বর্তমানে দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। দলটি টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে অনন্য রেকর্ড অর্জন করেছে দলটি। এ সময়ের মধ্যে বিরোধী দলগুলো ক্রমেই শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। অস্তিত্বের সংকটে প্রায় সব রাজনৈতিক দল। কিন্তু গণতন্ত্র বলে, যদি গণতান্ত্রিক উপায়ে কোনো দেশ সঠিকভাবে চালাতে হয় তাহলে সেখানে অবশ্যই একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রয়োজন। বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্রে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে সংসদ প্রাণবন্ত হয়। দেশের শাসনব্যবস্থায় অনেক ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকেন তারাও অনেক ভুল-ভ্রান্তি করতে পারেন। কিন্তু বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনা সরকারকে সঠিক পথ দেখায়। সরকারের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেয়। এতে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাই সরকার ও বিরোধী দল দুটোই গুরুত্বপূর্ণ।
সংসদে থাক না থাক, কাগজে-কলমে বিএনপিই দেশে প্রধান বিরোধী দল। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ। দলটি একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছিল। সুতরাং একটি ভালো রাজনৈতিক দল হওয়ার অনেক সুযোগ তাদের ছিল এবং এখনো আছে। আওয়ামীবিরোধী জনগোষ্ঠীর অন্ধ সমর্থন এই দলের প্রতি আছে। স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল মানুষের প্রথম পছন্দ বিএনপি। কিন্তু বিএনপি সত্যিকার অর্থে এখন কোনো রাজনৈতিক দল নয়। কারণ একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল পরিচালিত হয় গণতান্ত্রিক ধারায়, গঠনতন্ত্র অনুসরণ করে। বিএনপিতে এখন এসবের বালাই নেই। জিয়াউর রহমান যখন বিএনপি নামে যে দল গঠন করেন, সেই দলের গঠনতন্ত্র ১৩ (গ) ধারামতে, কোনো দণ্ডিত ব্যক্তি এই দলে কোনো পদে থাকতে পারবে না বলে ঘোষিত ছিল। শুধু বিএনপি নয়, গঠনতন্ত্রে বিশ্বাসী সব দলেই এ বিধান আছে। এর আগে খালেদা জিয়াকে দণ্ডিত করা হলে এ বিষয়ে হাইকোর্টে একটি রিট হয়েছিল এবং হাইকোর্ট থেকে তখন পরিষ্কার বলা হয়েছিল, দণ্ডিত ব্যক্তি দলীয় পদে থাকতে পারবে না। তখন তারা দলের সেই সংবিধান পরিবর্তন করে ১৩ (গ) রহিত করে। তা নিয়েও আবার হাইকোর্টে মামলা হয়। হাইকোর্ট আবার রায় দেয়, এভাবে গঠনতন্ত্র পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়। দলের মূল গঠনতন্ত্র যা, তাই থাকবে। কিন্তু আদালতের নির্দেশ মানেনি বিএনপি। খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার আগে তারেক রহমানকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান করেন। পরে তাকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়। তারেকও দণ্ডপ্রাপ্ত। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। এ ছাড়া অর্থ পাচার মামলায় তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। যেহেতু খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দণ্ডিত এবং তাদের দলীয় গঠনতন্ত্রের ১৩ (গ) এখনো আইনের দৃষ্টিতে বহাল, সেজন্য তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে থাকতে পারেন না।
তাহলে যে দল বিরোধী হিসেবে বেশ সরব, সেই দলের কোনো প্রধান নেই। যদি তাদের রাজনৈতিক দল চালানোর ইচ্ছা থাকত, তাহলে তারেক রহমানের পরিবর্তে এমন ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান করা হতো, যিনি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নন। দণ্ডিত হয়েও তারেক রহমান এখনো কীভাবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, তাও বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ, বিএনপি যদি নির্বাচনে জয়ী হয় তাহলে তারেক রহমান বা খালেদা জিয়া কেউই প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না দেশের সংবিধান অনুযায়ী। তাই আমার বিবেচনায় বিএনপি দলটি মুণ্ডহীন এক দেহের মতো এখন। এ কারণেই তারা নির্বাচন ও গঠনতন্ত্র বানচাল করতে চায়। নির্বাচন বর্জন করে। গঠনতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এর আগে একটি বিষয় লক্ষ করেছি যে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না করবে না বলেও শেষ পর্যন্ত অংশ নেয় এবং বিভিন্ন আসনে টাকার বিনিময়ে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ থেকে অনেকের ধারণা, নির্বাচন ছিল তারেক রহমানের অর্থ উপার্জনের একটি উৎস। এরপর সময়ের পরিক্রমায় বিএনপি তার কৌশল পরিবর্তন করেছে। বিএনপি এখন রাতের অন্ধকারে কমিটি করতে শুরু করেছে। কমিটিগুলোতে যারা তাকে টাকা দিতে পারছে তারা বিভিন্ন পদ পাচ্ছে, আর যারা টাকা দিতে পারছে না তারা কমিটিতে থাকছে না বলেও ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। তা ছাড়া গঠনতন্ত্র ও ন্যূনতম গঠনতান্ত্রিক রীতি না মেনেই এসব কমিটি গঠিত হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় এই, এ দেশের কোনো রাজনৈতিক দল বা আইন বিশেষজ্ঞ কেউ একবারও বলে না যেহেতু বিএনপির দলীয় গঠনতন্ত্রের ১৩ (গ) ধারা মোতাবেক কোনো চেয়ারপারসন নেই, সেখানে কীভাবে দলের কমিটি বিলুপ্তি এবং নতুন কমিটি করা হচ্ছে।
বিএনপির মতো একটি দল এভাবে যদি চলে তাহলে আমাদের গণতন্ত্রে যে স্থায়ী ক্ষতি হবে তা আমরা কোনোদিন পুষিয়ে উঠতে পারব না। আমি মনে করি বিএনপিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকিয়ে রাখা দরকার। যাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যারা ক্ষমতায় আছে, মাঠে-ময়দানে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আছেন তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারে, তাদের ভুল-ত্রুটি দেখিয়ে দিতে হবে। তা যদি দক্ষিণপন্থি দল হয় তাতেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে দণ্ডিত ব্যক্তিকে ঘোষণার মাধ্যমে বাদ দিয়ে এমন ব্যক্তিকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া উচিত, যে দণ্ডপ্রাপ্ত নয়। এতে অন্ততপক্ষে বিএনপি নামক দলটি থাকবে। এ দেশের একজন গণতন্ত্রমনা ব্যক্তি হিসেবে আমি বিশ্বাস করি যে, দক্ষিণপন্থি দল হলেও বিএনপির এখন টিকে থাকা দরকার, গণতন্ত্রের প্রয়োজনে।
বর্তমানে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনা করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। দেশকে উন্নতির পথে নিচ্ছেন, এমনকি একটি কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিরোধী দলবিহীন রাজনৈতিক যে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে, সেই শূন্যতা পূরণ করা শেখ হাসিনার কাজ নয়। তা আমরা আশাও করতে পারি না। এটা জনগণের এবং অন্যান্য দলের দায়িত্ব। তাই একজন গণতন্ত্রকামী মানুষ হিসেবে বলব, অবিলম্বে বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মীর বোঝা দরকার তারেক রহমান একজন দণ্ডিত অপরাধী, দণ্ডিত অপরাধী তাদের দলের চেয়ারপারসন থাকতে পারেন না। রাতের আঁধারে কমিটি, পদবাণিজ্য এগুলোর বিরুদ্ধে বিএনপির নেতাকর্মীদের রুখে দাঁড়ানো উচিত। দণ্ডিত অপরাধীকে তাদের দলের প্রধান থেকে অব্যাহতি দিয়ে দলকে রক্ষা করতে হবে গণতন্ত্রের স্বার্থে।
দণ্ডিত অপরাধীর যে কাজ, তার প্রতিটিই দণ্ডনীয়। প্রতিটি দণ্ডনীয় কাজের জন্য শাস্তি হওয়া উচিত। সুতরাং জনগণের প্রতি আমার আবেদন থাকবে—আমাদের নিজেদের দেশ, নিজেদের দেশে অন্তত যেন গণতন্ত্র স্থায়ীভাবে ধ্বংস না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা।
লেখক: অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী
সভাপতি, কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট