জাকির হোসেন
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:২১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ : গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার

মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ : গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার স্বনামধন্য গীতিকার। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে বাংলা ছায়াছবি ও আধুনিক গানের জগৎকে যারা প্রেম ও আবেগে উষ্ণ রেখেছিলেন, তিনি তাদেরই একজন। গীত রচনায় তার বৈশিষ্ট্য শব্দচয়নে। মান্না দের গাওয়া তার লেখা ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ ২০০৪ সালে বিবিসির জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানে ঠাঁই পেয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছেন একাধিক কালজয়ী গান। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতন তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তাই তার হৃদয়ের গহিন থেকে উঠে আসা গান হয়ে উঠেছিল একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিকামী মানুষের অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস। শুধু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই নয়, তার লেখা দুটি গান বিগত ৫১ বছর ধরে একই মহিমায় ধ্বনিত হচ্ছে অগণিত মানুষের মুখে। এর একটি ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/ আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি:/ বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’। অন্যটি ‘মা গো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/ তোমার ভয় নেই মা আমরা/ প্রতিবাদ করতে জানি।’

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। আমার বাড়ি ছিল পাবনায়। ১৯৪৭ সালে ভারতে চলে আসি। কিন্তু আমার মন পড়ে ছিল বাংলাদেশে। তাই গান দুটি লিখে সেই জন্মস্থানের ঋণ কিছুটা হলেও আমি শোধ করেছি।’

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে। কলকাতার দক্ষিণে যে গড়িয়া এলাকা, সেটা তখনো শহরের চৌহদ্দিতে ঢোকেনি। ওই শহরতলি অঞ্চলের বেশিরভাগটাতেই গড়ে উঠেছে ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে চলে যাওয়া উদ্বাস্তুদের কলোনি। রামগড়ের পদ্মশ্রী সিনেমা হলের কাছেই একটা চায়ের দোকানে নিয়মিত আড্ডা দিতেন ওই অঞ্চলেরই বাসিন্দা কয়েকজন গীতিকার, সুরকার আর গায়করা। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, অংশুমান রায়, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ নাহা, দিনেন্দ্র চৌধুরী; তারা সবাই নিয়মিত আড্ডা দিতেন। ৮ মার্চ সকালে রামগড়ের ওই চায়ের দোকানে দীনেন চৌধুরী, অংশুমান রায়ের সঙ্গে আড্ডায় বসে গৌরীপ্রসন্ন। ওই সময় তারা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে পান। আর এটা শুনতে শুনতে সিগারেটের প্যাকেটের সাদা কাগজে গৌরীপ্রসন্ন লিখে ফেললেন ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/ আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি।’ সুর করলেন অংশুমান, গাইলেনও তিনি। গানটা ইংরেজিতে অনুবাদও হয়, ‘আ মিলিয়ন মুজিবর সিঙ্গিং’। ১৯৭১-এ মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিপরিষদের শপথ অনুষ্ঠানে বাজানো হয় সেই গান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-এর ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। বাংলাদেশ বেতারের জন্য লিখেছিলেন ‘মাগো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে’। হেমন্তের কণ্ঠে বিপ্লব এনেছিল সে গান।

পাবনার গোপালনগর গ্রামে জন্ম গৌরীপ্রসন্নের। ১৯২৫ সালের ৫ ডিসেম্বর। বাবা প্রেসিডেন্সি কলেজের খ্যাতনামা অধ্যাপক উদ্ভিদবিদ গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার। তার সহপাঠীদের তালিকায় ছিলেন সি ভি রমন, ডক্টর রাধাকৃষ্ণন। প্রাচীন ভারতে উদ্ভিদবিদ্যা ও কৃষিবিদ্যা নিয়ে গবেষণার জন্য সংস্কৃত পুঁথি থেকে তথ্য সংগ্রহ করতেন। ছোটদের পত্রিকায় বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ লিখতেন। মা সুধা মজুমদার ছিলেন স্নাতক। কবিতা ও প্রবন্ধ লেখার প্রতি ছিল তার অসীম আগ্রহ। ছোট থেকেই গৌরীপ্রসন্নের হাতের কাছে দেশি-বিদেশি বই। বাড়িতে বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত ভাষার চর্চা। ছাত্রজীবনের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেললেন কালীদাসের ‘মেঘদূতম’। ইংরেজি ও বাংলা দুটিতেই স্নাতকোত্তর হয়েছিলেন তিনি। সংগীত সাধনার একদম শুরুর দিকেই পেয়েছিলেন শচীন দেব বর্মণের সান্নিধ্য। এ সান্নিধ্য এতটাই গভীরে রূপ নিয়েছিল যে, উভয়ের সম্মিলনে সৃষ্টি হয়েছিল ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’ ইত্যাদি কালজয়ী গান। শুধু শচীন দেব বর্মণ নন, কিশোর কুমার, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, রাহুল দেববর্মণ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায় প্রমুখ স্বনামধন্য শিল্পী গেয়েছেন তার লেখা গান। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বহু কালজয়ী গানের গীতিকার। এসবের মধ্যে রয়েছে ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’, ‘কী আশায় বাঁধি খেলা ঘর বেদনার বালুচরে’, ‘ও নদী রে/ একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায় এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’, ‘আজ দুজনার দুটি পথ’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’, ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’, ‘কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখো’, ‘তুমি না হয় রহিতে কাছে’, ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে’ ইত্যাদি।

মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ খ্যাতিমান গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাকে ২০১২ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ জানানো হয়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২৭ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে আজ

নাটোরে অপহরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৭

ছাত্র ইউনিয়নের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত 

ভোট দেওয়ার শর্তে কোরআন ছুয়ে নিতে হবে টাকা, কল রেকর্ড ভাইরাল

‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম ভয়াবহ সঙ্কটকাল পার করছে’

 ছেলের কিল-ঘুষিতে শিক্ষক পিতার মৃত্যু

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ১০ বছর আজ

‘ভয়াল ২৯ এপ্রিল, ১৯৯১ স্মরণ ও প্যারাবন নিধন প্রতিবাদ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

শাহ আমানতে ৯০ হাজার দিরহামসহ যাত্রী আটক

১০

আবুধাবিতে চালু হচ্ছে উড়ন্ত ট্যাক্সি, ৩০ মিনিটেই দুবাই

১১

গরু চোরাচালানে জড়িত ছাত্রলীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধি

১২

ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ চায় খেলাফত মজলিস

১৩

বাংলাদেশ এসএসসি ৯৮ ফ্রেন্ডস ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু

১৪

চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় গেলেন আমির খসরু 

১৫

উত্তর কোরিয়া থেকে অস্ত্র নিয়ে চীনা বন্দরে রুশ জাহাজ

১৬

বর্জ্যবাহী গাড়ির ধাক্কায় নিহতের ঘটনায় ব্যবস্থা : তাপস

১৭

বর্ণিল আয়োজনে রূপায়ণ সিটি উত্তরায় সামার ফেস্ট-২০২৪ অনুষ্ঠিত

১৮

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা 

১৯

বিসিএস পরীক্ষার্থীর আঁকুতি / ‘পরীক্ষা দিতে না পারলে আমি মরে যাব স্যার’

২০
*/ ?>
X