ছাগল খুব নিরীহ প্রাণী। মানুষকে তুচ্ছার্থে ছাগল বলে গালি দেওয়া হয়, অবশ্য তাতে ছাগল মাইন্ড করে কি না, জানি না। ছাগলের খাবার নিয়েও রয়েছে নানান কথা, ‘পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়।’ তেমনই নিরীহ এক ছাগল এবার খেয়ে ফেলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মান-ইজ্জত। খুলে দিয়েছে দুর্নীতির এক প্যান্ডোরার বাক্স।
ছাগলকাণ্ড নিশ্চয়ই আপনাদের সবার জানা হয়ে গেছে। এবার কোরবানির আগে আলোচিত সাদিক অ্যাগ্রোতে ১ কোটি টাকা দামের ব্রাহামা গরু আর ১৫ লাখ টাকা দামের বিটল ছাগল নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে এক তরুণ ১৫ লাখ টাকা দাম হাঁকা ছাগলটি ১২ লাখ টাকায় কিনে নেয়। এরপরই শুরু হয় সিটিজেন জার্নালিজম। সাদিক অ্যাগ্রোর দাবি অনুযায়ী, ব্রাহামা গরু আর বিটল ছাগলের চৌদ্দপুরুষের বংশলতিকা আছে, আছে আভিজাত্য। কিন্তু সেই ছাগল এখন টান দিয়েছে ক্রেতার চৌদ্দপুরুষের ঠিকুজি নিয়ে। এতদিন জেনেছি ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’, এখন দেখছি ‘ছাগল খুঁজতে বাপ’ বেরিয়েছে। ১২ লাখ টাকা দিয়ে যে কোরবানির জন্য ছাগল কেনে, না জানি সে কার পোলা, এই নিরীহ কৌতূহল থেকে ফেসবুকে অনুসন্ধান শুরু। জানা গেল, মুশফিকুর রহমান ইফাতের গুণধর পিতা ড. মতিউর রহমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট। ব্যস, সব ফকফকা। আমাদের ট্যাক্সের টাকা কোথায় যায়, বুঝতে নিশ্চয়ই কারও অসুবিধা হবে না।
ছাগলকাণ্ড নিয়ে একটা সুপার ডুপার হিট সিনেমা হতে পারে। কারণ, এর পরতে পরতে টুইস্ট। কোরবানির পর সাদিক অ্যাগ্রো কর্তৃপক্ষ জানাল, ১ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে বুকিং করলেও বিতর্কের পর ইফাত আর ছাগলটি নেননি। তাতে তাদের ক্ষতি হয়েছে। এদিকে ইফাত দাবি করেন, তিনি ছাগলটি কেনেননি বা বুকিংও দেননি। সাদিক অ্যাগ্রোর অনুরোধে ছবি তুলেছেন শুধু। আর ইফাতের বাপ টুইস্টের দাদা মেরেছেন। তিনি দাবি করেছেন, ইফাত তার সন্তানই নন। তিনি এই নামে কাউকে চেনেন না। ট্রাম্পে যেমন ওভারট্রাম্প, টুইস্টেও আছে পাল্টা টুইস্ট। ফেনীর আলোচিত সাংসদ নিজামউদ্দিন হাজারী হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন। তিনি দাবি করলেন, ইফাতই মতিউর রহমানের ছেলে। আর ইফাতের মা হলেন মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী। এ মহিলা হলেন সাংসদ নিজামউদ্দিন হাজারীর আপন মামাতো বোন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ডিএনএ টেস্টের দাবিও সামনে এসেছে। তবে ডিএনএ টেস্টের জন্য ইফাতকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। জানা যাচ্ছে, ইফাত তার মাকে নিয়ে উড়াল দিয়েছে। এটা একটা মজার ব্যাপার। বাংলাদেশে কিছু হলেই সবাই উড়াল দেন। আচ্ছা, তাদের যেতে কি ভিসা-টিসা লাগে না। নাকি তাদের ভিসা রেডি থাকে। তারা কি জানেন, তারা একদিন না একদিন ধরা খাবেন। তাই আগে থেকেই তৈরি থাকেন। ভারতের একটা বাংলা সিনেমায় একটি সংলাপ আছে—‘মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে।’ এ সংলাপের বাংলাদেশি ভার্সন হতে পারে—‘চুরি করব দেশে, ভোগ করব বিদেশে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শেষে বিষয়টি আসে মূলধারার গণমাধ্যমের কাছে। একের পর এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে মতিউর রহমানের সম্পদের হিসাব। এ যেন সম্পদের অন্তহীন খনি। মতিউর রহমান দুই বিয়ে করেছেন। তিনি নিয়ম করে দুই স্ত্রী এবং দুই সংসারের সন্তানদের অঢেল অর্থ দিয়েছেন। তার প্রথম সংসারের কন্যা কানাডায় ৮ কোটি টাকা দামের প্রাসাদে থাকেন, ৪ কোটি টাকা দামের গাড়ি হাঁকান। দেশে তার জমি, ফ্ল্যাট, একাধিক রিসোর্ট, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের তথ্য সামনে আসছে। দুই পরিবার মিলে মতিউর রহমানের নয়টি গাড়ির খবর মিলেছে। সব গাড়িই বিলাসবহুল। শেয়ারবাজার থেকে টাকা কামিয়েছেন অবৈধভাবে ইনসাইড ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে। ইফাত মতিউর রহমানের ছেলে কি ছেলে না, তাতে এখন আর কিছু যায় আসে না। ইফাত ছেলে না হলেও মতিউর রহমানের সম্পদের তথ্য তো আর মিথ্যা হয়ে যাবে না।
দুর্নীতি সম্পর্কে আমাদের সমাজে একটা পারসেপশন আছে। সরকারি কর্মচারীরা ঘুষ খান, এটা সবাই জানেন, সবাই মেনেও নিয়েছেন। মেয়ের বিয়ের সময় বাবা পাত্রের উপরি আয়ের খবরও নেন। সেজন্যই শিক্ষা ক্যাডারের চেয়ে অ্যাডমিন ক্যাডারের চাহিদা বেশি, তার চেয়ে বেশি পুলিশের, তার চেয়ে বেশি কাস্টমস। চাহিদা বেশি, কারণ সেখানে আয় বেশি। আয় বেশি মানে কিন্তু বেতন বেশি নয়। সেখানে ঘুষ নেওয়ার সুযোগ বেশি। সুযোগ থাকলে কমবেশি সবাই ঘুষ নেন। কিন্তু কেউ কেউ সব সীমা ছাড়িয়ে যান। আর সীমা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহও পছন্দ করেন না। পাপের বোঝা পূর্ণ হলে কখনো কখনো মতিউর রহমানের মতো দুয়েকজন ধরা পড়ে যান। মতিউরের ছেলে কোটি টাকার গাড়ি হাঁকাত। আমরা কেউ টেরও পাইনি। কিন্তু ১২ লাখ টাকার ছাগলে তাদের সর্বনাশ হয়ে গেল। একেই বলে পচা শামুকে পা কাটা। ইফাতের একটু কোরবানি দেওয়ার শখ ছিল। এ কারণেই বেচারা ধরা খেয়েছে। নিজে তো ডুবেছেই, বাপকেও ডুবিয়ে ছেড়েছে। কথায় বলে না পাপ বাপকেও ছাড়ে না। আমরা এক ইফাত আর এক মতিউর নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে এমন আরও কত মতিউর, কত মতিউরের ছেলেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা টেরও পাচ্ছি না।
বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের দুর্নীতি দমন করার কথা। কিন্তু নিজেরা কিছুই জানতে পারে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা গণমাধ্যমে কোনো বিষয় নিয়ে তুলকালাম হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের ঘুম ভাঙে। তারা তখন অনুসন্ধান শুরু করে। কিন্তু তাদের ঘুম ভাঙতে ভাঙতে পাখি উড়াল দেয়। এর আগে আমরা দেখেছি, দুর্নীতি দমন কমিশন ডাকার আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। এই লেখা যখন লিখছি, তখন খবর পেলাম আদালত মতিউর রহমান ও তাদের পরিবারের দেশ ছাড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। কিন্তু আমার সামনে একটা পত্রিকায় শিরোনাম দেখছি—‘দেশ ছেড়েছেন ছাগলকাণ্ডের মতিউর।’ আর মতিউরের ছেলে ইফাতের দেশ ছাড়ার খবর আগেই চাউর হয়েছে। তাহলে কি প্রভাবশালী অভিযুক্তরা নিরাপদে দেশের বাইরে পৌঁছানোর পরই দুদক তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে? নইলে আমরা বাচ্চু, পি কে হালদার, বেনজীর, মতিউরদের পাই না কেন? কেউ অভিযোগ করলেই যে সেটা সত্যি হবে, তেমন কোনো কথা নেই। তদন্ত করে দেখা গেল, আসলে নির্দোষ। কিন্তু তিনি যাতে পালাতে না পারেন, সেটা আগে নিশ্চিত করতে হবে।
মতিউরের সম্পদের বিবরণ নিয়ে তোলপাড় শুরুর পর তিনি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। সরকারও তার বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাকে শুধু এনবিআর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে বদলি করা হয়েছে। আর সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। মতিউর রহমান যা কামিয়েছেন, এসব পদপদবিতে তার আর কিছু যায়-আসে না। তার ছেলে প্রতি মাসে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কিনলেও আগামী কয়েক প্রজন্মে টাকা ফুরাবে না।
বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজরা এখন চালাক হয়ে গেছেন। তারা দেশে সম্পদ উপার্জন করেন আর তা ভোগ করেন কানাডা বা আমেরিকায়। উপার্জনের সঙ্গে সঙ্গে পাচারের লাইনও ক্লিয়ার থাকে। এক পত্রিকায় দেখলাম, করোনার সময় মতিউর রহমান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার অবস্থা যখন সংকটাপন্ন, তখন তার দ্বিতীয় স্ত্রী, মানে ইফাতের মা মতিউরের কাছ থেকে ৩০০ কোটি টাকার চেক লিখিয়ে নিয়েছিলেন। পরে সেই টাকা ক্যাশও করা হয়েছে। ফেসবুকে কানাডায় তার মেয়ের যে বাড়ির ছবি দেখেছি আর মতিউরের যা টাকা আছে; তাতে দুই পরিবার নিয়েই তিনি সেখানে আরামসে বাকি জীবন কাটাতে পারবেন। বাংলাদেশের এসব ফেসবুক, গণমাধ্যম, দুদক তার টিকিটিও ছুঁতে পারবে না। যার থাকার কথা জেলে, সে থাকবে প্রাসাদে। তাহলে বাংলাদেশে দুর্নীতি থামবে কীভাবে, কমবে কীভাবে?
দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে বা কমাতে হলে সব পর্যায়ে বেনজীর-মতিউরদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। দুর্নীতি করে উপার্জিত অর্থ ভোগ করা যায় না; এটা নিশ্চিত করতে হবে। পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না, তার দৃষ্টান্ত গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ