। প্রখর ধীশক্তিসম্পন্ন পর্যবেক্ষক পণ্ডিত কলিম খান তার ‘দিশা থেকে বিদিশায়’ গ্রন্থে বিষয়টি খোলাসা করেছেন:
কেরিসাহেব থেকে সুনীতি চাটুজ্জে সাহেব পর্যন্ত ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত সাহেবদের কাছ থেকে আমরা যখন বাংলা ভাষাটা নতুন করে শিখলাম, ততক্ষণে সেই অফিসিয়াল সাহেবি বাংলার আত্মা বদলে গেছে এবং শরীরেও হাত পড়েছে, প্রায় সমস্ত ভারতীয় ভাষার মতো বাংলা ভাষার ভিতর থেকেও ভারত-আত্মার বিদায় পর্ব সমাধা হয়েছে এবং ইউরোপীয় আত্মার অনুপ্রবেশ ও অধিষ্ঠান সাঙ্গ হয়েছে। অর্থাৎ কিনা, ইউরোপ কেবল ভারতেই উপনিবেশ স্থাপন করেনি, ভারতীয়দের জীবনের সর্বত্র, তার ভাষায় আচারে ব্যবহারে মনে জীবিকায় শিল্পে সাহিত্যে এককথায় সমগ্র জীবনযাত্রায় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল (কলিম খান ১৪০৬: ৯৪)।
এমন সর্বগ্রাসী উপনিবেশে বসে স্থানীয় শিল্প-সংস্কৃতির আলোচনা, সেটি যথার্থ হোক কিংবা অতিরঞ্জন দুটোই পাগলের প্রলাপ মনে হয়। কিন্তু পরিচিতিহীন মানুষের দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির দিশা পেতেই আমাদের এ রাজনীতির কূটচাল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হবে। তবে এ রাজনীতির সূচনা ইংরেজদের হাতে নয়, তারও বহু আগে বৃহৎবঙ্গকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এর প্রথম নজির হিসেবে আমরা উপস্থাপন করতে পারি বৈদিকদের বঙ্গবিদ্বেষকে। ‘বৌধায়নধর্মসূত্রে’ আর্যাবর্তের যে সীমা নির্দিষ্ট হইয়াছে, তাহাতে বাংলাদেশ আর্যাবর্তের অন্তর্ভুক্ত হয় না। মনুক্ত ব্রহ্মাবর্ত বা মধ্যদেশের সীমার মধ্যেও এই দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল না। [...] বঙ্গদেশ যে আর্যবিগর্হিত দেশসমূহের অন্যতম ছিল, তাহার প্রমাণস্বরূপ নিম্নোদ্ধৃত শ্লোকটি সুবিদিত: ‘অঙ্গবঙ্গকলিঙ্গেষু সৌরাষ্ট্রমগধেষু চ। তীর্থযাত্রাং বিনা গচ্ছন্ পুনঃ সংস্কারমর্হতি’ (সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৩৬৯ বঙ্গাব্দ: ১-২)। বঙ্গে গমন এমনই গর্হিত কাজ যে, সেখান থেকে ফিরে এলে তাকে আবার পবিত্র হতে হবে। বঙ্গের প্রতি আক্রোশ এবং বিদ্বেষ থেকে তার নাগরিকদের নানাভাবে অপমান করা হয়েছে। বঙ্গ দখলে আসার আগে ধর্ম গোত্র বর্ণ সবকিছু নিয়েই সমস্যা ছিল বৈদিকদের, বঙ্গ দখলে আসার পর শুরু হয় আরও নানামুখী অত্যাচার। মনুসংহিতা দশম অধ্যায়ে ৬১ নং শ্লোকে আছে, ‘যত্র ত্বেতে পরিধ্বংসা জায়ন্তে বর্ণদূষকাঃ।/ রাষ্ট্রিকৈঃ সহ তদ্রাষ্ট্রং ক্ষিপ্রমেষ বিনশ্যতি ৬১ যে রাজ্যে বর্ণ=দূষক বর্ণ-সঙ্করজাতি উৎপন্ন হয়, রাজ্যবাসী সকল উৎকৃষ্ট প্রজার সহিত ঐ রাজ্য নষ্ট হয় অতএব রাজা রাজ্য হইতে বর্ণ-সঙ্কর জাতির উচ্ছেদ করিবেন (মনু-সংহিতা ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ: ৮৮০)। এমন বিভিন্ন অভিযোগ-অসিলায় শোষণ-নির্যাতন চলেছে বঙ্গবাসীর ওপর। (সেন আমলে) বিরুদ্ধ পরিবেশে কোনো কোনো বৌদ্ধ সম্প্রদায় কিছু হিন্দু-দেবতা ও আচার গ্রহণ করে হিন্দুয়ানীর আবরণে পৈতৃক ধর্ম বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসী হয়। এভাবে যোগী-তান্ত্রিক-বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রজ্ঞা-উপায়ের পরিবর্তে ‘শিব-উমা’ নাম দিয়ে নিজেদের প্রাচীন বিশ্বাস সংস্কার চালু রাখে। মীননাথ-গোরক্ষনাথ-হাড়িপা-কানুপা প্রভৃতি এই সম্প্রদায়ভুক্ত। মীননাথ-গোরক্ষনাথের নাম অনুসারেই এ সম্প্রদায় ‘নাথপন্থি’ রূপে আমাদের কাছে পরিচিত। বৌদ্ধ সহজিয়ারা ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের কালে দুটো ভিন্ন পথে রূপান্তর লাভ করে; বামাচার বর্জিত যোগীরা শৈবনাথরূপে এবং কামাচারীরা বৈষ্ণব সহজিয়া রূপে হিন্দু সমাজের উপসম্প্রদায়ে পরিণত হয়। দ্রাবিড় দেবতা শিব ও উমাকে অনেক আগেই ব্রহ্মণ্যবাদীরা পুরুষ-প্রকৃতির বিগ্রহরূপে গ্রহণ করেছিলেন, পরে শৈব-শাক্ততন্ত্রের শিব-উমাই (বা গৌরি) অবলম্বন হয়। তেমনি বৌদ্ধরাও পুরুষ-প্রকৃতিকে প্রজ্ঞা-উপায় রূপে কল্পনা করে। আবার বৌদ্ধ বিলুপ্তিকালে প্রজ্ঞা-উপায়ের প্রতীকী পরিবর্তনে ‘রাধা-কৃষ্ণ’ তথা বিষ্ণু-লক্ষ্মীও আরাধ্য হয়ে ওঠেন। এ কারণে এ সম্প্রদায় ‘বৈষ্ণব-সহজিয়া’ নামে এক উপসম্প্রদায় হিসেবে হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয় (আহমদ শরীফ ২০১৪: ৩৪)। এখানে প্রতীকের বিবর্তনটি খুব সুন্দরভাবেই ফুটে উঠেছে, যা তন্ত্রের আদি প্রকৃতি-পুরুষ চিন্তারই রূপভেদ। কাজেই কেবল ব্রিটিশ নয়, তারও বহু বছর আগে থেকেই বঙ্গ হয়েছে বিদ্বেষের শিকার। এই বিদ্বেষ কিংবা আক্রোশের নানাবিধ কারণ রয়েছে সেটি ভিন্ন আলোচনা; কিন্তু ক্রমাগত অপপ্রচারের ফলে এই জনপদের মানুষের মাঝে আত্মবিশ্বাসহীনতা তৈরি হয়েছে। নিজেদের শ্রেষ্ঠ সম্পদকে নিজেদের মনে করা কিংবা শ্রেষ্ঠ বলে উপস্থাপন করার নৈতিক মেরুদণ্ড হারিয়ে ফেলেছে বঙ্গীয় জনগোষ্ঠী। ইউরোপীয় ক্ষমতাকাঠামো তাকে একটি চূড়ান্ত রূপ দিয়ে যেন একেবারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলন করে দিয়েছে।
শিল্প-সংস্কৃতি-দর্শন যেহেতু একটি জাতির আত্মপরিচয়ের প্রধান উপাদান তাই এসব ক্ষেত্রই হয়েছে আক্রমণকারীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। শিল্প-শিক্ষা-চিকিৎসা-দর্শন-রাজনীতি সর্বোপরি বঙ্গীয় দর্শন-সংস্কৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন অবাস্তব ও অমূলক নিন্দাঅপবাদ ছড়িয়ে মানুষকে এর থেকে বিমুখ করে তোলা হয়। দর্শনের ক্ষেত্রে আমরা যেমন এখন ‘তন্ত্র’ বলতেই বুঝি জাদুটোনা-ঝাড়ফুঁক-বাণ-উচাটন-বশীকরণ ইত্যাদি আপাত উদ্ভট কিছু বিষয়, আদতে মৌলিক তন্ত্রদর্শনের সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই। শিল্প বলতে বুঝি কিছু লোকশিল্প নামক পশ্চাৎপদ বা পরিত্যাজ্য কিছু প্রথা-প্রকরণের দুর্বল সমাহার অথবা কিছু ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত কিছু আধ্যাত্মিক বিষয়াদির চিত্র-ভাস্কর্য। শিক্ষা বলতে কিছু পশ্চাৎপদ জবরজং আধ্যাত্মিকতা, যাদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। চিকিৎসা বলতে বুঝি কিছু অশিক্ষিত ওঝা-কবিরাজের অপরিশীলিত ভেষজ দাওয়াই। এমন করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি বাতিল প্রকরণকে প্রধান করে তোলার মাধ্যমে অথবা প্রধান ধারাকে নানাবিধ অপবাদ দেওয়ার মাধ্যমে স্থানীয় বিষয়ের প্রতি মানুষের মনকে বিষিয়ে তোলা হয়েছে।
শিল্পী কেন সৃষ্টি করছে? কার জন্য সৃষ্টি করছে? কোন ভৌগোলিক অবস্থায়, কোন সাংস্কৃতিক শর্তের উপস্থিতিতে, কোন শাসনামলে সৃষ্টি করছে, এসবের হদিস না থাকলে শিল্প সম্পর্কে একরাশ মুগ্ধতা অথবা একদলা হতাশা নিয়েই তাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অথবা সেসবের ধারেকাছে না গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের বা প্রভাবশালী মতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতে হবে ভালো কিংবা মন্দ। অর্থাৎ আপনি যদি শিল্পকে বিবেচনা করতে না জানেন, তাহলে নিছক অনুকারী-অনুসারী হওয়া ছাড়া আপনার আর কোনো পথ খোলা নেই। তবে অনুসারী হওয়ার পথ আরামদায়ক এবং নিরাপদ। ঝুঁকি নেই। দল বড়। নিজেকে ঝঞ্ঝাটে ফেলবেন নাকি গড্ডলিকা প্রবাহের সঙ্গে গলা মেলাবেন, এই সিদ্ধান্ত একান্ত আপনার।