পাকিস্তান নিয়ে কিছু লিখলেই বাংলাদেশের কিছু মানুষের দিলে চোট লাগে। আসলে ‘কিছু লিখলেই’ নয়, আসলে বিপক্ষে কিছু লিখলেই হবে; তবে গত কয়েক বছরে পাকিস্তানের পক্ষে বলার মতো কিছু নেই। তাই যাই লিখি, তাই পাকিস্তানের বিপক্ষে যায়। তাই ‘পাকিস্তান’ শব্দটি লিখলেই কিছু মানুষ হে রে রে করে তেড়ে আসেন। আমি এদের বলি মানসিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানি। কারণ, শারীরিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিরাও আছেন এ দেশে। শারীরিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের জন্য আমার করুণা আছে, ঘৃণা নেই। কিন্তু মানসিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের জন্য; যারা বাংলাদেশে জন্মে, বাংলাদেশের মানুষ হয়েও; অন্তরে পাকিস্তানকে ধারণ করেন, তাদের জন্য রয়েছে বুকভরা ঘৃণা। আশা করি, একদিন তাদের বোধোদয় হবে, অন্তর থেকে পাকিস্তান সরিয়ে বাংলাদেশকে ভালোবাসতে শিখবে তারা। এ পর্যন্ত পড়েই মানসিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিরা সমস্বরে হুক্কাহুয়া তুলবে, বলবে, আপনি তো ভারতের দালাল, পাকিস্তানকে সহ্য করতে পারেন না। আপনি তো পাকিস্তানের বিপক্ষে লিখবেনই। আবার আমি যখন ভারতের সমালোচনা করে কিছু লিখি, তখন আর এ আটকেপড়াদের দেখা পাই না। তারা তখন গর্তে লুকিয়ে থাকেন। আমি যখন পাকিস্তানকে নিয়ে লিখি, তখন শুধু পাকিস্তানকে নিয়েই লিখি। কাউকে খুশি করার জন্য তাতে একটু ভারতবিরোধিতা জুড়ে দিই না। আর পাকিস্তান-ভারতকে এক পাল্লায় মাপার মতো নিরপেক্ষ আমি নই। যে কেউ বাংলাদেশের স্বার্থের বিপক্ষে কিছু করলে বা বললে, আমি তার বিরুদ্ধে। আমার বুকজুড়ে শুধু বাংলাদেশ। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
পাকিস্তান একটি অকার্যকর রাষ্ট্র, পাকিস্তান একটি দেউলিয়া রাষ্ট্র; এ কথা বলাবলি হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। যাদের হৃদয়ে পাকিস্তান তারা কিছুতেই এ অভিযোগ মানতে চান না। কিন্তু ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে তাকালে যে কেউ মানবেন, একটি কার্যকর রাষ্ট্রের জন্য যা যা দরকার, তার কিছুই নেই পাকিস্তানে। হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রই সেখানে রাজনীতি। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনীই পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক। ঝামেলা বেশি হয়ে গেলে কাশ্মীর সীমান্তে একটা যুদ্ধ বাধিয়ে দিলেই জিহাদি জোশে জেগে ওঠে পুরো পাকিস্তান। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিই একটি দেশকে খাদের কিনারে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এটুকু পড়েই আবার মানসিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিরা চিল্লাচিল্লি শুরু করবে—নিজের দেশে গণতন্ত্র নেই, আসছে পাকিস্তানের গণতন্ত্র নিয়ে সবক দিতে। এটা ঠিক বাংলাদেশেও গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার, অর্থ পাচার, লুটপাট নিয়ে অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু তাও বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে হাজারগুণে ভালো। বাংলাদেশকে ব্যর্থ প্রমাণ করে যারা পাকিস্তানের ব্যর্থতাকে জাস্টিফাই করতে চান, তাদের জন্যই কবি আব্দুল হাকিম লিখে গেছেন—
‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী,
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’
জানি তারপরও মানবেন না, তবে এবার পাকিস্তানকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছেন সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা আসিফ। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি শিয়ালকোটে একটি বেসরকারি কলেজের অনুষ্ঠানে খাজা আসিফ বলেন, ‘পাকিস্তান এরই মধ্যে ঋণখেলাপি হয়ে গেছে এবং আমরা এক দেউলিয়া দেশে বাস করছি।’ নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে খাজা আসিফ বলেন, ‘আপনারা সবাই হয়তো জেনে গেছেন, পাকিস্তান দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে; অথবা খেলাপি রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে বা ভাঙনের দিকে যাচ্ছে। এটি ইতোমধ্যেই হয়েছে। আমরা একটি দেউলিয়া দেশে বাস করছি।’ এ পরিস্থিতির জন্য তিনি ক্ষমতাচক্র, আমলাতন্ত্র এবং রাজনীতিবিদ সবাইকে দায়ী করেছেন। চক্ষুলজ্জা বা ভয়ে তিনি হয়তো সেনাবাহিনীর কথা বলেননি। একটি স্থিতিশীল দেশ হওয়ার জন্য নিজের পায়ে দাঁড়ানো অপরিহার্য বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সমস্যার সমাধান দেশের মধ্যেই রয়েছে। আইএমএফের কাছে পাকিস্তানের সমস্যার কোনো সমাধান নেই।’ বর্তমানে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা গত সাত দশকে সংবিধান ও আইনের শাসনের প্রতি ন্যূনতম সম্মান না দেখানোরই ফল বলেই মনে করেন খাজা আসিফ। বর্তমান অবস্থার জন্য ইমরান খান সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আড়াই বছর আগে সন্ত্রাসীদের পাকিস্তানে আনা হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদের বর্তমান ঢেউয়ে পরিণত হয়েছে।’ সমস্যার সমাধানের পথ বাতলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দেশটিতে দামি সরকারি জমিতে যে দুটি বিলাসবহুল গলফ কোর্স আছে, সে দুটি বিক্রি করলে দেশটির এক-চতুর্থাংশ ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে।’
গলফ কোর্স বিক্রি না করলেও চলমান অর্থনৈতিক সংকট মেটাতে পাকিস্তানের সরকার ব্যয় কমানোর দিকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে—৩৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তান সরকার নানা চেষ্টা করে গেলেও সফলতা পাচ্ছে না। আইএমএফের শর্ত মেনে নতুন করারোপ ও পেট্রোলের দাম বাড়ানোর কারণেই মূল্যস্ফীতি আকাশ ছুঁয়েছে। পাকিস্তানে প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম এখন সর্বকালীন রেকর্ড—প্রতি লিটার ২৭২ রুপি।
খাজা আসিফের কথা শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী জাইঘাম খানের কথা। ২০১৮ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বে পিটিআই ক্ষমতায় আসার পর জাইঘাম খান এক টকশোতে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘খোদা কি ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানা দো।’ ইমরান খান বা শাহবাজ শরিফরা পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বানাতে পারেননি। দেউলিয়া রাষ্ট্র বানিয়েছেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বীকারোক্তির পর এখন বাংলাদেশে মানসিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিরা পাকিস্তানকে রক্ষায় কী যুক্তি দেবেন কে জানে।
এখন ভাবতেও ভয় লাগে, ২৩ বছর এই পাকিস্তানের অংশ ছিল আজকের বাংলাদেশও। অবশ্য এই ২৩ বছরই তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের কেটেছে আন্দোলন আর মুক্তির সংগ্রামে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা তাদের ২০০ বছরের শাসন শেষে চলে যাওয়ার আগে ভারতবর্ষ ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন দেশ দিয়ে যায়। দ্বিজাতিতত্ত্বের গড়া পাকিস্তান নামের অদ্ভুত রাষ্ট্রের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল ১১০০ মাইল। আর মানসিক দূরত্ব ছিল অলঙ্ঘনীয়। ব্রিটিশদের কায়দায় পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শোষণ চালিয়ে যাচ্ছিল। ৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের অর্থে ফুলেফেঁপে উঠেছে পশ্চিম পাকিস্তান। ধর্মের নামে গড়া পাকিস্তান যে একটি দুঃস্বপ্ন সেটা বুঝতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের এক বছরের বেশি সময় লাগেনি। প্রথম আঘাতটা আসে ভাষার ওপর। ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষা রক্ষায় রক্ত দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেদিনই আসলে বাঙালির মনে স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল। সেই বীজ থেকেই আজকের মহীরুহ বাংলাদেশ। ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম আর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম। ভাষাসৈনিক আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার চিরকালীন শ্রদ্ধা। আমরা জীবনে অনেক কিছু হতে পারব, কিন্তু কখনো ভাষাসৈনিক বা মুক্তিযোদ্ধা হতে পারব না। ভাষাসৈনিকরা ১৯৫২ সালে জীবনের মায়া না করে প্রতিবাদ করেছিলেন বলেই স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল আর মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালে জীবনের মায়া না করে যুদ্ধ করেছিলেন বলে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। অনেকেই তখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ হবে তলাবিহীন ঝুড়ি। কিন্তু সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বিস্ময়। আর পাকিস্তান আজ স্বঘোষিত দেউলিয়া। সেদিন স্বাধীন না হলে পশ্চিমারা অনেক আগেই শোষণ করে পূর্ব পাকিস্তানকেও দেউলিয়া বানিয়ে ফেলত।
ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি চিরদিনের কৃতজ্ঞতা, তারা আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার সুযোগ দিয়ে গেছেন; একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। যেই দেশকে আমরা আমাদের মতো গড়ে নেওয়ার সুযোগ দিয়ে গেছেন। বৈশ্বিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের অর্থনীতিও আজ চাপের মুখে। তবে আমাদের সক্ষমতা আছে ঘুরে দাঁড়ানোর। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা নয়, বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়; কখনো হবেও না।
লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ