শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
জাকির হোসেন
প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সাত দশকেও অপূর্ণ শহীদ মিনার

সাত দশকেও অপূর্ণ শহীদ মিনার

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আমাদের মিলিত চেতনার স্থান। ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত এ শহীদ মিনার আমাদের স্বাধীনতা-পূর্ব এবং স্বাধীনতা-উত্তর সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জুগিয়েছে প্রেরণা। ’৬৬-এর ছাত্র আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে যেমন সংগ্রামী মানুষের আধার ছিল এই শহীদ মিনার, তেমনি স্বাধীনতা সংগ্রামে শত্রুর পাশবিক থাবায় আহত এ শহীদ মিনার ৯ মাস এ দেশের মানুষের প্রাণে জুগিয়েছে মুক্তির সংগ্রামী চেতনা—শুনিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ী জীবনের অভয় বাণী। আবার স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ এ দেশের প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে এই শহীদ মিনারের পাদপীঠ থেকেই।

কিন্তু ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাত দশক অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও নকশা অনুযায়ী পূর্ণতা পায়নি এ শহীদ মিনার। আজও তা রয়ে গেছে অপূর্ণ। শহীদ মিনারের বর্তমানের অপূর্ণ রূপটিও পরিগ্রহ করেছে নানা বিবর্তনের মাধ্যমে। আজ যেখানে শহীদ মিনারটি দাঁড়িয়ে আছে এখানেই ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর প্রথম গুলি চালানো হয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি এখানে তৈরি করা হয়েছিল একটি স্মৃতিস্তম্ভ। ওইদিন (২২ ফেব্রুয়ারি) সূর্যাস্তের সময় ভাষা আন্দোলনের তৎকালীন নেতাকর্মীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। রাতে ইট-সুরকি, সিমেন্ট ও অন্যান্য মাল-মসলা জোগাড় করে ভাষা আন্দোলনের প্রাণচঞ্চল তরুণরাই সারা রাত ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজটি সম্পন্ন করেন। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে যিনি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন সেই ‘দৈনিক আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন যুব ছাত্র-জনতার কৃতজ্ঞতাভাজন হন, তেমনি অন্যদিকে তৎকালীন সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে চুরমার করে দেয়।

এরপর ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে এককভাবে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকার তাদের নির্বাচনী ওয়াদা মোতাবেক ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর আতাউর রহমান খান শহীদ মিনারের ব্লু প্রিন্ট ও ডিজাইন তৈরির জন্য প্রখ্যাত স্থপতি হামিদুর রহমানকে নিযুক্ত করেন। শহীদ মিনারের অঙ্গশোভা পরিকল্পনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী কামরুল হাসান। স্থপতি হামিদুর রহমানের মূল নকশা ছিল এরূপ—স্তম্ভগুলোর সামনের চত্বরের মধ্যস্থলে একটি সরোবর, সরোবরে রক্তকমল শাপলা, স্তম্ভগুলোর অবনত মাথার ছায়া, স্তম্ভের মধ্যবর্তী ফাঁকে ফাঁকে শিক, মূল শহীদবেদির দুই পাশে দুটি সবুজ কামরা, এর একটি পাঠাগার, অন্যটি জাদুঘর। মূল চত্বরের বাইরে একটি বেদি। উঁচু বেদি হবে সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের স্থান।

এ বিষয়ে স্থপতির ব্যাখ্যা হলো—মূল বেদি হলো জন্মভূমি। অবনত মাথা স্তম্ভগুলো এবং পাশেরগুলো হলো জনতা। স্বচ্ছপানি শহীদের আত্মার প্রতিকৃতি। রক্তকমল শাপলা হলো আত্মদানের প্রতীক। সরোবরে অবনত শিরের ছায়া হচ্ছে শহীদের আত্মদানের প্রতি দেশবাসীর কৃতজ্ঞতা।

আতাউর রহমান খানের সরকার পরিকল্পনা প্রণয়নে দক্ষতার পরিচয় দিলেও দুই বছরের অধিক ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও স্থপতির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অঙ্কিত নকশা মোতাবেক শহীদ মিনার নির্মাণের চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উর্দুভাষী গভর্নর লে. জে. আজম খান বর্তমান শহীদ মিনারটি নির্মাণের ব্যবস্থা করেন এবং ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ বরকতের মা ওই মিনারটি উদ্বোধন করেন। লে. জে. আজম খান নির্মিত এ শহীদ মিনারটি ছিল স্থপতি হামিদুর রহমান কর্তৃক অঙ্কিত নকশার আংশিক বাস্তবায়ন মাত্র।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর কামানের গোলার আঘাতে এ শহীদ মিনার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এ ঘটনায় মারা যান শহীদ মিনারের প্রহরী দেলোয়ার হোসেন, সালাহ উদ্দীন ও রইছ আলী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ী জাতির আনন্দ অশ্রুতে মুছে যায় শহীদ মিনারে আঘাতের যাতনা। আয়োজন করা হয় সংগ্রামী প্রেরণার অক্ষয় মিনার দৃঢ়তার ভিত্তি স্থাপনের আয়োজন।

রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি পরিষদ গঠিত হয়। একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মিনারের জন্য নকশা বাছাই করে এ পরিষদ। প্রতিদ্বন্দ্বী ১২টি নকশার মধ্যে শিল্পী হামিদুর রহমান এবং জাফরের নকশা শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়। সেই নকশা অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরে এই নকশা অসম্পূর্ণ বিবেচিত হয় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার তৈরির চিন্তাভাবনা শুরু হয়। এরপর জেনারেল জিয়াউর রহমানের শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আবুল ফজল ১৯৭৬ সালের জুন মাসে শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলে প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদকে মিনারের নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিদের নিয়ে একটি পরিষদ গঠিত হয়। স্থপতি ড. এমএ মুকতাদির, হাবিবুর রহমান, শামসুল ওয়ারেস ও খায়রুল আনাম কর্তৃক প্রস্তাবিত তিনটি নকশার মধ্যে সরকার একটি গ্রহণ করে। এটিই মূল নকশা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু কাজটি করা হয়নি। ‘গৃহীত নকশায় বর্ধিত উচ্চতর মিনার, বেদিসংলগ্ন পশ্চিমের জমিতে একটি গ্যালারি জাতীয় নিচু ভবনের মধ্যে দেয়াল চিত্র, ভাস্কর্য ও লেখার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষিত হবে, চত্বরের উত্তর সীমায় খণ্ড খণ্ড দেয়াল (এখানে একুশের গান, কবিতা, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য থাকবে) ইত্যাদির কথা বলা হয়।

জেনারেল এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণপূর্ত বিভাগ মূল নকশার বিষয়গুলো এড়িয়ে একটি নকশা তৈরি করে এবং ওই নকশা অনুযায়ী ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এ কাজে নিযুক্ত হয় জুবিলী ইঞ্জিনিয়ারিং। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৫০০ লোক দিন-রাত পরিশ্রম করে ২১ ফেব্রুয়ারির আগে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে।

নবনির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মোট জমির পরিমাণ প্রায় চার একর। মিনারটি ৭০ হাজার বর্গফুট বা ১ দশমিক ৫ একরের চেয়ে কিছু বেশি। ফুল দেওয়ার বেদিটির আয়তন ২ হাজার বর্গফুট। টকটকে লাল পাথরের অভাবে আপাতত ‘রেড অক্সাইড’ দিয়ে লাল করা হয়েছে।

লেখক : সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ১০ বছর আজ

‘ভয়াল ২৯ এপ্রিল, ১৯৯১ স্মরণ ও প্যারাবন নিধন প্রতিবাদ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

শাহ আমানতে ৯০ হাজার দিরহামসহ যাত্রী আটক

আবুধাবিতে চালু হচ্ছে উড়ন্ত ট্যাক্সি, ৩০ মিনিটেই দুবাই

গরু চোরাচালানে জড়িত ছাত্রলীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধি

ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ চায় খেলাফত মজলিস

বাংলাদেশ এসএসসি ৯৮ ফ্রেন্ডস ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু

চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় গেলেন আমির খসরু 

উত্তর কোরিয়া থেকে অস্ত্র নিয়ে চীনা বন্দরে রুশ জাহাজ

বর্জ্যবাহী গাড়ির ধাক্কায় নিহতের ঘটনায় ব্যবস্থা : তাপস

১০

বর্ণিল আয়োজনে রূপায়ণ সিটি উত্তরায় সামার ফেস্ট-২০২৪ অনুষ্ঠিত

১১

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা 

১২

বিসিএস পরীক্ষার্থীর আঁকুতি / ‘পরীক্ষা দিতে না পারলে আমি মরে যাব স্যার’

১৩

শনিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

১৪

ইউরোপজুড়ে চীন-রাশিয়া ও আরব রাষ্ট্রের ফাঁদ

১৫

বাংলাদেশের ধুলায় মাইক্রোপ্লাস্টিক, বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা

১৬

এবার মিল্টন সমাদ্দারের আরেক প্রতারণা ফাঁস!

১৭

বগুড়া জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি তুহিন, সাধারণ সম্পাদক হাবিব

১৮

গাজার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে ১৪ বছর লাগতে পারে : জাতিসংঘ

১৯

নিয়োগ পরীক্ষার আগেই প্রার্থী চূড়ান্তের অভিযোগ

২০
*/ ?>
X