মে. জে. (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩, ০৯:০৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

৭ মার্চ ভাষণের সামরিক তাৎপর্য

৭ মার্চ ভাষণের সামরিক তাৎপর্য

আমরা ঐতিহাসিক ৭ মার্চ দিনটি অতিক্রম করেছি দুদিন হলো। বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক তৈরি হয়েছিল একাত্তরের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স, বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ওইদিন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় ১০ লাখ জনতার উপস্থিতিতে মাত্র ১৮ মিনিটের একটি অলিখিত ভাষণে ২৪ বছর যাবৎ পাকিস্তানি শাসকদের সীমাহীন শোষণ ও নির্যাতনের একটি প্রখর চিত্র তুলে ধরে সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক ও সামরিক দর্শনের পরিপূর্ণ একটি রূপরেখা দীর্ঘ সংগ্রাম, তারপর সশস্ত্র যুদ্ধ এবং যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশকে গড়ে তোলার সব দর্শন ও প্রজ্ঞার পরিস্ফুটনই ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর জীবনে।

বঙ্গবন্ধুর সামরিক চিন্তাভাবনার অন্য দুটি অধ্যায় নিয়ে অন্য কোনো সুযোগে লেখার ইচ্ছা আছে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও তার প্রস্তুতির জন্য বঙ্গবন্ধুর যে সামরিক দর্শন ছিল তা বিশ্লেষণ করতে হলে সেটি প্রধানত দুটি আঙ্গিকে করা প্রয়োজন। প্রথমটি হলো, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং সেই ভাষণের ভেতর নিহিত সমর কৌশলের দিকনির্দেশনা। দ্বিতীয় দিকটি হলো, বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাঙালিদের যে করতে হবে তাও তার দূরদৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল বহু পূর্বে। তাই তো দেখা যায়, ছয় দফার ষষ্ঠ দফায় পূর্ব-পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠনের দাবির মাধ্যমে বাঙালি যুবসমাজের একটা অংশ পাকিস্তানের নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোকে অনুসরণ করেই সামরিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। যাতে তারাই মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় হতে পারে বাংলাদেশ গণমুক্তি ফৌজের নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রস্থল। তাদের ঘিরেই যাতে সব বাঙালি সুসংগঠিত হয়ে যুদ্ধ চালাতে পারে। তারপর বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক বিশ্বস্ত ও নিবেদিত সহচর তাজউদ্দীন আহমদ অতি অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধকে যেভাবে সুসংগঠিত করেছিলেন এবং দ্রুত জয়লাভের জন্য বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের যে সামরিক সহায়তা পেয়েছিলেন তাতে এটা স্পষ্ট হয়, এগুলো সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর আয়োজিত পূর্ব প্রস্তুতির ফল। তবে সেই আয়োজন ও নির্দেশনাগুলো কী, কখন ও কীভাবে ছিল তা এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। তাই আমার বিশ্লেষণটি সীমাবদ্ধ থাকবে শুধু ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে। ৭ মার্চের ভাষণের প্রায় শেষাংশে তাৎপর্যপূর্ণ সামরিক নির্দেশনা ছিল।

যেমন—এক. ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ দুই. ‘জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু তোমরা বন্ধ করে দিবে।’ তিন. ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব।’ চার. ‘শত্রু পিছনে ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে।’ পাঁচ. ‘বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, নন-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ ছয়. ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।’ বৃহৎ এবং দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধের জন্য মাও সে তুংয়ের খ্যাতনামা ম্যাক্সিম হলো, ‘শত্রু যখন ক্লান্ত হয়ে পিছু হঠবে ও নিজেদের সংকুচিত করবে তখন তাকে ধাওয়া কর এবং আঘাত করো। আর শত্রু যখন এগোবে তখন পথে অসংখ্য ছোট ছোট বাধা সৃষ্টি করো এবং নিজেরা চলে যাও নিরাপদ স্থানে।’ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা ও যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার নির্দেশ ছিল মাও সে তুংয়ের উপরোক্ত সফল গেরিলা যুদ্ধের কৌশলের প্রতিফলন। এ নির্দেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টতই সব বাঙালি জনগোষ্ঠীকে যুদ্ধে শামিল হতে বলেছিলেন। এ সূত্রের সফল প্রয়োগ যত বেশি হবে, ততই গেরিলা বাহিনীর সংখ্যা ও শক্তি গুণিতক হারে বাড়তে থাকবে। ফলে আক্রমণকারী বা দখলদারদের ভেতরে ভীতির সঞ্চার হবে, তারা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে ক্যাম্প ও বাংকারের মধ্যে। আর তখন শত্রুর পরাজয় হয়ে পড়ে অবশ্যম্ভাবী এবং সময়ের ব্যাপার মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে আত্মসমর্পণের আগপর্যন্ত পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থা প্রায় সর্বত্রই ক্যাম্প ও বাংকারভিত্তিক হয়ে গিয়েছিল। আধুনিক কনভেনশনাল বা প্রচলিত এবং নন-কনভেনশনাল বা অপ্রচলিত, উভয় প্রকার যুদ্ধেই ডিনায়াল প্ল্যান কার্যকরী করা যুদ্ধের একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ পরিকল্পনার মূল কথা হলো, নিজেদের কোনো সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা শত্রু যেন ব্যবহার করতে না পারে। রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু বন্ধ করা এবং ভাতে মারব ও পানিতে মারব নির্দেশনার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সমর কৌশল ডিনায়াল প্ল্যান বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। উল্লিখিত চতুর্থ নির্দেশনামার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মূলত সমগ্র বাঙালি জাতি এবং বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবে তাদের সবার জন্য সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন।

২৬ মার্চের আগে কিছু বাঙালি সেনা ইউনিট বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করেছিল। এসব সেনা ইউনিটসহ পুলিশ, ইপিআর এবং বিক্ষিপ্তভাবে সারা দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে একটা শক্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও অসহযোগ আন্দোলন পুরো বাঙালি জাতিকে বিশেষত সেনাবাহিনী, পুলিশ, তৎকালীন ইপিআর এবং আনসার বাহিনীর সদস্যদের এমনভাবে উদ্বেলিত করেছিল যে, তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে যার কাছে যে অস্ত্র ছিল তা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের মিলন ও সমন্বয় ঘটতে তেমন সময় লাগেনি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশকে অবলম্বন করে এবং বঙ্গবন্ধুর নামে বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক ফ্রন্ট এবং সশস্ত্র ফ্রন্ট এভাবে একই মোহনায় মিলিত হয়ে অগ্রসর হয়েছিল।

যুদ্ধের সময় পুরো ৯ মাস প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার মনে সবসময় প্রেরণা ও অদম্য সাহস জুগিয়েছে ৭ মার্চের ভাষণের মর্মবাণী। ৯ মাসব্যাপী মুজিবের কণ্ঠস্বর ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র হতে ১৯৭১ সালের ২৬ মে থেকে ১৯৭২-এর ২ জানুয়ারি পর্যন্ত একটা গান প্রতিদিন নিয়মিত প্রচারিত হতো। গানটির কয়েকটি লাইন ছিল এইরূপ : শোনো একটি মজিবরের থেকে,/লক্ষ মজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি,/আকাশে বাতাসে উঠে রণি,/বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিরসরাইয়ে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা

বিশ্বজয়ী অধিনায়কের সংগ্রহে ‘১০০০’ ব্যাট

মার্ক জাকারবার্গকে টপকে গেলেন ইলন মাস্ক

থাইল্যান্ডের কাছে চিকিৎসা খাতে বিনিয়োগ চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী

আমার দেখা ভিয়েতনাম

মানুষের কষ্টে যুবলীগ ঘরে বসে থাকে না: পরশ

মার্কিন সহায়তায় কি বাঁচবে ইউক্রেন?

গরমে গরিবের এসি যেন মাটির ঘর

টানা তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ, ভাঙল ৭৬ বছরের রেকর্ড

বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠাকরণে বাজেটে বরাদ্দ প্রয়োজন

১০

দলবদলে সরগরম থাকবে বার্সা!

১১

থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ সমঝোতা ও চুক্তি সই

১২

ফ্লোরিডায় কনসাল জেনারেল হলেন সেহেলী সাবরীন

১৩

গুরুদাসপুরে বৃষ্টির প্রার্থনায় ইসতিসকার নামাজ

১৪

ভোজ্যতেলে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে এসিআইয়ের সূর্যমুখীর হাইসান-৩৬ জাত

১৫

দেশের উন্নয়নে বাস্তুচ্যুতদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সরকার বদ্ধপরিকর : ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী

১৬

দুবাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ছাত্রলীগ নেতার

১৭

ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ গেল আইডিয়াল ছাত্রের

১৮

যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করল চীন

১৯

চিকিৎসার জন্য সন্তান বিক্রি করলেন বাবা

২০
*/ ?>
X