প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৩, ০৮:৪৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের শিক্ষা

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের শিক্ষা

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় একটা ইতিবাচক আবহ তৈরি করেছে। অংশগ্রহণমূলক না হলেও অনেক দিন পর একটা অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দারুণ স্বস্তি দিয়েছে সবাইকে। নির্বাচনের ফলাফল এতদিনে সবার জানা হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র হয়েছেন রাজনীতিতে আনকোরা জায়েদা খাতুন। এটাও সবার জানা, জায়েদা খাতুন আসলে নিজের যোগ্যতায় নয়, জয় পেয়েছেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা হিসেবে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রাপ্তি অনেক, অপ্রাপ্তিও কম নয়। তবে এ নির্বাচন থেকে নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের অনেক কিছু শেখার আছে। প্রশ্ন হলো, আমরা কতটা শিখব এবং সেই শিক্ষা কতটা কাজে লাগাব।

২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে এই আজমত উল্লাকে হারিয়েই মেয়র হয়েছিলেন বিএনপি প্রার্থী এম এ মান্নান। তবে এবার বিএনপি তাদের আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়নি। অংশ না নিলেও নির্বাচনের দিকে তাদের মনোযোগ ছিল। বরাবরই এ ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি একটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। তারা আসলে দূরে বসে মজা নেয়। সরকারি দলের প্রার্থী জিতলে বলে, আমরা আগেই জানতাম বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সেটা আবারও প্রমাণিত হলো। এ কারণেই আমরা নির্বাচনে যাইনি। আর সরকারি দলের প্রার্থী হেরে গেলে বলে, আবারও প্রমাণিত হলো, এ সরকারের প্রতি জনগণের কোনো সমর্থন নেই। গাজীপুরের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নিজেরা অংশ না নিলেও নৌকার পরাজয়ে বিএনপি শিবিরে দারুণ উল্লাস।

তবে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে সবারই কিছু না কিছু শেখার আছে। নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি—সবাই সামনের রাজনীতি এগিয়ে নেওয়ার জন্য গাজীপুর থেকে নিজেদের পরিকল্পনা ঝালিয়ে নিতে পারেন। প্রথম শিক্ষাটা হলো নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনের আগে থেকেই নির্বাচন কমিশন বারবার বলছিল, তারা গাজীপুরে একটা মডেল নির্বাচন করতে চান। এটা মানতেই হবে, বাংলাদেশের বিবেচনায় গাজীপুরের একটা ভালো, মডেলের কাছাকাছি মানের নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের দিনে অন্তত কোনো অভিযোগ করতে পারেনি কেউই। তবে নির্বাচনের আগের দিনগুলোর ব্যাপারে কমিশনকে আরও সতর্ক থাকতে হবে এবং কঠোর হতে হবে। ভোট গ্রহণের আগের দিন ভোটারদের ভয় দেখানোর অভিযোগ আওয়ামী লীগের এক কাউন্সিলর প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন অবশ্য যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে। এ দৃঢ়তাটা বজায় রাখতে হবে সবক্ষেত্রেই। তবে নির্বাচন কমিশনকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে ফলাফল ঘোষণার ক্ষেত্রে। গাজীপুরে সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছিল, রাত ১০টার মধ্যেই ফলাফল পাওয়া যাবে। কিন্তু পুরো ফলাফল পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে মধ্যরাত পর্যন্ত। ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব, নির্বাচনে অনেক বিভ্রান্তি তৈরি করে। অনেকে বলেন, ফলাফল ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশন ফোনের জন্য অপেক্ষা করে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে দারুণ নির্বাচন করেও ফলাফল ঘোষণায় বিভ্রান্তির কারণে সমালোচনা শুনতে হয়েছে কমিশনকে। একই ঘটনা ঘটেছে গাজীপুরেও। বিলম্বের কারণে অনেকে নানা প্রশ্ন তোলার সুযোগ পেয়েছেন। দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে ফলাফল ঘোষণার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।

অংশ না নিলেও গাজীপুর থেকে বিএনপিরও অনেক কিছু শেখার আছে। প্রথম কথা হলো, তারা আন্দোলন করছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের জন্য। তাদের দাবি আদায় হলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে না। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন বয়কট করে তারা আসলে সংগঠনকে আরও কোণঠাসা করে ফেলছে। গাজীপুরে অন্তত ২৯ জন নেতা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাউন্সিলর নির্বাচন করে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। বহিষ্কৃতদের মধ্যে ১০ জন নির্বাচিত হয়েছেন। তৃণমূলে জনপ্রিয় এ নেতাদের বহিষ্কার করে দলকে আরও দুর্বলই করা হবে শুধু। হারুক আর জিতুক, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিলে স্থানীয় পর্যায়ে দল চাঙ্গা রাখা যায়। এ সুযোগটা বিএনপি নিতে পারত। গাজীপুরে যে ফলাফল আমরা দেখেছি এবং যে মানের নির্বাচন হয়েছে, তাতে বিএনপির জন্য দারুণ সুযোগ ছিল। যেটা তারা নষ্ট করল। আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় বাকি চারটি সিটি নির্বাচনের বিএনপি বাইরে থেকে নিজেদের ক্ষতিই করবে শুধু। মার্কিন ভিসা নীতির ফলে সরকারের পক্ষে এখন চাইলেও নির্বাচনের ফল পাল্টে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এ সুবিধাটা নিতে পারত। প্রয়োজনে নির্বাচন থেকে শুরু হতে পারত নতুন আন্দোলন। আর গাজীপুরে এবার প্রায় ৫০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। তার মানে নির্বাচনের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ ফুরিয়ে যায়নি। বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থাকলে জনগণের আবেগেরও বাইরে চলে যেতে হবে তাদের।

তবে গাজীপুর থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা নিতে হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেই। বিএনপি অংশ না নেওয়ার পরও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয় তাদের কপালে চিন্তার বড় ভাঁজ ফেলেছে। তবে আওয়ামী লীগের শিক্ষাটা ইতিবাচক, নেতিবাচক দুই অর্থেই। আওয়ামী লীগ মনোনীত আজমত উল্লা খান হেরেছেন জীবনে রাজনীতি না করা এক গৃহবধূ জায়েদা খাতুনের কাছে। আসলে জায়েদা খাতুন এখানে ফ্যাক্টর নন, ফ্যাক্টর হলেন তার ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। গাজীপুরে আসলে পাস করেছেন জাহাঙ্গীরের মা। জাহাঙ্গীর আলম আগের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নেই মেয়র হয়েছিলেন। পরে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন এবং মেয়র পদও হারিয়েছিলেন। কিন্তু বছর তিনেক মেয়র থাকার সময় গাজীপুরে ব্যাপক উন্নয়নকাজ করেছিলেন তিনি। নিয়ম মেনে না মেনে অনেক রাস্তা বানিয়েছেন। শ্রমিকদের বিপদে আপদেও তিনি পাশে ছিলেন। ভোটাররা সেটা ভোলেননি। তার মানে উন্নয়ন করলে, মানুষের পাশে থাকলে তারা ভোট দেন। এ শিক্ষাটা আওয়ামী লীগের জন্য জরুরি। অনেকে বলছেন, দেশে এখন আওয়ামী লীগ এতটাই অজনপ্রিয় যে, নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করলেই পরাজয় নিশ্চিত। তবে গাজীপুরের ভোটের অঙ্ক কিন্তু এ ধারণাকে সমর্থন করে না। আজমত উল্লা হেরেছেন মাত্র ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটে। তিনি পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। আর যার কাছে হেরেছেন তিনিও আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী। জাহাঙ্গীর আলম পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় একবারও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। এমনকি বিজয়ের পরও জাহাঙ্গীর বলেছেন, ব্যক্তি হেরেছে, নৌকা নয়। বিজয়ের পর নবনির্বাচিত মেয়র জায়েদা খাতুন বিশাল বহর নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। সেখানে জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেছেন, তিনি জন্ম থেকে আওয়ামী লীগ। তাই জায়েদা খাতুনের পাওয়া ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোটের একটা বড় অংশও আওয়ামী লীগেরই। তার মানে আজম উল্লা এবং জায়েদা খাতুনের একটা অংশ ধরলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমেনি। তাই সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই আওয়ামী লীগ ভেসে যাবে, এমন ধারণা যারা করেন, তারা ভুল করেন।

তবে আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা নিতে হবে, প্রার্থী মনোনয়ন এবং দলীয় কোন্দল থেকে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভালো ফল করতে হলে প্রার্থী মনোনয়নে সতর্ক থাকতে হবে। দলীয় কোন্দল মিটিয়ে সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। উন্নয়নের বার্তাটা জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে। সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা হলো, জনগণের কাছে যেতে হবে। গত দুটি নির্বাচন হাওয়ার ওপর জিতে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গায়ে চর্বি জমে গেছে। নির্বাচনের আগেই এ চর্বি কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। গাজীপুরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের লড়াই হয়েছে। কিন্তু মার্কিন ভিসা নীতির পর আগামী নির্বাচন যে অত সহজ হবে না সেটা বুঝতে হবে, আমলে নিতে হবে। না হলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিশ্বজয়ী অধিনায়কের সংগ্রহে ‘১০০০’ ব্যাট

মার্ক জাকারবার্গকে টপকে গেলেন ইলন মাস্ক

আমার দেখা ভিয়েতনাম

মানুষের কষ্টে যুবলীগ ঘরে বসে থাকে না: পরশ

মার্কিন সহায়তায় কি বাঁচবে ইউক্রেন?

গরমে গরিবের এসি যেন মাটির ঘর

টানা তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ, ভাঙল ৭৬ বছরের রেকর্ড

বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠাকরণে বাজেটে বরাদ্দ প্রয়োজন

দলবদলে সরগরম থাকবে বার্সা!

থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ সমঝোতা ও চুক্তি সই

১০

ফ্লোরিডায় কনসাল জেনারেল হলেন সেহেলী সাবরীন

১১

গুরুদাসপুরে বৃষ্টির প্রার্থনায় ইসতিসকার নামাজ

১২

ভোজ্যতেলে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে এসিআইয়ের সূর্যমুখীর হাইসান-৩৬ জাত

১৩

দেশের উন্নয়নে বাস্তুচ্যুতদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সরকার বদ্ধপরিকর : ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী

১৪

দুবাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ছাত্রলীগ নেতার

১৫

ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ গেল আইডিয়াল ছাত্রের

১৬

যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করল চীন

১৭

চিকিৎসার জন্য সন্তান বিক্রি করলেন বাবা

১৮

বন্দনা করা ছাড়া জাতীয় পার্টির রাজনীতি নেই: ফিরোজ রশিদ

১৯

এক মিনিটেই তাদের বিসিএসের স্বপ্নভঙ্গ

২০
*/ ?>
X