কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৪, ০৩:০৬ এএম
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৪, ০৯:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আমি সেই ভাইরাল ছাগল বলছি

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
আমি সেই ভাইরাল ছাগল বলছি

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। আমিই সেই ভাইরাল হওয়া ছাগল, যাকে ঘিরে লেখা হয়নি এমন কোনো প্রিন্ট মিডিয়া নেই। এমন কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া নেই, যারা আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন করেনি। আর করবেই না কেন, আমি কি আর যেই-সেই ছাগল? আমার উচ্চতা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। আমার রয়েছে অতি উচ্চস্তরের বংশমর্যাদা। গায়ের রং মায়াবী হরিণের মতো। বেড়ে ওঠা দেশের সেরা খামারে। তবে শুধু এজন্যই যে, আমি ভাইরাল হয়েছি, তা কিন্তু নয়।

আমাকে ভাইরাল করেছে একটি ছবি। দুর্ভিক্ষের দেশে রাস্তার কিনারে পড়ে থাকা মৃতপ্রায় শিশুর মাংস খেতে উদ্ধত শকুনের ছবি শিরোনাম হয়। আর প্রাচুর্যের দেশে ১৫ লাখ টাকা দামের ছাগলের ছবি শিরোনাম হয়। কেন ও কোন বিবেচনায় আমার দাম ১৫ লাখ আর আমার প্রতিবেশী গরুর দাম ১ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল, তা আমার জানার কথা নয়। আমাকে বলা হলো, ১৯ বছরের এক তরুণ আমাকে কিনেছে ১২ লাখে। কিন্তু আমি ১২ লাখ টাকার ছাগলের জন্য কত জনের ১২টা বাজবে, তা ছিল সবার অজানা। আমাকে আরও বলা হলো, এখন আমার ফটোসেশন হবে। এমন ফটোসেশন আমার জন্য নতুন কিছু নয়। আমার জুনিয়ররাও বহু ফটোসেশন করেছে। তাই দেরি না করে দাঁড়িয়ে গেলাম। সেই তরুণও আমাকে পাওয়ার আনন্দে গর্বের হাসি দিয়ে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিল। ছাগলময় হয়ে উঠল বাংলার সাইবার জগৎ।

তবে সেই আনন্দ বিষাদে পরিণত হতে সময় লাগল না। তরুণ বয়সী ক্রেতা জানত না যে, এই সমাজে বেহুদা কিছু দুপায়া ছাগল আছে, যারা মিডিয়ায় ম্যা ম্যা করেই মজা পায়। গোটা সমাজ যখন সব অন্যায় দেখেও কেবল ছাগলের মতো জবর কাটে আর ঝিমায়, তখন এই দুপায়া ছাগলরা নাকি বিবেকের টানে তিনপায়া ক্যামেরা নিয়ে মাঠে থাকে। কেনরে বাপ! তোদেরই কেবল বিবেক আছে, বাকিদের নেই? বাকিদের মাথায় কি কেবল গরুর গোবর? কই তারা তো কিছু বলে না! তোদের কি খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই? এত রাসেলস ভাইপার, উরাধুরা গান, ক্রিকেটের কারবার—এসব নিয়ে থাক তোরা। আমি ছাগলকে নিয়ে তোদের এত আগ্রহ কেন? তোরা তো আর চারপায়া ছাগল না যে, আমাকে নিয়ে হিংসা করবি!

আচ্ছা, আমাকে নিয়ে না হয় খবর করলি, অসুবিধা নেই। কিন্তু যে ১২ লাখে কেনার জন্য ১ লাখ টাকা বায়না দিল, তারে নিয়ে খবর করলি কেন? আমি উচ্চবংশীয় হলেও আমার বাপ কে, মা কে, সৎমা কে, সৎভাইবোন কে; এগুলো কোনো ব্যাপার না। কারণ আমরা ছাগল, আমাদের কোনো কাপড়চোপড় পরতে হয় না। কিন্তু যে কিনেছে, তার জন্য তো এটা একটা ব্যাপার, তাই না? এখন শুনছি এতদিন যিনি তার বাবা ছিলেন, একই রং ও ডিজাইনের পাঞ্জাবি পরে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিতেন, তিনি বলেছেন এটা আমার ছেলে না। আমি তাকে চিনিও না। আবার সেই ছেলেও বলল, আমি ছাগল কিনি নাই, মালিকের অনুরোধে ছবি তুলেছি শুধু। মালিক বলল, ওই ছেলে কি সেলিব্রেটি যে তাকে আমার ছাগলের সঙ্গে ছবি তুলতে বলব, আমি এত ছাগল না। আমার কাছে অগ্রিম ১ লাখ টাকা দেওয়ার প্রমাণ আছে।

এসব দেখেশুনে দুপায়া কয়েক দল ছাগল মনের আনন্দে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো লাফাচ্ছে আর নানা ফন্দি-ফিকির করছে। একদল নেমেছে সিনেমা বানাবে, নাম ‘ছেলে তুমি কার?’ নাটকের শুটিং শুরু হয়েছে, নাম ‘ছাগল তুমি কার?’ শীতকালের জন্য নতুন যাত্রার মহড়া চলছে, নাম ‘ছেলে বড় না ছাগল বড়?’ স্টুডিওওয়ালারা গান বাঁধছে ‘কী সাপে দংশিলো আমার ছাগলেরে, আমার দাইমা, দাইমা গো’। ওয়েব সিরিজ চলছে ‘মা-ছেলে বিদেশে!’ এসব ছাগলামির কোনো মানে আছে?

কার্টুনওয়ালারা আবার কম যায় না। শুরু করেছেন নিত্যনতুন ফাজলামি। বাড়ির নিচে গাড়ির গ্যারেজে রাখা এক কোরবানির ছাগল কোন ফাঁকে টুক করে পাশের এক চেয়ারে উঠে বসে পড়ে। কেয়ারটেকার দৌড়ে আসে ছাগল নামাতে। বাড়ির মালিক বাধা দেয়, বলে, থাক—ওকে আর বিরক্ত করিস না। এর চেয়ে বড় বড় চেয়ারেও ছাগলরা বসে আছে। আমাদের ছাগল জাতির এমন স্বীকৃতিতে আমরা অহংকার বোধ করি।

বিশাল ছাগল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন একজন। পথে দাম জিজ্ঞেস করলেই গর্বিত ক্রেতা উত্তর দিচ্ছেন ‘৩ লাখ’। এসব দেখে এক পথিক জিজ্ঞেস করলেন, ‘গরুর দাম কত?’ ক্রেতা থমকে দাঁড়ালেন। রেগে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি গরু চেনেন না?’ পথিক প্রতিউত্তর দিলেন, ‘গরু চিনি বলেই তো ছাগলকে জিজ্ঞেস করলাম, গরুর দাম কত?’ ক্রেতা আরও রেগে গেলেন, ‘এই কথার মানে কী?’ পথিক বললেন, ‘যাদের মাথায় গোবর তারা গরু, তারা এ কথার মানে বুঝবে না। যে ৩ লাখ টাকায় ছাগল কিনে আবার সেই ছাগলের রশি হাতে রাস্তা দিয়ে হাঁটে, সে এই সমাজে গরু নয়তো কী? তার দাম তো ছাগলের কাছেই জানতে হবে তাই না?’ না পথিক আর কথা বাড়াতে পারলেন না। তাড়া খেয়ে ভোঁ-দৌড় দিলেন।

এমন এক বর্ষাকালে রাজা শিকার করতে জঙ্গলে যাবেন। আবহাওয়ামন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ ও আগামী দুই-তিন দিন আবহাওয়া কেমন থাকবে?’ অনেক গবেষণা করে মন্ত্রী বললেন, ‘খুব চমৎকার আবহাওয়া থাকবে রাজামশাই! আপনার শিকার ও ভ্রমণ শুভ হোক রাজামশাই।’ সাথীদের নিয়ে যাত্রা করলেন রাজা। পথে ছোট এক খরস্রোতা পাহাড়ি নদীতে কাপড় ধোয়ায় ব্যস্ত এক ধোপি। দেখলেন রাজা হাতি নিয়ে নদী পার হতে চলেছেন। ধোপি বাধা দিল। মিনতি করে বলল, ‘গুস্তাকি মাফ জাঁহাপনা! আপনি নদীর ওপারে যাবেন না। আজসহ সামনে কয়েক দিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হবে। নদীর পানি বেড়ে যাবে, প্রচণ্ড স্রোত হবে। আপনি চাইলেও আর ফিরতে পারবেন না।’ ধুপির কথা শুনলেন না রাজা, বরং তিরস্কার করলেন। আবহাওয়ামন্ত্রীর কথায় আস্থা রেখে নদী পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি শুরু হলো, যা চলল টানা কয়েক দিন। বৃষ্টি থামার পর ক্ষুব্ধ রাজা প্রাসাদে ফিরলেন এবং প্রথমেই আবহাওয়ামন্ত্রীকে বরখাস্ত করে সেই ধোপিকে আবহাওয়ামন্ত্রী বানালেন। বৃষ্টি বিষয়ে এ ধোপির (বর্তমানে আবহাওয়ামন্ত্রী) পূর্বাভাস সবসময় মিলে যেত। এতে রাজা খুব খুশি থাকতেন।

একদিন রাজা কৌতূহলবশত তার আবহাওয়ামন্ত্রীকে (ধোপি) এমন নির্ভুল পূর্বাভাস দেওয়ার রহস্য জানতে চাইলেন। মন্ত্রী কোনো ভণিতা না করেই বললেন, ‘আলমপনা, এ কৃতিত্ব আমার নয়, সব কৃতিত্ব আমার ছাগলের। প্রতিদিন সকালে আমি ছাগলটাকে মাঠে বেঁধে দিই ঘাস খাওয়ার জন্য। মনের আনন্দেই সে ঘাস খায়। তবে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আগে থেকেই টের পায়। তখন ঘরে নেওয়ার জন্য এই ছাগল ম্যায়ে ম্যায়ে করে চিৎকার করে। এতে আমি বুঝতে পারি বৃষ্টি হবে।’

রাজা সব শুনে বেজায় খুশি হলেন। সেইসঙ্গে আরেকটা কাজ করলেন, আবহাওয়ামন্ত্রী (ধোপিকে) অব্যাহতি দিয়ে সেই ছাগলকেই আবহাওয়া মন্ত্রী বানিয়ে দিলেন। তখন থেকেই ছাগলের শাসন কায়েম হলো রাজ্যজুড়ে। রাজাকে খুশি করতে প্রজারাও ন্যায্য কথা না বলে ছাগলের মতো ‘ম্যায়ে... ম্যায়ে...’ করা শুরু করল।

তাই তো বলি, আমি যেই-সেই ছাগল নই, আমি ভাইরাল ছাগল। আমার সঙ্গে লাগলে খবর আছে! এখন দেশের যাবতীয় স্যাটেলাইট ও রাডারের কেন্দ্রবিন্দুতে আছি আমি! কে আমাকে এ খামারে কত টাকায় বিক্রি করেছে, তার তদন্ত হচ্ছে। সেই টাকার উৎস ও ছাগল বিক্রির টাকার ট্যাক্স ফাইলে তোলা হয়েছে কি না, সেটাও তদন্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে যে আমাকে কিনবে, তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কনটেন্ট তৈরি করতে প্রস্তুত লক্ষাধিক দুপায়া ছাগল, ট্যাক্স কর্মকর্তা, গোয়েন্দা বাহিনী, পাইকপেয়াদা, চাঁদাবাজ, রাজনৈতিক ফান্ড কালেক্টর, মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানার মোয়াল্লেম, পাড়া-মহল্লার ক্লাবের কর্মকর্তা, ভিআইপি কসাইসহ আরও অনেকে। সবাই অপেক্ষা করছে, কে আমাকে কত টাকায় কিনবে, তা দেখার জন্য। তাই বড় দুশ্চিন্তায় আছি আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে! ভাইরাল হলে যে ভবিষ্যৎ এমন হবে, তা জানত কোন ছাগলে?

তবে কানে কানে শিয়াল মামা নতুন কথা শুনিয়ে গেল। সমাজে দুপায়া ছাগলদের দেখানোর জন্য টেবিলের ওপর দিয়ে কাগজে-কলমে অল্প কিছু আর বাকিটা টেবিলের নিচ দিয়ে লেনদেন করে নাকি অনেক কিছু করা যায়। এ সময় দুপায়া ছাগলরা ছাগলের মতোই কেবল ঝিমায় আর জবর কাটে। কিচ্ছু দেখে না, কিছু শুনে না, কিচ্ছু বলে না, কিচ্ছু বোঝে না। অতএব নো টেনশন, ডু ফুর্তি।

এতদিন দুপায়া ছাগলরা বলেছে, ‘পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়।’ এখন দিন পাল্টে গেছে। এখন থেকে বলতে হবে, ‘ছাগলে কি না পারে, পাগলে যদি ঘুষ খায়।’ যাকে কেউ কোনো দিন পোস্টিং করার সাহসও করেনি, আমি ছাগল তাকে পোস্টিং করিয়ে দিয়েছি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ থেকে সরিয়ে দিয়েছি। অতএব, ‘ডোন্ট আন্ডারস্টিমেট দ্য পাওয়ার অব এ ছাগল।’

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

ইমেইল: [email protected]

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাজীপুরে বাসচাপায় যুবক নিহত

দুর্গাপূজায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে মাঠে থাকবে বিএনপি : আজাদ

সাড়ে ৩ কোটি টাকার চাল নিয়ে লাপাত্তা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা

সাতক্ষীরায় ৯ মাস বেতন পাচ্ছেন না ৪২০ শিক্ষক

সিরাজগঞ্জে হত্যা মামলার আসামি গ্রেপ্তার

গাজীপুরে শান্তিপূর্ণভাবে চলছে পোশাক কারখানা

বৃষ্টি আর কত দিন থাকবে, জানাল আবহাওয়া অফিস

ইসরায়েলি হামলায় সিরিয়া-লেবানন সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

দুপুরের মধ্যে ঝড় হতে পারে যেসব অঞ্চলে

আরেক দেশ থেকে ইসরায়েলে হামলায় ২ সেনা নিহত, আহত ২৪

১০

বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে জবির স্লোগান ‘বিপ্লবে বলীয়ান নির্ভীক জবিয়ান’

১১

শিক্ষক দিবসে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে

১২

হত্যা মামলায় রসিকের সাবেক কাউন্সিলর মিলন গ্রেপ্তার

১৩

বৈরুত বিমানবন্দরের পাশেই ইসরায়েলি তাণ্ডব

১৪

সিলেটে রায়হান হত্যা মামলায় ২ যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৫

৫ অক্টোবর : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৬

রোহিঙ্গা সংকট একটি তাজা টাইম বোমা : ড. ইউনূস

১৭

বন্যার পানিতে মায়ের লাশের সঙ্গে ভেসে এল শিশু

১৮

লেবাননের যোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষ, পিছু হঠল ইসরায়েলি বাহিনী

১৯

সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর জানাজা কখন-কোথায়?

২০
X