কবি কি কেবল নিজের কথাই বলেন বা ভেসে চলেন নিজস্ব তৃপ্তি ও তৃষ্ণার অমিয় ধারায়? না, তার বাইরেও কবির চিন্তায় ক্রমবহমান সমাজ, রাষ্ট্র এবং তুমুল আন্দোলনমান বিশ্ব ও বৈশ্বিক টানাপোড়েন। যিনি পারিপার্শ্বিকতাকে এড়িয়ে যান, সামগ্রিক অন্যায় অবিচার নিপীড়ন যাকে স্পর্শ করে না—পরের ব্যথায় যার হৃদয়ে ক্রন্দন ধ্বনিত হয় না, তিনি হয়তো কবি নন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ থেকে শুরু করে বায়রন, কিটস, বোদলেয়ার—বাংলার মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দও কবিত্বের সেই একই ধ্বনিতে ধ্বনিময়। কবিচরিত্র চিরকালই মানবিক এবং স্বতন্ত্র। কবি হাসান হাফিজের কবিতাও সেই কাব্যধারায় মানবকল্যাণে ভাস্বর। মানুষের কথা ও জীবনবৈচিত্র্যের সুষমায় দিনে দিনে তিনি তৈরি করে চলেছেন কবিতায় তার নিজস্ব ভুবন। যে ভুবন মানবিকতার পক্ষে, যে ভুবন শান্তি ও সাম্যের ধারক। আমার একটি কবিতার শিরোনাম ‘একাকী বোদলেয়র’। কবিতায় বোদলেয়রকে একা ও নিঃসঙ্গ মনে হয়। অবশ্য অনেক কবিই এমন—তারা পারেন একাকী ভুবনের বাসিন্দা হয়েও একটি কোলাহলময় জগৎ রচনা করতে। মানুষ হিসেবে, কবি হিসেবে হাসান হাফিজকে আমার তেমনটি মনে হয়। তিনি চলেন একা, হাঁটেন একা, কথা বলেন একা, অথচ ছড়িয়ে যান সর্বত্র। সকলের কাছে সমাদৃত, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া মানুষটি যেমন কল্পনার বাঁশি বাজাতে পছন্দ করেন, তেমন নির্মম নিষ্ঠুর সত্যকে আলিঙ্গন করতেও তার মধ্যে কোনো কার্পণ্য লক্ষ করা যায় না।
‘তাচ্ছিল্য করেই দ্যাখো
কী রকম অমৃতের স্বাদ পাই
ভালোবেসে নিঃস্ব হয়ে দ্যাখো
কী সুন্দর বিচ্ছেদের পতাকা ওড়াই’
(হোক পরীক্ষা, হাসান হাফিজ)
নির্দ্বিধায় বিচ্ছেদের পতাকা ওড়াতে পারা তার পক্ষেই সম্ভব, যিনি জাগতিক সব নির্মাণের ওপর বসে এক হাতে সৃষ্টি আর অন্য হাতে বিলয়ের খেলা খেলতে পারেন। প্রেম তার কবিতার অন্যতম অঙ্গ।
হাসান হাফিজ সত্য ও সুন্দরের পূজারি। তার কলম মিথ্যা, কদর্যতা এবং হিংসা-হানাহানির বিরুদ্ধে ঝলসে ওঠে বারবার। তিনি মনে করেন, বিধাতা যেমন সত্য, যেমন সত্য প্রকৃতি, পৃথিবী এবং সর্বগ্রাসী প্রেম-ভালোবাসা তেমন সত্য কবিতা। সত্য ও সুন্দরের মিশেলে গড়ে ওঠা শব্দমালা দিয়ে তাই তিনি প্রত্যহ নিবেদনের তার কবিতায়। কবিতাকে একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হিসেবে মান্য করা এই কবির পথচলা একান্তভাবেই মহাসুন্দর কবিতারাজ্যের দিকে। হাসান হাফিজ যে সময়টায় কলম ধরেন, সে সময়টা অস্থিরতা আর অস্থিতিশীলতার সময়। রাজনৈতিক ও সামাজিক টানাপোড়েনে অস্থির সে সময়টায় কবিতা নিয়ে এগিয়ে চলা সত্যিকার অর্থেই ছিল দুরূহ। কিন্তু সে সময়ে যে কজন সাহসী শব্দশিকারি সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নির্ভয়ে শব্দতূণ হাতে নিয়ে এগিয়ে এসেছেন, তিনি তাদের অন্যতম। ঘৃণার বিপরীতে অদম্য ও অজেয় প্রেম দিয়ে সবাইকে জয় করার যে প্রত্যয় হাসান হাফিজে আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা নিঃসন্দেহে অতুলনীয়। হাসান হাফিজ শতগুণে গুণান্বিত হলেও তার বড় পরিচয় তিনি একজন কবিতার মানুষ। কবিতার সঙ্গে নিয়ত বসবাস তাকে ক্রমশ ঋদ্ধ করেছে, শানিত করেছে।
‘থোকা থোকা দুঃখফুল
ছুঁয়ে দেখি তোমার মসৃণ চুল
সাধ হয় ওই চুলে ফাঁস দিয়ে মরি
দেবে কি অমন দান মর্মসহচরী’?
(দেবে না’কি, হাসান হাফিজ)
অথবা
‘ভালোবেসে, ভুল করে
এতো দণ্ড, প্রায়াশ্চিত্ত, নারকীয় যন্ত্রণা অতল
তাও তৃষ্ণা ফুরালো না
বারবার ভালোবেসে ভুল করতে নেই’
(বেজে ওঠো বিবাহ সানাই, হাসান হাফিজ)
দুঃখকে ফুলের সঙ্গে তুলনা তিনিই করতে পারেন, যিনি শিল্পিত আধ্যাত্মিকতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠকে অতিক্রম করে এসেছেন। হাসান হাফিজ সময়ের কবি, প্রেমের কবি, আধ্যাত্মিকতার কবি, দ্রোহের কবি, মাটি ও মানুষের কবি। তার ৭০তম জন্মদিনে অফুরন্ত ভালোবাসা ও শুভকামনা।
দেশবরেণ্য কবি আল মাহমুদ যে আশীর্বাণীতে কবি হাসান হাফিজকে সিক্ত করেছিলেন তার দিকে একটু চোখ বোলানো যাক। কবি আল মাহমুদ লিখেছিলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে কবি হাসান হাফিজকে আমি জানি। পরিচ্ছন্ন কাব্যচেতনা এবং হৃদয়গ্রাহী উপমাসমূহ তার অবলম্বন। তার সম্বন্ধে আমার বক্তব্য হলো, কবি হিসেবে তার শক্তি ও সামর্থ্য আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে। তিনি যদি নিয়মিত লিখে যান তাহলে আশা করা যায়, তিনি এক সুন্দর স্বাভাবিক সৃজনশীলতার উপত্যকায় পৌঁছবেন।
কবির কাজ হলো নিয়মিত উপমা, ছন্দ ও গন্ধের উদ্যানে পৌঁছে যাওয়া। আমার বিশ্বাস আছে, কবি হাসান হাফিজ সেই আনন্দের উদ্যানে পৌঁছতে পারবেন। তবে কাব্য হলো নিয়মিত শব্দের গুঞ্জনের মধ্যে নিজকে সমর্পিত রাখা। আমি তার একজন সমর্থনকারী এবং তার সাফল্যের জন্য অপেক্ষমাণ। আমি মনে করি, কবি হিসেবে তিনি নিজেকে শব্দের গুঞ্জনের মধ্যে সমর্পিত রাখবেন। এখন সময় এসেছে তার কথা বলার আগে গভীর ধ্যান ও বিবেচনার। আমি মনে করি, কবি হাসান হাফিজ কবির সামনে যত সংকট মুহূর্ত উপস্থিত হয়, একে একে তা অতিক্রম করে গেছেন। এখন স্থিত হয়ে তাকে প্রকৃত কবিতার কাজ বানিয়ে যেতে হবে।
আমি সর্বান্তঃকরণে আশা করি, হাসান হাফিজ সাফল্যের উপকূলে এসে পৌঁছবেন। তার কর্তব্য হবে ছন্দে, শব্দতরঙ্গে নিজের অন্তরে আপ্লুত হয়ে থাকা। কবিকে মনে রাখতে হয়, ভালোবাসার চেয়ে আর কোনো মহত্তর কাজ কবির জন্য অবশিষ্ট থাকে না। লিখতে হবে এবং একই সঙ্গে শিখতে হবে। কবির শিক্ষা, জানার বেদনা কোনো অবস্থাতেই শেষ হয় না। আমি তার সফলতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকব। তার হাতে পূর্ণাঙ্গ, প্রস্ফুটিত আনন্দ-বেদনার এবং উদ্দীপনার উৎসরণ ঘটবে।
আল মাহমুদের আকাঙ্ক্ষার মতোই হাসান হাফিজের কবিতার সাফল্য উত্তরোত্তর প্রত্যাশিত উপকূলের দিকে ধাবিত হতে থাকবে এবং বাংলা কবিতায় সংযোজিত হতে থাকবে নতুন নতুন পালক—৭০তম জন্মদিন সামনে রেখে এ প্রত্যাশা ও শুভকামনা।