বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
মোনায়েম সরকার
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:১৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তিযুদ্ধের শক্তি ক্ষমতায় থাকা জরুরি

মুক্তিযুদ্ধের শক্তি ক্ষমতায় থাকা জরুরি

ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। একটি রক্তাক্ত মহাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। পূর্বসূরি বরেণ্য রাজনৈতিক নেতা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজ অভিজ্ঞতার মিশ্রণ ঘটিয়ে বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামকে স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত করেন শেখ মুজিব। ২৫ মার্চ কালরাতে গণহত্যা শুরু করে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হন। মুক্তিকামী, দিশেহারা জনতাকে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা দেন। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিজয় সূচিত হয় রক্তস্নাত বাংলাদেশের।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ এক অলৌকিক কল্পনামাত্র। জীবনের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির অধিকার আদায়ে আপসহীন ছিলেন। জুলুম-নিপীড়ন-অত্যাচার সহ্য করেও তিনি আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। পাকিস্তানি সামরিক সরকার বারবার তাকে জেলবন্দি করেছে, ফাঁসিতে ঝুলাতে চেয়েছে, তবু মাথানত করেননি। বঙ্গবন্ধু এক দুঃসাহসী অভিযাত্রিক। নিষ্পেষিত পূর্ববঙ্গের মানুষের বেদনা তার কণ্ঠে বজ্রধ্বনি হয়ে উচ্চারিত হয়েছিল। লাখ লাখ শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির সমাবেশে দাঁড়িয়ে তিনিই প্রথম ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ (৭ মার্চ, ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ভাষণ)।

বঙ্গবন্ধুই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখান বাঙালি জাতিকে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংগ্রাম করে কীভাবে একটি উপনিবেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের রূপ দেওয়া যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন করে বঙ্গবন্ধু তা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে গেছেন। বিশ্বের শোষিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ একটি আধুনিক ধারার রাজনৈতিক মতবাদ। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে তিনি সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। শ্মশান বাংলাকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, সেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে সত্যিকার অর্থেই বাংলা ‘সোনার বাংলা’ হয়ে উঠত। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে ঘাতকের গুলিতে সপরিবারে নিহত হন বাংলার জননায়ক বঙ্গবন্ধু। তার আকস্মিক মৃত্যুতে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশকে সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে দিতে থাকে। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, হত্যা ও দুর্নীতির কবলে পড়ে দিকভ্রষ্ট হয় বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা বিকৃত হতে থাকে ক্ষমতাসীনদের ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবীদের হাতে। একটি প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় বেড়ে ওঠে। দুর্ভাগ্যজনক যে, তাদের মনোজগৎ এখনো পাকিস্তানি মৌলবাদী ভাবাদর্শ দ্বারা আচ্ছন্ন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে তিনজন দুঃশাসক বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর, ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তারা হলেন জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ ও জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া। এ তিনজনই বাংলাদেশবিরোধী চক্রকে নানান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে উসকে দিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন। এরাই প্রথম অস্ত্র ও হত্যার রাজনীতি শুরু করেন ত্রিশ লাখ বীরের রক্তধোয়া বাংলাদেশে। নির্বাচন প্রক্রিয়া কলুষিত করে, গণতন্ত্র হত্যা করে, একনায়কতন্ত্রের বৈধতা দান করে এরাই বাংলাদেশকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করেন। দীর্ঘ একুশ বছর লড়াই সংগ্রাম করে, বিকৃত ইতিহাসের পাহাড় ঠেলে জয়ী হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। পিতার মতোই মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার দৃঢ় ও সৃজনশীল নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে এরই মধ্যে তিনি যেসব মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে নিঃসন্দেহে আরও ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। দেশবিরোধী শত্রুদের সব ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে, বিদেশি এজেন্টদের দুরভিসন্ধি ধ্বংস করে সত্যিই যদি বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা মোটেই অসম্ভব নয়।

মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি প্রধানত তিনটি ধারায় বিভক্ত ছিল। এগুলো হলো গণতান্ত্রিক ধারা, বাম-প্রগতিশীল ধারা ও ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদী ধারা। গণতান্ত্রিক ও বাম-প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারা একসময় বেশ সক্রিয় হলেও এখন বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে। বাম-প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দের ক্ষমতার লোভ ও জনবিচ্ছিন্নতা তাদের ছিন্নভিন্ন করে শক্তিহীন করে ফেলেছে। এদের ব্যর্থতার সুযোগ পুরোটাই কাজে লাগিয়েছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। দেশি-বিদেশি এজেন্টদের আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতায় এরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। দুঃখজনক যে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকটাই ডান দিকে হেলে পড়েছে। এটা অশনিসংকেত বলেই মনে হয়। অবক্ষয়ের পথ ধরেছে রাজনীতি। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ধর্মনিরপেক্ষ দল, অন্যদিকে ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠী। এ দুই ধারা আজ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। বাম-প্রগতিশীল ধারা নিস্তেজ হয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। ডানপন্থি দলগুলো এক হয়ে গণতান্ত্রিক আওয়ামী ধারার রাজনীতিকে পরাজিত করতে সক্ষম হলে বাংলাদেশ হবে মৌলবাদীদের অভয়ারণ্য।

আজ অনেকেই অন্ধের মতো মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের বিরূপ সমালোচনা করেন নানা ইস্যু সামনে এনে। যারা আওয়ামী লীগের সমালোচক, তারা কি অস্বীকার করতে পারবেন আওয়ামী লীগের আশ্রয়টুকুই আজ বাঙালির শেষ ঠিকানা? সুবিধাবাদী, ভীরু, দুর্বল আদর্শের রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতার কারণে বাম-প্রগতিশীল ধারার শক্তি সঞ্চয় তো দূরের কথা, আওয়ামী লীগের সমান্তরাল কোনো গণতান্ত্রিক দলও গঠন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখে লজ্জা পাই, জনপ্রতিনিধিরাও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে নানান বক্তব্য দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন। স্বাধীনতার এত বছর পরও এমন দুঃসাহস অনাকাঙ্ক্ষিত। এ কথা অনস্বীকার্য, অসংখ্য ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকেই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে হবে।

দীর্ঘদিন একটি দল ক্ষমতায় থাকলে সে দলে কিছু দুর্বৃত্ত এসে যোগ দেয়, এটা সত্য। এসব দুর্বৃত্ত দুর্নীতি করে দলকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শ শোষণ নয়, দুর্নীতি নয়—জনগণের সেবা। সেবার আদর্শ নিয়ে যারা আওয়ামী লীগের পতাকাতলে আসবে, তারাই সত্যিকারের মুজিব সেনা। দুর্বৃত্তদের কর্মকাণ্ডের কারণে ব্যাপক উন্নয়ন করেও আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, এটাও স্বীকার্য। এখনই যদি এ দুর্বৃত্তদের শাস্তি দিয়ে দমন করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে দল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।

লেখক : রাজনীতিক ও প্রাবন্ধিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হার দিয়ে আইপিএল শেষ মোস্তাফিজের

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার : আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করল মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ

ছাত্রীনিবাসের সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও ধারণ, অতঃপর...

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার, বরিশালে মিষ্টি বিতরণ

বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলার চেয়ারম্যান হলেন অ্যাড. আব্দুস সালাম

এবার চাঁদের বুকে পা রাখবে পাকিস্তান

মিল্টনের বিরুদ্ধে কালবেলায় উঠে আসা সব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে ডিবি

ডিবির ব্রিফিংয়ে উঠে এলো মিল্টনের কিডনি বিক্রির ইস্যু

দেশের মানুষ ন্যূনতম অধিকার থেকেও বঞ্চিত : মির্জা ফখরুল 

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঠেকাতে বাইডেনের দ্বারস্থ নেতানিয়াহু

১০

সারা দেশের স্কুল-কলেজ বন্ধ বৃহস্পতিবার

১১

নওগাঁয় ধান কাটতে গিয়ে কৃষকের মৃত্যু

১২

সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে

১৩

মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবে ডিবি

১৪

ভয়াবহ প্রতারণার জাল বিস্তার করেছেন মিল্টন : ডিবিপ্রধান

১৫

মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রমে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ

১৬

পরিসংখ্যানে বেড়েছে ইলিশ, বাস্তবে তেলের টাকাও উঠছে না জেলেদের

১৭

মিল্টন সমাদ্দারকে রিমান্ডে নেবে ডিবি

১৮

চিকিৎসাসেবাকে মানুষের আস্থার জায়গায় পরিণত করার আহবান প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর

১৯

মানবপাচার ও টর্চার সেল ইস্যু উঠে এলো ডিবির ব্রিফিংয়ে

২০
*/ ?>
X