চিররঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:২৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের নির্বাচন বিদেশিদের নাচন

দেশের নির্বাচন বিদেশিদের নাচন

সংবিধানের বিধান অনুযায়ী ২০২৩ সালের ডিসেম্বর অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু দেশে এখনোই নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিশেষ করে কূটনৈতিকপাড়ায় তৎপরতা বেশি। এবার রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়েও ঢাকায় কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। এর আগে তারা মন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, নির্বাচন কমিশনের কর্তাসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ এবং নির্বাচন ইস্যুতে ধারাবাহিক সংলাপ করছেন। এখন তারা গোপন তৎপরতা চালাচ্ছেন। বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ।

আমাদের দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ না করায় নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিদেশিদের সহায়তা চাওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা বিদেশিদের তৎপরতার বিরোধিতা করেন; আর যারা ক্ষমতার বাইরে থাকেন তারা বিদেশিদের সহায়তায় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা চান। এটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

আমাদের নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপ মোটেও স্বস্তির কোনো ব্যাপার নয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, আমাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কতটা নাজুক ও আস্থাহীন। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল। তখন আওয়ামী লীগ বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়েছে এবং চিঠি দিয়ে নির্বাচনে বিদেশিদের প্রভাব কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। এটা এখন অনেকটাই ক্রনিক ব্যাধি হয়ে গেছে। এখন বিএনপি বিদেশিদের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিচ্ছে।

বাংলাদেশের নিরপেক্ষ নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসার জন্য প্রথম বিদেশিদের তৎপরতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক রাজনৈতিক সংকট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে ছুটে যান। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক বিরোধ মেটাতে ঢাকায় আসেন কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টিফেন। তিনি ৩০ দিন বিবদমান দুপক্ষের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে মধ্যস্থতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান।

২০০৫ সালে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে রাজনৈতিক বিরোধ ভয়াবহ রূপ নেয়। বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বিদেশি দূতাবাসগুলোতে সিরিজ বৈঠক করেন। জনমত উপেক্ষা করে বিএনপি এককভাবে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের চেষ্টা করে। সে সময় রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ঢাকায় কর্মরত ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, ভারতের হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন, আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস, পরবর্তী সময়ে প্যাট্রিসিয়া এ বিউটিনিসসহ অসংখ্য বিদেশি কূটনীতিককে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়। সে সময় ঢাকায় কূটনৈতিক কোরের ডিন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত শাহতা জারাব তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ মেটানোর অন্যতম ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন। যে কোনো রাজনৈতিক বিরোধ হলেই সবাই ছুটে যেতেন শাহতা জারাবের কাছে।

২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বিরোধ মেটাতে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তিনি ‘অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত’ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে তার আলোচনায় ব্যর্থ হলে তিনি ফিরে যান।

আসলে নির্বাচনকে সামনে রেখে কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ কোনো ফল বয়ে আনে না। তারপরও আমাদের দেশে বিরোধী অবস্থানে থাকা রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের ‘পীর’ মানেন। দেশের রাজনীতিতে নাক গলানোর সুযোগ করে দেন। এটা আমাদের জন্য যেমন লজ্জার, কূটনীতিকদের জন্যও অগৌরবের। মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় বিখ্যাত চিন্তাবিদ কৌটিল্য কূটনৈতিক আচার-আচরণ নিয়ে যা লিখেছিলেন, আজও তা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। কৌটিল্যের বিধানমতে, কোনো দেশের রাজপ্রতিনিধি অন্য দেশের খবরাখবর নিজের দেশে পাঠাতে পারেন। প্রয়োজনে গোয়েন্দাগিরিও চালাতে পারেন। কিন্তু সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারেন না। অন্য দেশের সঙ্গে নিজের দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট থাকাই রাষ্ট্রদূতের বড় দায়িত্ব। কৌটিল্যের সেই বাণীর প্রতিফলন ছিল ১৬৪৮ সালের ‘ওয়েস্ট ফেলিয়া’ সন্ধিতেও। যার কথা সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তার একাধিক বইয়ে প্রশংসাসূচকভাবে উল্লেখ করেছেন। সেই চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল, কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের হস্তক্ষেপের ওপর নিষেধাজ্ঞা। সেই পথেই ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, কূটনীতিকরা অন্য দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন এবং সে দেশের ঘরোয়া ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না। কনভেনশনের ৯ অনুচ্ছেদে চুক্তিভুক্ত দেশগুলোকে যে কোনো বিদেশি কূটনীতিককে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণার অধিকার দিয়েছে।

আমেরিকা নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নাক গলানো কখনো সহ্য করেনি। আর তাই ভিয়েনা কনভেনশনের বহু যুগ আগে, ১৮৮৮ সালে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড সেকভিলকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছিল আমেরিকা। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার লর্ড সেকভিলকে রাষ্ট্রদূতের পদ থেকেই অপসারিত করতে বাধ্য হয়েছিল। পরবর্তী সময়েও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের দায়ে আমেরিকা বহু বিদেশি কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। ২০২১ সালে নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগে ১০ জন রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছিল মার্কিন প্রশাসন।

এ বহিষ্কারের তালিকা বেশ লম্বা। গোটা দুনিয়াকেই এ শক্তি দিয়েছে ভিয়েনা কনভেনশন। অথচ, বাংলাদেশে নির্বাচনের মেঘ ঘনালেই আমেরিকা, জাপান, পশ্চিমের দেশগুলো সক্রিয়তা বাড়াতে থাকে! নড়ে বসে চীন, রাশিয়াও। শুধু নির্বাচন তো নয়, বাংলাদেশে যে কোনো রাজনৈতিক সংকট এলেই তৎপর হতে দেখা যায় এখানকার বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের। মুক্তিযুদ্ধ থেকে যার শুরু। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে একাধিক সামরিক শাসন, ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতন, এমনকি ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর প্রতিটি রাজনৈতিক উত্থান-পতনে, কমবেশি সব নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি শক্তির সক্রিয়তা প্রকাশ্যে এসেছে। আবার কোনো ক্ষেত্রে তা থেকে গেছে গোপনে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন প্রভাব কিছুটা হলেও কমে গেছে। আমেরিকা তাদের সেই প্রভাব বাড়াতে চায়। কিন্তু এখানে শক্তিশালী অবস্থানে আছে আমেরিকার স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। রয়েছে ভারতও। সবার স্বার্থ একরকম নয়।

বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এখন বহুমাত্রিক এবং অনেক গভীর। চীনের শত শত কোম্পানি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। শুধু পদ্মা সেতু নয়, বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে অবকাঠামোগত যে অগ্রগতি হয়েছে, তাতে চীনের বিপুল সাহায্য রয়েছে। সামরিক ক্ষেত্রেও তাই। তবে বাংলাদেশে চীনের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবেদন দুর্বল। ভারত বা আমেরিকা সেই জায়গায় অনেক এগিয়ে। তাই বাংলাদেশকে শুধু চীনের সঙ্গে নয়, তিন সীমান্তের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। তাহলে বাংলাদেশ কোন দিকে হাত বাড়াবে? এখানেই নেতৃত্ব নিতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তার হাতে রয়েছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাতিসংঘ এবং নানা মিশনের প্রভাব-প্রতিপত্তি। আমেরিকা ও ইইউ দেশগুলো এখন বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজার। বিশাল সংখ্যার প্রবাসী রয়েছেন এসব দেশে। যাদের আয়ে চলছে দেশে লাখ লাখ পরিবার।

সবসময়ই ছোট ইঁদুর শিকার করা বিড়ালের পক্ষে সহজ। আর এ শিকার বিড়াল তার নিজের প্রয়োজনেই করে। ফলে আসন্ন নির্বাচন ঘিরে বিদেশি শক্তিগুলোর যে শিকার-ধরা অভিযান শুরু হয়েছে, বাংলাদেশের মতো খুদে ইঁদুর সেখানে কী করে সেটাই দেখার ব্যাপার।

লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

সকাল ৯টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

২৭ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে আজ

নাটোরে অপহরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৭

ছাত্র ইউনিয়নের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত 

ভোট দেওয়ার শর্তে কোরআন ছুয়ে নিতে হবে টাকা, কল রেকর্ড ভাইরাল

‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম ভয়াবহ সঙ্কটকাল পার করছে’

 ছেলের কিল-ঘুষিতে শিক্ষক পিতার মৃত্যু

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ১০ বছর আজ

১০

‘ভয়াল ২৯ এপ্রিল, ১৯৯১ স্মরণ ও প্যারাবন নিধন প্রতিবাদ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

১১

শাহ আমানতে ৯০ হাজার দিরহামসহ যাত্রী আটক

১২

আবুধাবিতে চালু হচ্ছে উড়ন্ত ট্যাক্সি, ৩০ মিনিটেই দুবাই

১৩

গরু চোরাচালানে জড়িত ছাত্রলীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধি

১৪

ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ চায় খেলাফত মজলিস

১৫

বাংলাদেশ এসএসসি ৯৮ ফ্রেন্ডস ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু

১৬

চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় গেলেন আমির খসরু 

১৭

উত্তর কোরিয়া থেকে অস্ত্র নিয়ে চীনা বন্দরে রুশ জাহাজ

১৮

বর্জ্যবাহী গাড়ির ধাক্কায় নিহতের ঘটনায় ব্যবস্থা : তাপস

১৯

বর্ণিল আয়োজনে রূপায়ণ সিটি উত্তরায় সামার ফেস্ট-২০২৪ অনুষ্ঠিত

২০
*/ ?>
X