শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৪, ০২:১৩ এএম
আপডেট : ২১ জুন ২০২৪, ০৮:৪৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কোরবানির পশুর চামড়া গরিবের অধিকার

কোরবানির পশুর চামড়া গরিবের অধিকার

কোরবানির ঈদ একই সঙ্গে উৎসব, ইবাদত ও ত্যাগের অনুশীলন। কোরবানির ঈদে নামাজ, পশু কোরবানি, তাকবির প্রদানসহ বিভিন্ন আমল রয়েছে। তবে কোরবানির ঈদের সবচেয়ে বড় আমল হলো আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করা। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহ পরীক্ষা করেন—বান্দা কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারে তার রবের জন্য। একই সঙ্গে সামর্থ্যবান ব্যক্তির সম্পদ থেকে পশু কোরবানির মাধ্যমে গরিবের ঘরেও আনন্দ বিলানোর ব্যবস্থা করেন আল্লাহ। তাই তো বিধান হয়েছে—কোরবানির গোশত মালিক একা খাবেন না, পাড়া-প্রতিবেশী অসহায়-গরিবকেও দিতে হবে। কোরবানির গোশত তিন ভাগ করা সুন্নত। এক ভাগ নিজের পরিবারের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-প্রতিবেশীদের জন্য, আরেক ভাগ অসহায়-গরিবের জন্য। এভাবেই কোরবানি মুসলিম সমাজে উদ্যমতা তৈরি করে। ধনী-গরিবের পার্থক্য মিটিয়ে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসে। ঈদের খুশিতে আন্দোলিত করে তোলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে।

কোরবানির ঈদে কোরবানির পশুর সঙ্গে সম্পৃক্ত বড় একটি অনুষঙ্গ পশুর চামড়া। এ ক্ষেত্রেও ইসলামের বিধান রয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি কোরবানি দেয়, তবে সে তার কোরবানি করা পশুর চামড়া নিজে ব্যবহার করতে পারবে। কোরবানিকারী ব্যক্তি ইচ্ছা করলে নিজের কোরবানির চামড়া দাবাগত করে তা ব্যবহার করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। কোরবানির পশুর চামড়া সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কোরবানির পশুর চামড়া দ্বারা উপকৃত হও; তবে বিক্রি করে দিও না।’ আলি (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমাকে তার কোরবানির পশুর দেখাশোনার নির্দেশ দিয়েছেন। পশুর গোশত, চামড়া ও ওপরে থাকা চাদর সদকা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এগুলোর কোনো কিছু কসাইকে দিতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম : ২৪০৭)

এ থেকে বোঝা যায়, যে ব্যক্তি কোরবানি করবে, সে কোরবানির চামড়া বা গোশত বিক্রি করে তার মূল্য নিজের কাজেও লাগাতে পারবে না এবং চামড়া ও গোশত দিয়ে কসাইয়ের মজুরিও দিতে পারবে না। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩০১)। আর যদি দান করতে চায় বা বিক্রি করে দেয়, তবে বিক্রিলব্ধ অর্থ গরিব, এতিম, অসহায়দের দিতে হবে। কোরবানি দাতা নিজে চামড়ার মূল্য খরচ করতে পারবেন না। (ফাতাওয়া কাজিখান : ৩/৩৫৪)। যারা জাকাত, ফিতরা পাওয়ার উপযুক্ত তারাই কোরবানির চামড়ার অর্থ পাওয়ার হকদার। মোটকথা, ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে কোরবানির পশুর চামড়া দান করা উত্তম। তবে কোরবানিদাতা যদি চামড়া ব্যবহার করতে চায়, তবে সে তা ব্যবহার করতে পারবে। তাতে কোনো নিষেধ নেই। আর যদি দান করতে চায় বা বিক্রি করে দেয়, তবে তা গরিব, ইয়াতিম, অসহায়দের দিতে হবে। কোরবানিদাতা নিজে চামড়ার মূল্য খরচ করতে পারবেন না।

প্রতি বছর কোরবানির ঈদে যারা পশু কোরবানি করেন তারা কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা সাধারণত স্থানীয় মাদ্রাসার গরিব ছাত্র, এলাকার এতিম-মিসকিন কিংবা গরিব মানুষের মধ্যে বিতরণ করে থাকেন। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে চামড়ার দাম পাচ্ছেন না কোরবানিদাতারা। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোরবানির চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম এতটাই কমেছে যে, বিক্রির জন্য ক্রেতাই খুঁজে পাওয়া যায় না। লক্ষাধিক টাকার কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি হয় মাত্র ৩০০-৫০০ টাকায়। অনেক জায়গায় আরও কম দামে বিক্রি হয়। যেসব অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, নিঃসন্দেহে তারা এতিম ও গরিবের হক নষ্ট করেছে। অথচ গরিব-মিসকিন ও এতিমের হক ও অধিকার আদায় করা ইসলামের অন্যতম নির্দেশ। এতিমের সঙ্গে কেমন ব্যবহার হবে এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা আপনাকে এতিম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দিন, তাদের সুব্যবস্থা তথা পুনর্বাসন করা উত্তম।’ (সুরা বাকারা : ২২০)। এতিমদের হক নষ্ট করলে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে এবং জাহান্নামে যেতে হবে। আর যারা এতিমের হক আদায় করবে তাদের ঠিকানা হবে জান্নাত।

এতিম প্রতিপালনের দ্বারা শুধু এতিমরাই উপকৃত হয় না বরং এতিম প্রতিপালনকারীর রিজিক প্রশস্ত হয় এবং সে আল্লাহর রহমত ও বরকতপ্রাপ্ত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুর্বল-অসহায়দের কারণেই তোমরা সাহায্য ও রিজিকপ্রাপ্ত হও।’ এতিম প্রতিপালনের মাধ্যমে মানুষের কঠোর হৃদয় নরম ও কোমল হয়। একবার এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে তার অন্তর কঠিন এ মর্মে অভিযোগ করল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, ‘যদি তুমি তোমার হৃদয় নরম করতে চাও তাহলে দরিদ্রকে খানা খাওয়াও এবং এতিমের মাথায় হাত বোলাও।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৭৫৭৬)। এতিমের প্রতি সদয় হওয়া অত্যধিক সওয়াবের কাজ। কোনো এতিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে এতিমের মাথার চুলের সমপরিমাণ সওয়াব অর্জিত হয়। যারা এতিমদের কল্যাণে কাজ করবে তাদের জন্য জান্নাতের ওয়াদা করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব (তিনি তর্জনী ও মধ্য অঙ্গুলি দিয়ে ইঙ্গিত করেন এবং এ দুটির মধ্যে তিনি সামান্য ফাঁক করেন)।’ (বোখারি : ৫৩০৪)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো এতিমকে নিজের মাতা-পিতার সঙ্গে নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা করে এবং সে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করে, তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৮২৫২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘মুসলিমদের ওই বাড়িই সর্বোত্তম, যে বাড়িতে এতিম আছে এবং তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ওই বাড়ি, যে বাড়িতে এতিম আছে অথচ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়।’ (ইবনে মাজাহ : ৩৬৭৯)। এতিমের সাহায্যকারী ও পুনর্বাসনকারীদের মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বিধবা, এতিম ও গরিবের সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে মুজাহিদের সমতুল্য। অথবা তার মর্যাদা সেই রাত জাগরণকারী নামাজির মতো, যে কখনো ক্লান্ত হয় না। অথবা তার মর্যাদা সেই রোজাদারের মতো, যে কখনো ইফতার করে না।’ (মুসলিম : ৫২৯৫)

ইসলামে গরিবের হক আত্মসাৎ করা নিষিদ্ধ। অবৈধ পন্থায় মানুষকে জিম্মি করে বা সিন্ডিকেট তৈরি করে অর্থ উপার্জন করার ব্যাপারে আল্লাহতায়ালার কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অবৈধ পন্থায় গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিয়দংশ জেনেশুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকদের কাছে পেশ করো না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে এতিম-মিসকিনদের জানমালের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। যারা এতিমের ধনসম্পদ আত্মসাৎকারী তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহতায়ালা কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা অন্যায়ভাবে এতিমের ধনসম্পদ ভোগ করে, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে এবং অতিসত্বর তারা অগ্নিতেই প্রবেশ করবে।’ (সুরা নিসা : ১০)

গরিবের অধিকার অন্যায়ভাবে আত্মসাৎকারী কেয়ামতের দিন এমতাবস্থায় উত্থিত হবে যে, আগুনের লেলিহান শিখা তাদের নাক-মুখ দিয়ে উদগিরণ হতে থাকবে। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কেয়ামতের দিন এক সম্প্রদায় নিজ নিজ কবর হতে এমতাবস্থায় উত্থিত হবে যে, তাদের মুখ থেকে আগুনের উদগিরণ হতে থাকবে।’ সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! এরা কারা?’ তিনি বললেন—‘তোমরা কি লক্ষ করোনি যে, আল্লাহতায়ালা বলেন, যারা এতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই ভক্ষণ করে না।’ (ইবনে হিব্বান : ৫৫৬৬)

যখন দেশে চামড়াজাত জুতা, ওয়ালেট, বেল্ট ইত্যাদি ছোট পণ্যের মূল্যও হাজার টাকার ওপরে তখন কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য শয়ের ঘরে নামিয়ে আনা মূলত গরিব-এতিমদের ওপর জুলুম। কোরবানির চামড়ার ন্যায্যমূল্য দিতে যারা কারসাজি করেছে, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যারা এ সম্পদ ভোগ করছে, আল্লাহর দরবারে তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। গরিবের অধিকার আদায় করা বিত্তবানের দায়িত্ব। এটা কিছুতেই গরিবের প্রতি ধনীর দয়া বা অনুগ্রহ নয়। এ অধিকারের সপক্ষে ইসলামই সবচেয়ে জোরালো নির্দেশনা জারি করেছে। বর্ণিত হয়েছে, ‘আর তাদের (ধনীদের) সম্পদে অধিকারবঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার রয়েছে।’ (সুরা জারিয়াত : ১৯)।

এজন্য ইসলাম ধনীর অর্জিত সম্পদে গরিবের জন্য জাকাত, সদকা, নিঃস্বার্থ ঋণদান, অধীনদের ভরণপোষণ, আত্মীয়স্বজনের অধিকার, প্রতিবেশীর অধিকারসহ বিভিন্ন বিধান প্রবর্তন করেছে। কারণ পৃথিবীর সমুদয় সম্পদের ওপর সামষ্টিকভাবে সব মানুষের অধিকার রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের (সব মানুষের) কল্যাণে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা বাকারা : ২৯)।

তাই বিত্তবানরা সুখে-দুঃখে সমাজের কল্যাণে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সেবায় এগিয়ে আসবেন—এটাই ধর্ম ও মানবতার দাবি।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১০

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১১

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১২

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৩

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৪

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৫

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৬

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

১৭

‘এক ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে আরেক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’

১৮

জুলাই বিপ্লবে আহত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বাবুকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ড

১৯

মাদকাসক্ত ছেলেকে কারাগারে দিলেন মা

২০
X