শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
ডালিয়া মোজাহেদ
প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০১:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলামের অপব্যাখ্যায় হুমকির মুখে গণতন্ত্র

ইসলামের অপব্যাখ্যায় হুমকির মুখে গণতন্ত্র

গত সপ্তাহের শুরুতে নেদারল্যান্ডসের প্রশাসনিক শহর দ্য হেগে আল কোরআনের একটি অনুলিপিকে প্রকাশ্যে অবমাননা করা হয়েছে। এ নিন্দনীয় কাজটি শুধু বিশ্বের মুসলিমদের ওপরই নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীতেই একটি নেতিবাচক প্রভাব রেখে গেছে।

এডউইন ওয়াগেনসভেইড, ইউরোপিয়ানস অ্যাগেইনস্ট দ্য ইসলামাইজেশন অব দ্য ওয়েস্ট গ্রুপের একজন ডাচ নেতা, প্রকাশ্যে এ নিন্দনীয় কাজটি করেন। একই সঙ্গে এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেন তিনি।

অনেকের মতে, এ ঘটনাটি অনেকটা আমেরিকার ডানপন্থি রাজনীতিবিদদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মডেলের মতো দেখাচ্ছে। কোরআন অবমাননার এ ঘটনার রেশ শেষ না হতেই সপ্তাহের শেষের দিকে রাসমুস পালুদান নামে স্ট্রাম কুর্সের আরেক নেতা স্টকহোমে তুর্কি এমবাসির কাছে কোরআনের অবমাননা করেন।

ওয়াগেনসভেইড কোরআনের একটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলেন। তার মতে, সুইডেন এবং নেদারল্যান্ডসের ঘটনাগুলো হেইট স্পিচের একটি সমন্বিত বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলেন, ‘খুব শিগগির বেশ কয়েকটি শহরে এরকম কাজ আরও ঘটবে। তাই এখন ইসলাম ধর্মের উচিত অসম্মানের জবাব অসম্মানের মাধ্যমে দেওয়া।’

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ ঘটনাগুলো মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বিক্ষোভের জানান দেয়। আর এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে পশ্চিমা নেতারা বাকস্বাধীনতা এবং ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণু হওয়ার আহ্বান জানান। কোরআন অবমাননা করে ইসলাম ধর্ম নিয়ে এ ধরনের উসকানি দেওয়া, মুসলিম বিশ্বে রোষানল তৈরি করা এবং পশ্চিমাদের ঔদ্ধত্য—এ পরিচিত ছাঁচের বাইরে কি এসব উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড সমাজের দুর্বল বা সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়? পশ্চিমা সমাজে বসবাসকারী অমুসলিমদের কি চিন্তা করা উচিত নয় যে তারা যে ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাস করে না, সেটা যদি তারা কোনো প্রচারণার কাজে ব্যবহার করে, তবে সেটা আদৌ কি কোনো কাজে আসবে?

অবশ্যই তাদের এ ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত। কারণ ইসলামফোবিয়ার বিস্তার শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সবার জন্যই গণতন্ত্রকে অনিরাপদ করে তোলে এবং স্বাধীনতা খর্ব করে।

ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল পলিসি অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং (আইএসপিইউ) একটি ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক নির্দলীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যেখানে আমি নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে কাজ করি। এ প্রতিষ্ঠানটি আমেরিকায় মুসলমানদের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করে। এ ছাড়া আমেরিকায় মুসলমানরা যেসব নীতিমালা দ্বারা প্রভাবিত, সেসব বিষয়ে গবেষণা করাও এ প্রতিষ্ঠানের কাজ। আমাদের গবেষকরা, একাডেমিক প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন উপদেষ্টাদের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে আইএসপিইউ ইসলামফোবিয়া সূচক তৈরি করেছেন। এ সূচক মূলত আমেরিকার বিভিন্ন গোষ্ঠী কী পরিমাণ মুসলিমবিরোধী তা নির্ণয় করে।

গত পাঁচ বছরে আমরা বিভিন্ন জাতি, বয়স, ধর্মে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী প্রভৃতি মানদণ্ডের ভিত্তিতে আমেরিকানদের মধ্যে ইসলামফোবিয়া সূচক পরিমাপ করেছি। আমরা আরও গবেষণা করেছি, কীসের ভিত্তিতে ইসলামফোবিয়ার প্রতি মানুষ পক্ষপাতদুষ্ট হয় এবং আমরা আরও পরিমাপ করেছি যে, কীসের ভিত্তিতে মুসলিমবিরোধী ধর্মান্ধতা জনসাধারণের সম্মতি পেয়ে থেকে। আমাদের এ পরিমাপের ফলগুলো বেশ জটিল। কিন্তু এ জটিলতার মধ্য থেকেও একটি সহজ সত্য বের হয়ে আসে—ইসলামফোবিয়া গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়।

আমরা দেখেছি, মুসলিমবিরোধী ঘটনাগুলো গতানুগতিকভাবেই মুসলমানদের তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানায় এবং সেসব আক্রমণ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন নীতির সঙ্গেও সম্পর্কিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মসজিদে নজরদারির ব্যবস্থা এবং তথাকথিত ‘মুসলিম নিষেধাজ্ঞা’। এ তথাকথিত ‘মুসলিম নিষেধাজ্ঞা’ হচ্ছে ট্রাম্প যুগের একটি মার্কিননীতি। এ নীতি অনুসারে অনেক মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু ইসলামফোবিয়ায় বিশ্বাসীরা শুধু মুসলমানদের কাছ থেকে অধিকার কেড়ে নিতে প্রস্তুত নয়। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে, তারা তাদের নিজেদের সবকিছু ত্যাগ করতেও ইচ্ছুক।

মুসলমানদের বিরুদ্ধে কিছু অপপ্রচারণা, যেমন একজন মুসলমান অন্য একজন মুসলমানের কৃতকর্মের জন্য আংশিকভাবে দায়ী বা মুসলিমরা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর চেয়ে সভ্যতার মানদণ্ডে পিছিয়ে আছে—এসবের মাধ্যমে মুসলিমবিরোধী মতবাদকে সমর্থন করা হয়। আবার অন্যদিকে, এসব প্রচারণার মাধ্যম সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে যেতে পারে বা কোনো সন্ত্রাসী হামলার আগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা বা ভারসাম্য আনয়নের ব্যবস্থা স্থগিত হয়ে যেতে পারে। এক কথায় বলতে গেলে, ইসলামফোবিয়ার প্রচার স্বাধীন সমাজের ভিত্তিকেই ক্ষুণ্ন করে।

তা ছাড়া ইসলামফোবিয়া অন্যান্য ধর্মান্ধতারও জন্ম দেয়। আমরা আরও দেখেছি ইসলামফোবিয়ার মূল ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা এবং কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী বর্ণবাদ।

আমাদের গবেষণা এটাও প্রমাণ করেছে যে, ইসলামফোবিয়া শুধু গণতন্ত্রের স্বাধীনতাকেই হ্রাস বা রক্ষণশীল করে তোলে না, এর ফলে একটি দেশ ও সমাজ আরও অনিরাপদ হয়ে ওঠে। আর আশঙ্কাজনক হলে সত্য যে, এসব ঘটনার ব্যাপ্তি আমাদের স্বাভাবিক চিন্তারও বাইরে।

তবে এটা সত্য যে, ইসলামের নামে কাজ করার নামে কিছু বিপথগামী আছে। তারা ইসলাম প্রচারের দাবি করে। কিন্তু এ বিপথগামীরা নিজেদের প্রভাববলয় বাড়ানো এবং সহিংসতা সৃষ্টি করার জন্য জনবল নিয়োগ করার সময় পশ্চিমা-মুসলিমবিরোধী রাজনৈতিক বক্তব্য ব্যবহার করে।

কিন্তু সব থেকে বড় ঝুঁকিটি আরও বড় এবং দূরে অবস্থিত। কিছু প্রচলিত ধারণা আছে যেখানে বলা হয়—‘মুসলিমরা অন্যান্য মানুষের তুলনায় সহিংসতার প্রবণ’ বা ‘অধিকাংশ মুসলমানরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিদ্বেষী’। আবার যারা সত্যিকার অর্থেই এসব ধারণা বিশ্বাস করেন বা এসব কথা বলে মুসলমানদের বিদ্রুপ করেন, তাদের নিজেদের কার্যকলাপই এসব ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। মূলত মুসলমানদের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করার জন্যই তারা এসব বলে থাকেন। তারা আরও বলেন যে, সামরিক বাহিনী যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে আক্রমণ করে বা মেরে ফেলে, সেটা যুদ্ধাপরাধ। আর কোনো ছোট দল বা ব্যক্তি যদি একই কাজ করে, সেটা সন্ত্রাসবাদ।

এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী সহিংসতার বিকাশ মূলত ট্রাম্পের শাসনামল থেকেই শুরু এবং এ কারণেই সন্ত্রাসীরা আমেরিকান নাগরিকদের জীবনের জন্য একটি হুমকিস্বরূপ। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, গত সপ্তাহব্যাপী ইউরোপজুড়ে কোরআন অবমাননার মতো ব্যাপারগুলো বৈধ ঘোষণা করতে হবে। এদিকে অনেকেই চাইছেন এসব ব্যাপারকে বৈধতা দিতে।

একজন বিশ্বাসী মুসলমান হিসেবে, আল কোরআনের একজন পাঠক হিসেবে এবং ইতিহাসের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি জানি আল্লাহর বার্তাবাহক রাসুল (সা.) এর থেকে অনেক বেশি দুর্দশায় পড়েছিলেন। আর আল্লাহর প্রেরিত এই গ্রন্থকে আমাদের ক্ষীণ সামর্থ্যের নিরাপত্তা না দিলেও চলবে। বস্তুত এ গ্রন্থকে অবতীর্ণ করা হয়েছে মানুষের সুরক্ষার জন্য। আবার আমাদের উচিত নয় যে, যারা এসব কর্মকাণ্ড করছেন, তাদের নায়কোচিত সংবর্ধনা দেওয়া বরং আমাদের উচিত তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া। তারা এসব উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়। কিন্তু আমাদের উচিত হবে সেদিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ না করা। এটাই হবে তাদের জন্য উপযুক্ত শাস্তি।

ইসলামফোবিয়াকে বিস্তৃত করার জন্য রাজনৈতিক বক্তব্যের প্রতিও আমাদের নজর দিতে হবে। এসব বক্তব্য মূলত গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয় না, বরং আরও দুর্বল করে তোলে।

লেখক : ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল পলিসি অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের গবেষণা পরিচালক। আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর করেছেন রতন খান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

 ছেলের কিল-ঘুষিতে শিক্ষক পিতার মৃত্যু

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ১০ বছর আজ

‘ভয়াল ২৯ এপ্রিল, ১৯৯১ স্মরণ ও প্যারাবন নিধন প্রতিবাদ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

শাহ আমানতে ৯০ হাজার দিরহামসহ যাত্রী আটক

আবুধাবিতে চালু হচ্ছে উড়ন্ত ট্যাক্সি, ৩০ মিনিটেই দুবাই

গরু চোরাচালানে জড়িত ছাত্রলীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধি

ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ চায় খেলাফত মজলিস

বাংলাদেশ এসএসসি ৯৮ ফ্রেন্ডস ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু

চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় গেলেন আমির খসরু 

উত্তর কোরিয়া থেকে অস্ত্র নিয়ে চীনা বন্দরে রুশ জাহাজ

১০

বর্জ্যবাহী গাড়ির ধাক্কায় নিহতের ঘটনায় ব্যবস্থা : তাপস

১১

বর্ণিল আয়োজনে রূপায়ণ সিটি উত্তরায় সামার ফেস্ট-২০২৪ অনুষ্ঠিত

১২

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা 

১৩

বিসিএস পরীক্ষার্থীর আঁকুতি / ‘পরীক্ষা দিতে না পারলে আমি মরে যাব স্যার’

১৪

শনিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

১৫

ইউরোপজুড়ে চীন-রাশিয়া ও আরব রাষ্ট্রের ফাঁদ

১৬

বাংলাদেশের ধুলায় মাইক্রোপ্লাস্টিক, বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা

১৭

এবার মিল্টন সমাদ্দারের আরেক প্রতারণা ফাঁস!

১৮

বগুড়া জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি তুহিন, সাধারণ সম্পাদক হাবিব

১৯

গাজার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে ১৪ বছর লাগতে পারে : জাতিসংঘ

২০
*/ ?>
X