মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে সম্মানিত করে। তবে এ সম্মান অর্জন ও সংরক্ষণের দায়িত্ব মানুষের। বিশেষ কিছু কাজ করলে মানুষ অর্জন করতে পারবে বিশেষ সম্মান। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের পার্থিব কোনো একটি বিপদ দূর করে দেবে, আল্লাহতায়ালা বিনিময়ে তার আখেরাতের কোনো একটি কঠিন বিপদ দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি অভাবগ্রস্ত লোককে সাহায্য করবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিনে তাকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে, আল্লাহ দুনিয়া-আখেরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আল্লাহ তার বান্দাদের ততক্ষণ পর্যন্ত সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ সে তার ভাইকে সাহায্য করতে থাকে। যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণের জন্য কোনো পথ বা পন্থার সন্ধান করে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।’ (মুসলিম : ২৬৯৯)। এ হাদিসে রাসুল (সা.) মানুষের পাঁচটি গুণের বর্ণনা করেছেন। এসব গুণে গুণান্বিত মুসলমান ইহকাল-পরকাল উভয় জগতে সম্মানিত ও ভাগ্যবান বানাবে।
অন্যের বিপদ দূর করা: এর বিনিময়ে আল্লাহ তার পরকালের বিপদ দূর করে দেবেন। মানুষ সামাজিক জীব। ভ্রাতৃত্বের মিতালি বন্ধনে সবাই মিলেমিশে বসবাস করে দুনিয়ায়। কারও বিপদ দূর করার কারণে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি যেমন খুশি হয়, আল্লাহও তেমন খুশি হন। আল্লাহর নির্দেশে পাহারাদার ফেরেশতারা তৎক্ষণাৎ তার নাম তালিকাবদ্ধ করে নেন। কেয়ামতে ময়দানে এর বিনিময় দেওয়া হবে তার বিপদ দূর করার মাধ্যমে। অতএব পরকালের বিপদ দূর করতে হলে দুনিয়ায় বিপদগ্রস্ত মানুষের বিপদ দূর করতে হবে।
অভাবীকে সাহায্য করা: এর বিনিময়ে আল্লাহ পরকালে সুখ-শান্তি দান করবেন। দুনিয়ার শৃঙ্খলা ঠিক রাখার জন্য আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করেছেন। কাউকে গরিব বানিয়েছেন, কাউকে ধনী বানিয়েছেন। তুলনামূলক গরিবরা বেশি অর্থাভাবে পড়ে। আমাদের পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে এমন বহু অভাবী রয়েছে, যারা দীর্ঘদিন কঠিন রোগে ভুগছে, অর্থাভাবে চিকিৎসা করতে পারছে না, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ছেলেটাকে পড়ালেখা করাতে পারছে না, মেয়ের বিয়ে দিতে পারছে না। এমন অভাবী মানুষের অভাব নেই। আমাদের একান্ত কর্তব্য হলো অভাবীদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। তারা মুখফুটে না চাইলেও তাদের প্রয়োজন পুরো করে দেওয়া। তাতে আল্লাহ খুশি হয়ে পরকালের যাবতীয় চাহিদা পূর্ণ করবেন।
অন্যের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা: এর বিনিময়ে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার ভুল-দোষ গোপন রাখবেন। তবে মানব চরিত্রের একটি দুর্বল দিক হলো অন্যের দোষ চর্চা করা। মানুষ নিজের ব্যাপারে খুব সুধারণা রাখে। নিজেকে সাধু মনে করে। আর অন্যের দোষ-ত্রুটি বলে বেড়ানোটা লাভজনক কারবার মনে করে। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) কঠিন হুঁশিয়ারি ও লাঞ্ছনার বাক্য উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তোমরা মুসলমানদের দোষ-ত্রুটি, ভুলভ্রান্তি খুঁজে বের কোরো না। যে ব্যক্তি অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায় ও প্রকাশ করে দেয়, স্বয়ং আল্লাহ তার দোষ প্রকাশ করে দেন। আর আল্লাহ যার দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করেন তাকে নিজের বাড়িতেই লাঞ্ছিত করেন।’ (আবু দাউদ : ৪৮৮০)
অন্যের সাহায্য করা: এর বিনিময়ে আল্লাহ তাকে ততক্ষণ সাহায্য করবেন, যতক্ষণ সে অন্যের সাহায্যে মশগুল থাকে। ইসলাম সহানুভূতির ধর্ম। পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতা ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। তাই অন্যকে সাহায্য করার চেতনায় কোনো শ্রেণিভেদ নেই। বড়-ছোট, ধনী-গরিব, আত্মীয়-অনাত্মীয়, স্বজাতি-বিজাতি, মুসলিম-অমুসলিম এসব ব্যবধানের ঊর্ধ্বে উঠে ইসলামের শান্তি ও সৌহার্দ্যের সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমান মিলেমিশে থাকে। যার মধ্যে ভালো কিছু নেই, যে মিলেমিশে থাকতে পারে না। যে ব্যক্তি মানুষের বেশি উপকার করে, সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ।’ (আল-মুজামুল আওসাত : ৫৭৮৭)।
ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন: ইসলাম একটি যুক্তিবান্ধব, বাস্তব ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। মানবজীবনের প্রতিটি বিষয়ের বিধান ইসলামে অত্যন্ত চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। মানবজাতির জন্য ওই বিধান মেনে চলা আবশ্যক। ধর্মীয় অনুশাসন উপেক্ষা করে জীবন অতিবাহিত করলে পদে পদে অশান্তি, অনাচার ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন হতে হবে। পরকালে হতে হবে ভয়াবহ শাস্তির উপযুক্ত। মানবসভ্যতাকে অভিজাতরূপে টিকিয়ে রাখতে এবং মানবজাতির উৎকর্ষ সাধনে ইসলামী শরিয়তের বিধিবিধান মেনে চলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিধিবিধান মেনে চলার জন্য সেগুলোর জ্ঞানার্জন শর্ত। জ্ঞানার্জন ব্যতীত কোনো বিষয় সঠিকভাবে পালন সম্ভব নয়। এ কারণেই ইসলামের প্রথম বাণী ও প্রথম আদেশ ‘পড়ো’। জ্ঞানের বিপরীত নাম ‘মূর্খতা’। পৃথিবীর কোনো মানুষই নিজেকে মূর্খ বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। ফলে সাধারণ দৃষ্টিকোণে জ্ঞানের যেমন প্রয়োজনীয়তা ফুটে উঠেছে, তেমনি ইসলামী দৃষ্টিকোণে ইলম বা জ্ঞানার্জন ফরজ ও অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।
লেখক: ইমাম ও খতিব