ড. অরূপরতন চৌধুরী
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৩, ০৮:৪৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ‘তামাক’ বড় প্রতিবন্ধক

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ‘তামাক’ বড় প্রতিবন্ধক

জনস্বার্থে ও সময়ের প্রয়োজনে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। সংবিধান ও জনমতের আলোকে গৃহীত এসব উদ্যোগ যাচাই করা হয়। আইন ও পলিসি হলে প্রয়োজনে তা যুগোপযোগী ও বাস্তবায়নযোগ্য করতে একাধিকবার পরিমার্জন/সংশোধন করা হয়ে থাকে, যাতে করে বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা না থাকে এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকারের এমন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে—‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন। ২০০৫ সালে প্রণীত এ আইন সবশেষ ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। বাস্তবায়নে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেওয়াতে এবং উদ্ভূত কিছু নব্য সমস্যার কারণে বিদ্যমান আইনটি আবারও সংশোধনের অপরিহার্যতা দেখা দিয়েছে। জনকল্যাণের গুরুদায়িত্ব হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছে কাজটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য। সংবিধানের আলোকে জনস্বাস্থ্যের উন্নতিকল্পে এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়ে আইনটির খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত করা হয়। বিদ্যমান আইনের উল্লেখযোগ্য সংশোধন ও সংযোজন হচ্ছে—পাবলিক প্লেস, পরিবহনের আওতা বৃদ্ধি ও এসব স্থানে সব ধরনের তামাকজাতদ্রব্য সেবন নিষিদ্ধ, জরিমানা বৃদ্ধি এবং এসব স্থানে আলাদাভাবে ‘ধূমপানের স্থান’ না রাখা। তামাক কোম্পানির ‘সিএসআর’ কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। বিক্রয়স্থলে তামাকজাতদ্রব্য দৃষ্টির আড়ালে রাখা। খোলা ও খুচরা এবং ভ্রাম্যমাণ তামাক বিক্রয় নিষিদ্ধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের দোকান না রাখা। তামাকজাতদ্রব্য বিক্রয়ে লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা। তামাকপণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ৯০ শতাংশ করা। ই-সিগারেট বা ভেপিংয়ের আমদানি, উৎপাদন, বিক্রয়, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উল্লেখযোগ্য।

নিয়মানুসারে, খসড়া আইনের ওপর স্টেকহোল্ডারদের (তামাক কোম্পানি বাদে) মতামতের জন্য গত বছর ১৯ জুন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। তামাক কোম্পানি এখানে স্টেকহোল্ডার নয়। কারণ তামাক কোম্পানির উদ্দেশ্য এবং সরকারের উদ্দেশ্য পরস্পর বিপরীতমুখী। সরকার জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে পদক্ষেপ নিচ্ছে, অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে তামাক কোম্পানি। আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে মতামত আহ্বানের পর সংশোধনীর পক্ষে ১৬ হাজার এবং বিপক্ষে ১ হাজার ১০০ মতামত এসেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, আইন সংশোধনের বিপক্ষে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মালিক সমিতি ও ব্যক্তির নামে প্রেরিত চিঠির বেশিরভাগই ভুয়া ও নামসর্বস্ব। অনেকের নাম, সংস্থার প্যাড, স্বাক্ষর অনুমতি ছাড়াই জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে তামাক স্বার্থান্বেষীদের বিরুদ্ধে।

যে কোনো উদ্যোগে বিপক্ষ মতামত থাকবে তবে, তা যদি বাস্তবসম্মত হয় তাহলে সেটা আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু শুভ উদ্যোগের বিপরীতে অবাস্তব ও জনকল্যাণ-পরিপন্থি মতগ্রহণ কিংবা ন্যূনতম বিবেচনা করার যোগ্যতা রাখে না। কেননা তামাক কোম্পানি মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে তাদের পণ্যের বাজার প্রসারেই বেশি মনোযোগী। জনকল্যাণ তাদের কাছে গৌণ বিষয় মাত্র। সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে যা করে সেগুলো হলো অপকর্ম গোপন করা অর্থাৎ—‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’। অন্যদিকে সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে জনকল্যাণ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা। যেমন—তামাক কোম্পানিগুলো পরিবেশ সুরক্ষার নামে ঢাকঢোল পেটাচ্ছে। অথচ তামাকজাতদ্রব্য উৎপাদন ও বিক্রি কমাতে অনাগ্রহী। তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সেবনে স্বাস্থ্যের সঙ্গে পরিবেশের কতটা ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে তা কমবেশি সবাই জানে। এটা পরিষ্কার যে, তামাক কোম্পানি যা বলে, করে তার বিপরীত! এ বিরোধিতা আজকের নয়। বিগত দিনের মতো এবারও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন কার্যক্রমের শুরু থেকেই তামাক কোম্পানির দোসরদের গাত্রদাহ চলছে। গুরুত্বপূর্ণ এ উদ্যোগটি বিফল ও বিলম্ব করতে নানাভাবে সরকারের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে চলেছে। অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক কথা ও তথ্য তুলে ধরে প্রচার-প্রচারণা তাদের একটি বড় কৌশল।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে দেশের অর্থনৈতিক সংকটে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ২০২১ সালে ১০০ মিলিয়ন ডলারের অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। তামাক খাত থেকে সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করে। প্রস্তাবিত খসড়া আইনটি পাস করা হলে সরকারের রাজস্ব আয় কমবে, এ ধরনের কথাবার্তায় সরব একশ্রেণির তথাকথিত অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, রাষ্ট্রের কোষাগারে অধিক রাজস্ব আয় করা জনগণের জীবন, পরিবেশ সুরক্ষার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ! কী হবে রাজস্ব দিয়ে যদি রোগে-শোকে জীর্ণ-শীর্ণ জীবনের পথেই মৃত্যুর মিছিলে রাষ্ট্রে জনগণ অবশিষ্ট না থাকে?

তামাক রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বিষয়টি যতটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার হচ্ছে সেটার যৌক্তিকতা নেই। কারণ তামাকের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে সরকার এর চাষাবাদ, উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিরুৎসাহিত করছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। স্বাস্থ্যহানিকর একটি ভেষজ রপ্তানি আয়ের বড় উৎস হিসেবে জাহির করা হলে খাদ্য শস্য উৎপাদন কমার আশঙ্কা থেকেই যায়। কারণ বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় সবজি উৎপাদনকারী দেশ। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে বাংলাদেশে উৎপাদিত অন্যান্য কৃষিপণ্যের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। সেগুলোর বাজারজাত ও রপ্তানি প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা উচিত। অন্যদিকে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের জন্য বড় দুর্ভিক্ষ অপেক্ষা করছে। আর সেটি হবে মূলত খাদ্যের বড় সংকট। তাহলে কেন তামাক রপ্তানি বড় করে দেখানো হচ্ছে? প্রশ্ন থেকেই যায়। নাকি সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসা বাক্য ‘তামাক অর্থকরী ফসল’ যা এখনো পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয় সেটা প্রতিষ্ঠিত করার অপকৌশল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আবার? যদি তাই হয়, তবে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকারবিরুদ্ধ।

তামাক মাদকে আসক্তির প্রবেশ পথ। গবেষণা বলছে, মাদকাসক্তদের ৯৫ শতাংশ ধূমপায়ী। আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্মকে ভয়ানক মাদকের দিকে ধাবিত করছে তামাক কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে তামাক ও মাদকাসক্তির মতো প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই বিশ্বনেতাদের সামনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন। মাদকের বিরুদ্ধে তিনি জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও স্বাস্থ্যসহায়ক বিভিন্ন নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি সরকারের তরফ থেকে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে; যাতে করে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর উন্নত বাংলাদেশ নিশ্চিত করা যায়। এ শুভ উদ্যোগেও বিপক্ষ মতাবলম্বীরা আর যাই হোক, দেশ ও জনগণের মঙ্গল চায় না!

অপকর্ম ঢাকতে সাধু সেজে থাকা তামাক কোম্পানিগুলোর পুরোনো অভ্যাস। দীর্ঘ পরিকল্পনার মাধ্যমে ‘তামাক খাত থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব প্রাপ্তি’ বিষয়টি সরকারের অসংখ্য নীতিনির্ধারক, সুশীল ও সর্বসাধারণের মগজে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। পেইড এজেন্টদের দিয়ে গণমাধ্যম, সভা-সেমিনারে এগুলোই আওড়ানো হয়। তাদের মুখে তামাকের ভয়াবহতা অর্থাৎ তামাকের কারণে স্বাস্থ্য খাতে যে ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা খরচ হয়, বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়, ৪ লাখ পঙ্গু হয় এবং ১২ লাখ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় তার বিবরণ শোনা যায় না।

জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির পক্ষে কতিপয় তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের জনবিরোধী একতরফা গুণকীর্তন সমাজের সুশীল ও প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের জন্য বর্তমানে বেশ ভাবনার বিষয়। নিজেদের স্বার্থে জাতির বৃহত্তর কল্যাণ অবজ্ঞা করছে তারা। এ তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা তামাক কোম্পানির মজা খেয়ে গুণগান গায়। এরা জাতীয় শত্রু। এদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে সরকারের জনস্বাস্থ্য রক্ষার উদ্যোগ ব্যাহত করতে চায় তামাক স্বার্থান্বেষীরা। জাতীয় স্বার্থে এদের রুখতে হবে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে—এই হোক আমাদের প্রত্যয়।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিনা টিকিটে ১২ বছর রেল ভ্রমণ, অতঃপর...

বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নারী শ্রমিককে যৌন হয়রানি

ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের প্রথম জার্নাল প্রকাশিত

প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে ‘সেমিস্টার ডে ২০২৪’ উদ্‌যাপন

ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শ্রাবণের ওপর হামলার অভিযোগ

খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিলেন ফখরুল

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধরাশায়ী হলো বাংলাদেশ

রাজধানীতে বিটিআরসির অভিযান, সরঞ্জামাদি জব্দ

৫৪ মণ ওজনের গরু প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিতে চান হামিদা

নরসিংদীতে বিদ্যুৎস্পর্শে ঝলসে গেছে দুই শিক্ষার্থী

১০

হবিগঞ্জে খড়ের গাদা থেকে পড়ে কৃষকের মৃত্যু

১১

কুমিল্লায় শিশু হত্যা মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

১২

মৌলভীবাজারে গরম মসলার বাজারে অভিযান

১৩

শাবি কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি রমজান, সম্পাদক জাবেদ

১৪

নরসিংদীতে নেতাকর্মীদের ভালোবাসায় সিক্ত বিএনপি নেতা খায়রুল কবির খোকন

১৫

আশাশুনি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন মোস্তাকিম 

১৬

চসিকে যুক্ত হলো ময়লার ৪০ কন্টেইনার

১৭

ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে রিকশাচালকের আত্মহত্যা

১৮

ক্রিকেট খেলায় পাওয়ারপ্লে কি? কখন এবং কেন পাওয়ারপ্লে দেখানো হয়?

১৯

চবি ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন

২০
X