আল্লাহ দিনকে বানিয়েছেন কাজের জন্য এবং রাতকে বানিয়েছেন বিশ্রামের জন্য। একই সঙ্গে আল্লাহ হালাল উপার্জনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং নামাজের পর জীবিকা অন্বেষণে বের হতে বলেছেন। মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য নানাবিধ কাজকর্ম করে। হালাল উপায়ে সব কর্মই করার সুযোগ রয়েছে। তবে যে কোনো দায়িত্ব বা কাজই আসুক, উপযুক্ত শ্রম ও কর্ম না করে ফাঁকিবাজির কোনো সুযোগ নেই ইসলামে। মূলত ‘দায়িত্ব’ মুসলমানের ওপর আমানত হিসেবে অর্পিত হয়। এ আমানতের হক যে পালন করতে পারবে সে পুরস্কৃত হবে আর যে ঠিকমতো পালন না করে ফাঁকিবাজি করবে, তার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। আমানত আল্লাহর হোক আর মানুষের হোক—সঠিকভাবে তা পালন করা মুমিনের অন্যতম কর্তব্য। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে আমানত রক্ষা করে না তার ইমানের দাবি যথাযথ নয় এবং যে অঙ্গীকার পূরণ করে না তার দ্বীন যথাযথ নয়।’ (মুসনাদে আহমদ: ১৩১৯৯)
সফল মুমিনদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।’ (সুরা মুমিনুন: ৮)। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির দায়িত্বের অনুভূতি যখন খতম হয়ে যায় তখন এর প্রতিক্রিয়া বহুদূর পর্যন্ত গড়ায়। সুতরাং দায়িত্ব পালনে ইসলামের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা রাখা সবারই জরুরি।
ইসলামে আমানতের পরিধি অনেক বিস্তৃত। চাকরিজীবীদের কাজের সময়টুকুও আমানত হিসেবে গণ্য। কাজ রেখে গল্প-গুজবে মেতে ওঠা বা কাজে ফাঁকি দেওয়া খেয়ানতের শামিল। অফিসের জিনিসপত্রও কর্মীর কাছে আমানত। ব্যক্তিগত কাজে তা ব্যবহার করা বা নষ্ট করা পুরোপুরি নিষেধ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘মুনাফিকের লক্ষণ তিনটি। তা হলো মিথ্যা কথা বলা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা এবং আমানতের খেয়ানত করা।’ (বোখারি: ৩৩)। যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন পবিত্র আমানত হিসেবে গণ্য। আমানত রক্ষায় ইসলাম জোর তাগিদ দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতগুলো প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও। আর যখন মানুষের বিচার-মীমাংসা করবে, তখন ন্যায়ভিত্তিক মীমাংসা করো। আল্লাহ তোমাদের সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী।’ (সুরা নিসা: ৫৮)
সৎ, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীলরা ঠিক সময়ে অফিসে আসেন। কর্তব্য পালনে ফাঁকি, অবহেলা বা অলসতার আশ্রয় নেন না। সুন্দরভাবে দায়িত্ব পালন প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য। নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রয়োগ করে কাজের মান নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম। দায়িত্বে অবহেলার সুযোগ নেই। প্রতিটি ব্যক্তিকে তার কর্ম, পেশা ও দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন মালিকের কাছে তার আমানত প্রত্যর্পণ করো।’ (সুরা নিসা: ৫৮)
সব ক্ষেত্রে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। নামাজ-রোজার মতোই সেগুলো মেনে চলা ফরজ। যেমন ব্যবসায়ী কখনো ধোঁকা প্রতারণার আশ্রয় নেবেন না, ভেজাল দেবেন না। চাকরিজীবী সময়মতো অফিসে আসবেন, পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন এবং কাজে অলসতা করবেন না। কাজে যদি নিয়মবহির্ভূত সময়ক্ষেপণ করা হয়, সেটা প্রতারণা হিসেবে গণ্য হবে। ইসলাম এসবে কখনোই সমর্থন করে না। বরং নিয়মভঙ্গের জন্য শাস্তির কথা বলে। আল্লাহ বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়, যারা লোকের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় নেয় আর যখন তাদের জন্য মেপে অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফিন: ১-৩)। ফিকাহ বিশারদদের মতে, এখানে মাপে কমবেশি করার অর্থ হলো পারিশ্রমিক পুরোপুরি আদায় করে নিয়ে কাজে গাফিলতি করা। কাজে ফাঁকি দিয়ে ওই সময় অন্য কাজ করা বা সময়টা অলস কাটিয়ে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমরা যখন কাউকে দায়িত্ব প্রদান করি, সে যদি এক টুকরো সুতা বা তার চেয়েও কোনো ক্ষুদ্র জিনিস খেয়ানত করে, তবে কেয়ামতের দিন খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে সে উত্থিত হবে।’ বিভিন্ন হাদিসের আলোকে জানা যায়, কাজে ফাঁকি দিয়ে ব্যক্তি কখনো নিজেকে পূর্ণ মুসলমান দাবি করতে পারে না। কারণ ফাঁকির মাধ্যমে উপার্জিত সম্পদ হারাম। আর হারাম খাদ্য গ্রহণ করে কোনো ইবাদত পালন করলে আল্লাহ তা কবুল করেন না।
ইসলাম কোনো ধরনের ফাঁকি, প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি সমর্থন করে না। বিশেষ করে অর্থ উপার্জনের পথ বা উপায় যদি হারাম হয়, তাহলে ইবাদত কবুল না হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। এজন্য এসব ক্ষেত্রে ইসলাম অনেক কঠোর নীতি দিয়েছে। কাজে ফাঁকি দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াও অনেক বড় পাপ। ফাঁকি দিয়ে অর্থ উপার্জন মানে অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করা, অন্যের পাওনা হরণ করা। এটাও এক ধরনের জুলুম বা দুর্নীতি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। তোমাদের প্রত্যেককেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (বোখারি: ৪৭৮৯)। আজ যারা কাজে ও দায়িত্বে অবহেলা করছে, তারা এর কারণে তো জবাবদিহির সম্মুখীন হবেই, কাজ না করে পূর্ণ পারিশ্রমিক গ্রহণের কারণে বেতনও হালাল হবে না। অসৎ মনের অনেক মানুষ যে কোনো মূল্যে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সফল হতে চায়। বিশেষ করে চাকরিজীবীরা কর্মক্ষেত্রে ফাঁকি দেওয়াকে দুর্নীতি মনে করে না। অতিরিক্ত লাভ ও লোভের নেশায় তারা ফাঁকি দেয়। কর্তব্যজ্ঞান ভুলে অনৈতিক পথে পা বাড়ায়। প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা নিজ কর্মক্ষেত্রে কাজ করার জন্য কর্তৃপক্ষ তাকে বেতন দেয়। নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত সেবা দেওয়া তার দায়িত্ব। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অফিসে কাজে ফাঁকি দেওয়া যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে অফিসে না থাকার কারণে সেবাপ্রার্থীকে যথাসময়ে যথাযথ সেবা প্রদানে ব্যর্থ হন। সেবাপ্রার্থীকে তার কাছে বারবার যেতে হয় মূল্যবান অর্থ ও সময় নষ্ট করে, ফলে তার ভোগান্তি বহুগুণে বেড়ে যায়।
কর্মক্ষেত্রে কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা মারাত্মক বেড়েছে। বর্তমানে সরকারি অফিসের সময়সূচি সকাল ৯টা থেকে বিকেল পাঁচটা। সকাল ৯টায় কতজন অফিসে আসেন? কতজন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অফিসে থাকেন? কতজন দুপুরে যথাসময়ে নামাজ ও খাওয়া শেষ করে নিজের টেবিলে সেবা দেওয়ার জন্য বসেন? অসংখ্য চিকিৎসক সরকারি হাসপাতালে নির্ধারিত সময় কর্মস্থলে না থেকে বেসরকারি হাসপাতালে অতিরিক্ত অর্থের লোভে সেবা দেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে। ফলে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হন। বিদেশে গিয়ে সঠিক সময়ে দেশে না ফিরলেও অনেকে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন নিয়মিত। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের অসংখ্য শিক্ষক অফিসের নির্ধারিত সময়ে অফিসে না থেকে ব্যক্তিগতভাবে প্রাইভেট পড়ান বা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেন, যা শতভাগ অনৈতিক। অনেকেই সুযোগ পেলেই অফিস চলাকালে বাসায় চলে যান। সরকারি কলেজের শিক্ষকরা সরকার নির্ধারিত অফিস সময়ে অধিকাংশই থাকেন না।
কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেউ যদি নির্ধারিত সময় অফিসে না থেকে বাইরে চলে যান এবং যে কোনোভাবে লাভবান হন, তার বেতন তাহলে হালাল হবে না। একইভাবে অফিসে থেকেও যদি কেউ নির্ধারিত কাজ না করে অযথা আড্ডা-গল্প করে সময় নষ্টা করেন, তাহলেও বেতন হালাল হবে না। আর বেতন হালাল না হলে ইবাদাতও কবুল হবে না। কারণ হালাল উপার্জন ছাড়া কোনোভাবেই ইবাদত কবুল হয় না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ পাক পবিত্র, তিনি পবিত্র জিনিস কবুল করেন। আল্লাহতায়ালা মুমিনদের ওই জিনিসের হুকুম করেছেন, যেই হুকুম তিনি তার রাসুলদের করেছেন।’ আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে রাসুলগণ, তোমরা হালাল জিনিস খাও এবং নেক আমল করো।’ তিনি আরও বলেন, ‘হে ইমানদাররা, তোমরা আমার দেওয়া হালাল খাদ্য খাও।’ তারপর নবী কারিম (সা.) এমন এক ব্যক্তির আলোচনা করলেন, যে দীর্ঘ সফর করেছে ফলে তার চুল এলোমেলো ও ধূলিমলিন হয়ে আকাশের দিকে হাত উঠিয়ে বলছে, ‘হে আমার রব, হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম এবং হারামের মধ্যে সে প্রতিপালিত হয়েছে। এরপরও কীভাবে তার দোয়া কবুল হবে?’ (মুসলিম শরিফ)
এই ব্যক্তির উদাহরণ দিয়ে রাসুল (সা.) বোঝাতে চেয়েছেন যে, ইবাদত-বন্দেগি যতই করুক না কেন, উপার্জন হালাল না হলে নিশ্চিত জাহান্নাম। হারাম খাদ্য গ্রহণের ফলে শরীরে যে রক্ত তৈরি হয় এবং তা সারা দেহে সঞ্চালিত হয়, তা সবই হারাম। হজরত জাবের (রা.) বলেন. রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই গোশত জান্নাতে যাবে না, যা হারাম দ্বারা বর্ধিত হয়েছে। আর যে গোশত হারাম দ্বারা গঠিত হয়েছে জাহান্নামই তার উপযুক্ত স্থান।’ (মুসনাদে আহমদ)।
শুধু আর্থিক দুর্নীতিই দুর্নীতি নয়। কর্মক্ষেত্রে কাজে ফাঁকি দেওয়াও বড় ধরনের দুর্নীতি। অন্যকে বা অন্যের সন্তানকে ফাঁকি দিলে নিজেকে বা নিজের সন্তানকেও অন্য কেউ ফাঁকি দেবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। বর্তমানে অফিসে থেকেও কাজ না করে ফাঁকি দেওয়ার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার। অনেক শিক্ষক ক্লাসে বসে না পড়িয়ে ফেসবুক ব্যবহার করেন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মনে রাখতে হবে, কাজে ফাঁকি দেওয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি করলে তাকে জবাবদিহি করতে হবে—দুনিয়ায় বসের কাছে আর পরকালে মহান মালিকের কাছে।
একজন মুসলমান কখনো অসৎ উপায় অবলম্বন করবে না, ঘুষ-দুর্নীতি করবে না, কাজে ফাঁকি দেবে না, দায়িত্বে অবহেলা করবে না। কর্তৃপক্ষেরও কর্তব্য যথাযথ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া। সৎ-নিষ্ঠাবান ও নির্লোভ ব্যক্তি চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া। কারণ প্রতিষ্ঠানের উন্নতি-অবনতি, সফলতা-ব্যর্থতা নির্ভর করে সৎ কর্মচারীর ওপর। কর্মচারী সৎ না হলে প্রতিষ্ঠান সফলতা লাভ করতে পারে না। সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মী প্রতিষ্ঠানের জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক। কর্মীর সঙ্গে সদাচরণ করা কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বশীলদের নৈতিক দায়িত্ব। অন্যদিকে কর্মীদের কর্তব্য হলো প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর কোনো কাজ না করা। শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ হালাল হওয়া ও এর বিনিময়ে পরকালীন সফলতার প্রতি লক্ষ রাখা জরুরি। সেবার মানসিকতা নিয়ে আন্তরিকতা ও আনন্দের সঙ্গে কাজ করলে পার্থিব-পারলৌকিক সাফল্য অর্জন সম্ভব।
লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ