বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব জামান ‘আমরা একাত্তর’-এর সভাপতি। বর্ণাঢ্য জীবনে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টরে মুন্সীগঞ্জ গজারিয়া এলাকায় বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। ১৯৭২ সালে ডাকসুর নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান একাত্তরে জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়, মুক্তিযুদ্ধের ডকুমেন্টস ও সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ ও করণীয়, মুক্তিযোদ্ধা তালিকা এবং সামাজিক-মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়সহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রীতা ভৌমিক
কালবেলা: মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পর ‘আমরা একাত্তর’ গঠনের প্রয়োজনীয়তা কী?
মাহবুব জামান: ৫৩ বছর পর তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিশালত্ব, ব্যাপকতা, ধ্বংসযজ্ঞ, সহিংসতা, বর্বরতা, সাহস, বীরত্ব, বিজয় এ বিষয়গুলো পরিষ্কার নয়। তারা মনে করে, পাকিস্তান হেরে গেছে, বাংলাদেশ জিতে গেছে, ভারত সহযোগিতা করেছে। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তারা যদি মূল বিষয়টি না বোঝে, তাহলে এর মূল্য বুঝতে পারবে না। কী মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। গান রয়েছে ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা/ কারোর দানে পাওয়া নয়’। আমরা মনে করি, একাত্তরের মর্মবাণী, আদর্শ, চিন্তাচেতনা ৫৩ বছর নয়! আরও অনেক বছর করতে হবে। এই চিন্তা শুরু হয়েছে, এটাকে যত দ্রুত আমরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে চাই।
কালবেলা: মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সংগঠন আছে। তারপরও কেন আরেকটি সংগঠনের দরকার হলো। এ সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী?
মাহবুব জামান: ‘আমরা একাত্তর’কে আমরা সংগঠন বলছি না। এটা একটি জাগরণের প্ল্যাটফর্ম। আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সব সংগঠনের সঙ্গেই সম্পৃক্ত রয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টরস কমান্ডারস ফোরাম, প্রজন্ম একাত্তর, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের গণহত্যা জাদুঘর, উত্তরবঙ্গের জাদুঘর, জামালপুরের মুক্তিসংগ্রাম ইত্যাদি সংগঠনের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। প্রত্যেকেরই অনেক কাজ আছে। প্রত্যেকের কাজগুলো আলাদা রেখেই আমরা সমন্বিত করব, যাতে তরুণ প্রজন্ম যদি মুক্তিযুদ্ধকে জানতে চায়, সহজেই পেয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সব বই জাতীয় গ্রন্থাগার, বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে অর্থাৎ এক জায়গায় নেই। দেশ-বিদেশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত ডকুমেন্টস আছে, সব ডকুমেন্টস আমরা দুটি ফর্মে রাখব—ভার্চুয়াল ও একচুয়াল ফর্মে। যদিও একচুয়াল ফর্মে রাখাটা খুবই কঠিন। আমরা কয়েক মাস চেষ্টা করছি। তবে এগুলোর এমন দৈন্যদশা কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। যদি সংগ্রহও করা যায়, তাহলেও এগুলো রাখা মুশকিল। তারপরও স্ক্যান করে, পিডিএফ করে যেভাবেই হোক এগুলোকে সংরক্ষিত করব যেন গ্রহণযোগ্যতা থাকে। মুক্তিযুদ্ধের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সবাইকে নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী সবার কাছে পৌঁছে দিতে চাই।
কালবেলা: ‘আমরা একাত্তর’ মূলত কী ধরনের কাজ করবে?
মাহবুব জামান: আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়। মানে জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়। আন্তর্জাতিক চারটি সংগঠন আমাদের এ স্বীকৃতিটা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টি (গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি) এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি—দুই দলেরই দুজন কংগ্রেসম্যান দুটি বিল উত্থাপন করেছে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্মেলন করেছিলাম ঢাকায়। সেখানে নেদারল্যান্ডসের একজন সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য এসেছিলেন। তারা আশা করছেন, এ বছর তারা ইউরোপিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টিতে বিষয়টি উত্থাপন করবেন। পাশাপাশি জাতিসংঘে না হলেও হিউম্যান রাইটস কমিশনে গত দুই বছর ধরে এটা একটা এজেন্ডা হিসেবে আসছে। ৫২ বছরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মূল ভবনে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর তিন দিনের একটি প্রদর্শনী করেছে। শেষ দিন এ সংবাদ বিভিন্ন দেশে প্রচার হয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তান প্রতিবাদ করায় তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত আমাদের অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, আমরা জেনোসাইড নিয়ে কাজ করতে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে জাতিসংঘে, তোমরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাও! তোমাদের দেশেই তো এর স্বীকৃতি নেই।
২০১৭ সালে আমাদের জাতীয় সংসদ একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতকে গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। এটাও একটা অগ্রগতি। এখন বলা হয়, গণহত্যার ডকুমেন্টেশনগুলো বাংলায় লেখা, ইংরেজিতে নেই। সেগুলোও ঠিক না। আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, প্রচুর ডকুমেন্টস আছে। এই ডকুমেন্টসগুলো দিয়ে প্রমাণ করা যাবে, এটা ছিল পরিকল্পিত জেনোসাইড। এ তথ্যগুলো সামনে আনাই হচ্ছে আমাদের প্রধান লক্ষ্য। সেইসঙ্গে আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য, ইতিহাসও তুলে ধরতে চাই। আমাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতার যে অবক্ষয় হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি।
কালবেলা: দেশে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায়। তারপরও বেসরকারি সংগঠনকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে হয় কেন?
মাহবুব জামান: বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আর এখনকার আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইতিহাস পরম্পরায় স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যসহ চার রাজনৈতিক নেতাকে হত্যা করা হয়। এটা শুধু চার নেতাকে হত্যা নয়, পুরো মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করে ওরা চেয়েছিল আগের পাকিস্তানে ফিরে যাবে। অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত সেটা পারেনি। তার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও লাগবে। তার মধ্যে ‘আমরা একাত্তর’ও রয়েছি।
কালবেলা: ‘আমরা একাত্তর’-এর কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কি না? ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না?
মাহবুব জামান: অবশ্যই আমাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধ একটি রাজনীতি। একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছিলাম। মেজরিটি ভোট পেলেও পশ্চিমা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা জয়লাভ করেছি। তবে আমরা রাজনীতি দল গঠন করব না।
কালবেলা: মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মাহবুব জামান: মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার অনেক সুযোগ-সুবিধা তৈরি করেছে। আবার অনেকে খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছেন। তবুও আমি বলব যে, কিছুটা তো খেয়াল করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ করেছি বলেই যে কিছু পেতে চাই তা কিন্তু নয়। তবে সম্মান পেতে চাই। পৃথিবীতে সব দেশেই যারা দেশকে স্বাধীন করেন তারা সম্মান পান। সম্মান দিতে গিয়ে যদি অসম্মান করা হয়, সেই সম্মান না দেওয়াই ভালো। যেমন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের কোটার কথা বলা হচ্ছে। যখন শুনি, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের গালে গালে, জুতা মারো তালে তালে।’ সেটা তো একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান দেওয়া হলো না। কিছু ভাতা দিলাম, মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের কোটা দিলাম আর মুক্তিযোদ্ধাদের গালে থাপ্পড় দিলাম। এভাবে অসম্মান করার চেয়ে বরং যতটুকু আছে তাই থাকা ভালো। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকে খারাপ অবস্থানে রয়েছেন, এটা কাম্য নয়।
কালবেলা: মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণে করণীয় কী?
মাহবুব জামান: ইতিহাস তো ইতিহাসই। যখন ঘটনা ঘটে তখন তা ইতিহাস হয় না। ৩০ থেকে ৪০ বছর পার হয়ে ইতিহাসে পরিণত হয়। সেদিক থেকে আমরা যে জায়গায় রয়েছি, সেখান থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কাঠামো দাঁড়িয়েছে। হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ১৪ খণ্ডের একটি দলিলপত্র প্রকাশিত হয়। তারা যে দলিলপত্র পেয়েছিলেন এর এক-চতুর্থাংশ ব্যবহার করতে পেরেছেন। বাকি তিন-চতুর্থাংশ উলু খেয়ে ফেলেছে। এগুলো আর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রক্ষিত হওয়া দরকার। আমরা সেই ইতিহাস রক্ষার জন্য উদ্যোগ নিতে পারি। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সেই প্রজন্ম আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চলে যাব। কিন্তু আশার দিক হচ্ছে, তরুণ প্রজন্ম খুব গভীরভাবে ইতিহাসকে জানার চেষ্টা করছে। তারা দলিলপত্র ঘাঁটছে। আরও আগ্রহের বিষয়, পাকিস্তানের জেনারেলরা, রাজনীতিবিদরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বলছে ‘দিস ইজ দ্য পলিটিক্যাল ফেইলিওর’। রাজনীতিবিদরা বলছেন, ‘দিস ইজ দ্য মিলিটারি ফেইলিওর’। ফলে ভারতীয় জেনারেলরাও তাদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধকে দেখছেন। এর মধ্য দিয়েই একটি সঠিক ইতিহাস বের করতে হবে।
কালবেলা: মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ও সনদ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
মাহবুব জামান: মুক্তিযোদ্ধার তালিকার ক্ষেত্রেও অনেক অভিযোগ রয়েছে। নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হচ্ছে। কখনো লাল মুক্তিবার্তা দিয়ে, কখনো গেজেট দিয়ে, কখনো আইন-আদালত করে। অভিযোগ আছে, অনেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন, যাদের একাত্তরে জন্মই হয়নি। এ বিষয়ে কী বলবেন? মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা এতটা দেরি হয়ে গেছে যে, এখানে নানারকম লোক ঢুকে গেছে। সনদের ক্ষেত্রে অনেক গাফিলতি রয়েছে। সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে বাদ পড়েছেন। অনেকে ঘোষণাই করেননি এই ভেবে, কী লাভ! আমি তো যুদ্ধ করেছি আমার দেশের জন্য। আরেকটি বিষয়, একসময় মুক্তিযোদ্ধা বলাটাই ছিল বিপজ্জনক। সে কারণে অনেকে কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলেছেন। সচিবরা যখন দল বেঁধে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেলেন, তখন আলোড়ন তৈরি হলো। আগে মুক্তিযোদ্ধা বললে চাকরি থাকত না। এখন মুক্তিযোদ্ধা বললে চাকরিতে সাফল্য আসছে। এরপরও একটি তালিকা হয়েছে। বয়সটা যাচাই-বাছাই করে একটা তালিকা থাকা দরকার। মৃত্যুর পর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয় শেষ সময়ে। যদিও তিনি দেখতে পারছেন না। এটিও গুরুত্বপূর্ণ।