আর কে চৌধুরী
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৩, ০৮:৪৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ

দেশের মানুষের আমিষ চাহিদা মেটাতে পোলট্রি খাতের অবদান তুলনাহীন। তবে রোজার মাসকে সামনে রেখে পোলট্রি খামারের মালিকদের মুনাফাখোরী মনোভাব ভোক্তাদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এ নাজুক অবস্থায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন সভাপতির কণ্ঠেও উচ্চারিত হয়েছে ক্ষোভের কথা। তিনি বলেছেন, এমন মূল্যবৃদ্ধি চলতে থাকলে সরকারকে বিদেশ থেকে গরু ও মুরগির মাংস আমদানির কথা বলতে হবে। মুরগির দাম বৃদ্ধির বিষয়ে গুরুতর অভিযোগ তুলেছে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির দাবি, এ খাতের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো গত ৫২ দিনে মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

তাদের ভাষ্য, দেশে প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ টন। এর মধ্যে প্রান্তিক খামারিদের ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ এখন কেজিপ্রতি ১৬০-১৬৫ টাকা। আর করপোরেট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যয় ১৩০-১৪০ টাকা। তবে পাইকারি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত এসব মুরগি বিক্রি হয়েছে। তাতে কেজিপ্রতি অন্তত ৬০ টাকা বেশি মুনাফা করেছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন অতিরিক্ত মুনাফা করছে ১২ কোটি টাকা। প্রান্তিক খামারিদের অভিযোগ, এভাবে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ৫২ দিনে মুরগি বিক্রি করে করপোরেট কোম্পানিগুলো লাভ করেছে ৬২৪ কোটি টাকা। আর এক দিনের মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে তাদের ৩১২ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ব্রয়লার মুরগির দাম বৃদ্ধির পেছনে প্রান্তিক খামারিদের দায় আছে কি না সে বিষয়ে তারা কোনো কথা বলেননি। তবে এটি মহা সত্যি যে, ব্রয়লার মুরগির দাম সীমা ছাড়িয়ে এখন প্রতি কেজি ২৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ মানুষের আমিষ চাহিদা পূরণে অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে। বিদেশ থেকে গরু ও মুরগি আমদানি বন্ধের ফলে মূল্যবৃদ্ধি জুলুমের শিকার হচ্ছে ভোক্তারা।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি এখন বলা যায় টক অব দ্য কান্ট্রি। দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজন—এমন সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ভোজ্যতেল, ডাল, আটা-ময়দা, মাছ-মাংস, পেঁয়াজ, শাকসবজিসহ এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। এ ছাড়াও বেড়েছে বাড়িভাড়া, পরিবহন ব্যয়, চিকিৎসা ও শিক্ষা উপকরণের দাম।

নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে জীবনযাত্রায় বাড়তি ব্যয়ের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে মানুষের জীবন। সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে মধ্যবিত্ত। নিম্নবিত্তরা সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বিভিন্ন ধরনের সরকারি সুবিধা ভোগ করতে পারছে বলে তাদের জীবন একরকম চলে যাচ্ছে। কিন্তু মধ্যবিত্তরা দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে গিয়ে পড়ছে বিপাকে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে চাহিদা মেটাচ্ছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, মধ্যবিত্ত সব পরিবারের তো আর সঞ্চয় নেই। তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে।

এটা ঠিক, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্বেই পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি এবং পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় উন্নত দেশ থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল সব দেশেই ঘটছে মূল্যস্ফীতি। যুদ্ধ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী দিনে দেশে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলেও আগাম সতর্কতা দিয়েছে জাতিসংঘ। কিন্তু আমাদের কথা হচ্ছে, করোনা ও যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে মূল্যবৃদ্ধি মেনে নেওয়া গেলেও সিন্ডিকেটের কারণে মূল্যবৃদ্ধি তো মেনে নেওয়া যায় না। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটতেই পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এ নিয়ম খাটছে না। পণ্যের পর্যাপ্ত আমদানি ও সরবরাহ থাকলেও তা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের এ অযৌক্তিক বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে বাজার সিন্ডিকেট। তারা যোগসাজশের মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। কখনো কখনো তারা তৈরি করছে পণ্যের কৃত্রিম সংকট। এ সিন্ডিকেট ভাঙা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। সিন্ডিকেটের কারসাজি বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারের। অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের কায়েমি স্বার্থে ইচ্ছামতো পণ্যের দাম বাড়াবে আর সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, তা হতে পারে না। আমরা বাজার তদারকির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের জোরালো ভূমিকা দেখতে চাই। সবকিছুর দাম বাড়ায় সংসার খরচ বেড়ে গেছে। যে কারণে আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের পেছনে। চাহিদার সঙ্গে দাম যাতে না বাড়ে, সেজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো দৃশ্যত কিছু বিশেষ ব্যবস্থাও নিয়ে থাকে। তবে আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, এসব ব্যবস্থা বাজার নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। এটা স্পষ্ট যে, করোনা-দুর্যোগে অনেকের আয়-রোজগার কমে গেছে, অনেকেই হয়েছেন কর্মহীন। এখনো বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যাতে বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখার কথা জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন কর্মকর্তারা। অবশ্য এসব তৎপরতায় তেমন কোনো সাফল্য আমরা দেখি না। বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে খোলা বাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, এগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য পরিবহন নির্বিঘ্ন রাখতে বিশেষ করে কৃষিপণ্যের সরবরাহে যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এর বাইরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে।

পরিশেষে বলছি, কেন্দ্র থেকে স্থানীয় উৎপাদন ক্ষেত্র পর্যন্ত ব্যবস্থাপনাও নজরদারির আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে আমদানিকৃত ও দেশজ উৎপাদিত—এ দুই ধরনের নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও নির্বিঘ্ন রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।

করোনায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের জন্য আরেকটি সমস্যা। দেশে এত বড় বাজার, যা শুধু আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ‘ন্যায্যতার’ মূল্যবোধ দিয়ে গড়ে তুলতে না পারলে দ্রব্যমূল্য কেন, কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

লেখক : সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের উপদেষ্টা ও সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শিল্পী-সাংবাদিক দ্বন্দ্ব, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত

বিয়ে না দেওয়ায় মাকে জবাই করে হত্যা

এখনো উত্তাল যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, গণগ্রেপ্তারেও অটল শিক্ষার্থীরা

বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন ঠাকুরগাঁওয়ের মুসল্লিরা

আ.লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রেখে সমস্যার সমাধান হবে না: আব্দুস সালাম 

দিলারার নতুন মিশন

ইউরোর আগে নিষিদ্ধ হওয়ার পথে স্পেন!

পঞ্চগড়ে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন হাজারো মুসল্লি

আ.লীগ সম্পাদককে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত ভিপি মনির 

‘জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মানবিক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে’

১০

+৯২ বা +৯৯ নম্বরের কল রিসিভ করলে কি ফোন হ্যাক হয়?

১১

ব্যাংক একীভূতকরণ ও ব্যাংকিং শিল্পের পুনর্গঠন

১২

বিআরটিএর অভিযানে ৪০৬ মামলায় ৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকা জরিমানা 

১৩

জাপার দু’পক্ষের কর্মসূচি নিয়ে উত্তেজনা

১৪

গাজায় এবার মার্কিন সেনা, তৈরি হচ্ছে অস্থায়ী সমুদ্রবন্দর

১৫

হিটস্ট্রোকে পেপার বিক্রেতার মৃত্যু

১৬

শ্রমিকদের ভিসা সহজ করতে যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি প্রবাসী প্রতিমন্ত্রী আহ্বান

১৭

মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারবিষয়ক সম্মেলনে যোগ দিলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী 

১৮

বিএনপির ৭৫ নেতা বহিষ্কার

১৯

খেলা দেখা নিয়ে অবাক তথ্য মোস্তাফিজের

২০
*/ ?>
X