প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ১১ মে ২০২৩, ০৯:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এবার তবে বিদায় বলুন কাজী সালাউদ্দিন

এবার তবে বিদায় বলুন কাজী সালাউদ্দিন

সত্তর ও আশির দশকে আমাদের শৈশব ছিল ফুটবলময়। এখন যেমন চার বছর পরপর বিশ্বকাপ এলেই গোটা বাংলাদেশ বুঁদ হয়ে যায় ফুটবলে, তখন সারা বছরই আমরা মেতে থাকতাম ফুটবলে। তখন আবাহনী-মোহামেডান খেলা মানেই সারা দেশ দুভাগে ভাগ হয়ে যেত। কে কার চেয়ে বড় পতাকা বানাতে পারে, তাই নিয়ে প্রতিযোগিতা চলত। আর আবাহনী-মোহামেডান খেলা শেষ হলেই গুলিস্তান পরিণত হতো রণক্ষেত্রে। মোহামেডান সমর্থকদের বলা হতো কসাই। মোহামেডান হারলে মাংসের দাম বেড়ে যেত। আর ‘ওয়ারী আইলো’ বললেই ক্ষেপে যেত আবাহনী সমর্থকরা। স্টেডিয়ামে আবাহনী ও মোহামেডান সমর্থকদের জন্য আলাদা গ্যালারির ব্যবস্থা ছিল। এক দলের সমর্থক আরেক গ্যালারিতে ঢুকে পড়লে তার কপালে সেদিন উত্তম-মধ্যম জুটত ভালোই। আবাহনী-মোহামেডানের খেলার আগে-পরে গণমাধ্যমের অনেকটাজুড়ে থাকত খেলার খবর। শুধু খেলা দেখা, বিশেষ কোনো দলকে সমর্থন করাই নয়; বিকেল হলেই আমরা মাঠে নেমে পড়তাম ফুটবল নিয়ে। পারি আর না পারি, ফুটবলে লাথি মারাটাই ছিল আনন্দের। ঝুমবৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলা আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে মধুর স্মৃতি।

শত শত মিডিয়ার কল্যাণে সাকিব আল হাসানদের নিয়ে আজ যতটা ক্রেজ, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল কাজী সালাউদ্দিনকে নিয়ে। সত্যিকার অর্থে সালাউদ্দিন ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সুপারস্টার। স্মার্টনেস, স্টাইল দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের আইকন। মনে আছে, একবার সালাউদ্দিনসহ চার ফুটবলারকে গ্রেপ্তার করা হলে রীতিমতো ঝড় বয়ে যায় সারা দেশে। সালাউদ্দিন, হেলাল, কোহিনুর, আসলাম, চুন্নু, টুটুল, গাফফার, বাদল রায়, সালাম মুর্শেদী, কায়সার হামিদ, শান্টু, মহসিন, কানন, জোসী, ওয়াসিম, আবুল, ইউসুফ, কামাল, আশিষ ভদ্র, অমলেশ, সাব্বির, মুন্না, পাকির আলি, প্রেমলাল, এমেকা, নালজেগার, সামির শাকির—আহা কত প্রিয় নাম। নব্বই দশকের শুরুতে ক্রিকেটের সম্ভাবনার জোয়ারে ভেসে যায় ফুটবলের ক্রেজ। ক্রিকেটের উত্থানের সঙ্গে ফুটবলের পতনের যোগসূত্রটা কী, আমার মাথায় ঢোকে না। বাংলা সিনেমার একটা নাম ছিল ‘মা বড় না বউ বড়’। এ স্টুপিডিটির মতোই আমাদের সামনে প্রশ্ন এসে যায়, ফুটবল না ক্রিকেট? সাফল্যের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা কর্তারা বেছে নিলেন ক্রিকেট। মা মরে গেলে অনেক আদরের বড় ছেলেটাও যেমন পর হয়ে যায়, ফুটবলও তেমনি অনাদরে-অবহেলায় আড়ালে চলে গেল।

বাংলাদেশের প্রথম সুপারস্টার সালাউদ্দিন যখন বাংলাদেশের ফুটবলের দায়িত্ব নিলেন, আমরা আশায় বুক বেঁধেছি, নিশ্চয়ই তার হাত ধরেই ফুটবলের পুনর্জাগরণ ঘটবে। কিন্তু গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ফুটবলের দুটি ঘটনা ঘটেছে। কাজী সালাউদ্দিনের চেয়ার আর ফুটবলের অধোগতি। পরিসংখ্যান, র‌্যাঙ্কিং দিয়ে মাপার দরকার নেই। ফুটবল এখন মাঠে নেই বললেই চলে, যেটুকু আছে তা বিতর্কের টেবিলে। ৩০ বছর আগের ৩০ জন ফুটবলারের নাম আমি এক লহমায় বলে দিতে পারি। কিন্তু এখনকার জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়কের নামও অনেকে জানেন না।

কাজী সালাউদ্দিন, যার ডাক নাম তূর্য, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলেরও সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম সুপারস্টার সালাউদ্দিন গত ১৫ বছরে একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে বাংলাদেশের ফুটবলের মতো নিজের সুনামকেও তলানিতে নিয়ে এসেছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো সালাউদ্দিনকে সবচেয়ে বিতর্কিত ও সবচেয়ে বিতর্কিত বাফুফে সভাপতি হিসেবেই মনে রাখবে। সুপারস্টার সালাউদ্দিন হয়তো হারিয়ে যাবেন বিস্মৃতির অতলে।

ফুটবলের এ অধোগতির মধ্যেও নারী ফুটবল দল আমাদের অনেক সাফল্য এনে দিয়েছে। সাফজয়ী সেই নারী ফুটবল দলকে টাকার অভাবে অলিম্পিক বাছাই খেলতে মিয়ানমারে পাঠাতে পারেনি বাফুফে। অল্প কয়েকটা টাকার জন্য নারী ফুটবল দলকে মিয়ানমার না পাঠানো নিয়ে অনেক জলঘোলা হয়েছে। হেঁট হয়েছে বাংলাদেশের মাথা। পরে যা জানা গেল, কাজী সালাউদ্দিন আসলে টাকা জোগাড়ের চেষ্টাই করেননি। অহংকার আর আত্মম্ভরিতায় বুঁদ হয়ে থাকা সালাউদ্দিন একাই ডুবিয়েছেন দেশের সম্মান। এ ইস্যুতে ইচ্ছা করে বিতর্কে জড়িয়েছেন বিসিবিপ্রধান নাজমুল হাসান পাপনের সঙ্গে।

গত কয়েক বছরে অনেক ঘটনা ঘটেছে, যাতে আত্মসম্মান থাকলে সালাউদ্দিন নিজে থেকেই সরে যেতেন। আমার ধারণা, তিনি হয়তো চাইছেন, একজন মানুষ কতটা নিচে নামতে পারেন, তার উদাহরণ হতে। সাফল্য না হোক, সততা দিয়ে বিশ্ব ফুটবলে মাথা উঁচু থাকতে পারত আমাদের। কিন্তু সালাউদ্দিন গং সেখানেও আমাদের মাথা কেটেছে। জালিয়াতি, মিথ্যাচার, অনিয়ম, তহবিল তছরুপের দায়ে ফিফা বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। ১২ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। ফিফা বাফুফেকে বিবেচনা করেছে প্রতিষ্ঠান হিসেবে। যেহেতু সব কাজ হয়েছে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগের স্বাক্ষরে। তাই ফিফা তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু কলঙ্কের নৈতিক দায় নিতে হবে সভাপতি সালাউদ্দিনকেও। তাকে না জানিয়ে সাধারণ সম্পাদক দিনের পর দিন অনিয়ম করেছেন, এটা অবিশ্বাস্য। আমার ধারণা পুরো ঘটনা সালাউদ্দিনের জ্ঞাতসারেই হয়েছে। তাই এ দুর্নীতির দায়ে ফিফার শাস্তির সঙ্গে সঙ্গেই কাজী সালাউদ্দিনের পদত্যাগ করা উচিত ছিল। আর যদি সত্যি সত্যি সালাউদ্দিন কিছু না জেনে থাকেন, তাহলে ব্যর্থতা আর অযোগ্যতার দায়ে তার পদত্যাগ করা উচিত। দিনের পর দিন সাধারণ সম্পাদক দুর্নীতি করবেন আর সভাপতি কিছুই জানবেন না, তাহলে তার থাকার দরকার কী।

ন্যূনতম আত্মসম্মান থাকলে লজ্জায় সালাউদ্দিনের মুখ দেখানোর কথা নয়। কিন্তু সেই সালাউদ্দিন এখনো দোর্দণ্ড প্রতাপে তার দুঃশাসন চালিয়ে যাচ্ছেন। বাফুফে ব্যর্থতার যে পরাকাষ্ঠা বছরের পর বছর দেখিয়ে আসছে, তাতে সাংবাদিকরা এতদিনে সালাউদ্দিন এবং বাফুফেকে ছিঁড়ে ফেলার কথা। সত্য কথাটা ঠিকমতো লিখলেই সালাউদ্দিনের পালিয়ে বাঁচার দশা হতো। আমার ধারণা, ক্রীড়া সাংবাদিকদের অনেকেই সালাউদ্দিনের অতীত অর্জনের কথা ভেবে, অনেক ছাড় দিয়ে এসেছেন। কিন্তু তাও সইছিল না বিন্দুমাত্র সমালোচনা বা ভিন্নমত সইতে পারার ক্ষমতা না থাকা সালাউদ্দিনের। গত সপ্তাহে বাফুফের এক সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার আগে বাফুফের কর্মকর্তারা নিজেরা কথা বলছিলেন। সেই অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় সাংবাদিকদের সম্পর্কে কাজী সালাউদ্দিনের মনোভাব ফুটে ওঠে। কাজী সালাউদ্দিন বলছিলেন, ‘জার্নালিস্টরা এখানে ঢুকতে গেলে আমার এখানে তাদের বাপ-মার ছবি দিতে হবে। আরেকটা কন্ডিশন হলো, তাদের বাপের ছবি দিতে হবে এবং সেই ছবি পাঠাতে হবে জুতা পরা। এটা হতে হবে মেন্ডেটরি।’ এ কথা বলে সালাউদ্দিন আসলে শুধু সাংবাদিকদের নয়, অপমান করেছেন দেশের কোটি মানুষকে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো সালাউদ্দিন দামি বুট পরে ফুটবল খেলেছেন। ফিফার টাকা চুরি করে হয়তো এখনো দামি জুতাই পরেন। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক মানুষ এখনো ঠিকমতো জুতা পরতে পারেন না। এটা ঠিক, অনেক সাংবাদিকের বাপেরই হয়তো পরার মতো ভালো জুতা নেই বা ছিল না। সাংবাদিকদের খাটো করতে গিয়ে সালাউদ্দিন আসলে নিজেকেই খাটো করেছেন। পায়ের যে বুটের কারণে দেশের মানুষ একদিন তাকে মাথায় তুলে নিয়েছিল, সালাউদ্দিন এবার নিজেই সেই জুতা গলায় তুলে নিলেন। অনেকে সালাউদ্দিনকে এখন ডাকছেন জুতাউদ্দিন বলে। নিজের গলার অদৃশ্য জুতার মালাটা তিনি হয়তো দেখতেই পাচ্ছেন না।

অনানুষ্ঠানিক সেই কথোপকথন রেকর্ড হয়ে প্রচারিত হওয়ায় সালাউদ্দিন ক্ষমা চেয়েছেন। তবে তার সেই ক্ষমাটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তিনি বলেছেন, যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন, তবে তিনি দুঃখিত। সাংবাদিকদের বাপ-মা তুলে কথা বলার পরও কষ্ট পেতে ‘যদি’ লাগবে কেন। ক্ষমা চাওয়ার সবচেয়ে আপত্তিকর অংশ হলো, কথোপকথন যে রেকর্ড হচ্ছে, এটা তিনি জানতেন না। তার মানে রেকর্ড না হলেই এ ধরনের অসৌজন্যমূলক কথা তিনি বলতে পারেন। আপত্তি শুধু রেকর্ড হওয়া নিয়ে। মানুষকে যিনি এভাবে হেয় করতে পারেন, তার শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক ঐতিহ্য নিয়েই আসলে সন্দেহ জাগে। ফুটবলার হিসেবে যিনি বাংলাদেশের হিমালয়, মানুষ হিসেবে এতটাই নোংরা; এটা ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছে। এই সালাউদ্দিন শৈশবে আমাদের নায়ক ছিলেন, ভাবতেই নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে।

চার মেয়াদে ১৫ বছরে বাফুফের সভাপতি হিসেবে সালাউদ্দিনের যা পারফরম্যান্স আর যত বিতর্ক তিনি সৃষ্টি করেছেন; তাতে অনেকবার তার পদত্যাগ করা উচিত ছিল। এখন নিজের গলায় অদৃশ্য জুতার মালা নিয়ে ঘুরছেন। সত্যি সত্যি জুতার মালা পরে বিদায় নেওয়ার আগেই তার পদত্যাগ করা উচিত।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোট শুরু

ছুটির দিনটি কেমন যাবে আপনার?

এক রাতে ৫ সেচ মেশিন চুরি, বোরো ধান চাষে শঙ্কা

টোল আদায় নিয়ে সংঘর্ষ, আহত ২৫

ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ গেল মোটরসাইকেল আরোহীর

দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধান বিরোধী নয় : হাইকোর্ট

আজ ৪৬তম বিসিএস প্রিলি পরীক্ষা, যেসব নির্দেশনা মানতে হবে

ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

২৬ এপ্রিল : নামাজের সময়সূচি

১০

শুক্রবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১১

হাতি শুঁড় দিয়ে আছাড় মারল কৃষককে

১২

বাবার বাড়ি যাওয়ায় স্ত্রীকে ২৭ কোপ দিলেন স্বামী

১৩

সিলেটে ট্রাক-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২

১৪

ব্যারিস্টার খোকনের দলীয় পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি 

১৫

বাড়ি ফেরা হলো না বাবা-ছেলের

১৬

বাংলাদেশের দাবদাহ নিয়ে যা বলছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম

১৭

অনুষ্ঠিত হলো বিইউএইচএস -এর প্রথম সমাবর্তন

১৮

ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে : ম্যাখোঁ

১৯

ছেলেদের দোষে ডুবছেন মাহাথির মোহাম্মদ

২০
*/ ?>
X