মেজর (অব.) ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৪, ০২:১৩ এএম
আপডেট : ২১ জুন ২০২৪, ০৮:৪৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আমলাদের নৈতিক স্খলন কি মানসিক রোগ

আমলাদের নৈতিক স্খলন কি মানসিক রোগ

১৯৮৪ সালের কথা। আমরা তখন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে (বিএমএ) জেন্টলম্যান ক্যাডেট (জিসি) হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম। সে সময় বিএমএতে একসঙ্গে চারটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ হতো। আমরা ছিলাম প্রথম টার্মে অর্থাৎ সবচেয়ে জুনিয়র। হঠাৎ একদিন দুপুরের পরপর জরুরি ভিত্তিতে আমাদের চার ব্যাচকেই দ্রুত প্যারেড গ্রাউন্ডে জমায়েত হওয়ার আদেশ এলো।‌ শুনলাম তো ‘প্রোমালগেশন প্যারেড’ হবে। কিছুই বুঝলাম না, শুধু ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম প্যারাগ্রাউন্ডের দিকে। পরে জানলাম, ইংরেজি ‘প্রোমালগেশন’ শব্দের অর্থ একটি বিচারিক রায় বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত সবাইকে জানানো ও জনসম্মুখে কার্যকর করা।

সেদিন ‘প্রোমালগেশন প্যারেড’ আয়োজন করা হয়েছিল আমাদের সিনিয়র ব্যাচের দুজন ক্যাডেটের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে। এ সিনিয়ররা অর্থাৎ তাদের পুরো ব্যাচ প্রায় দুই বছর বিএমএতে জীবনবাজি রেখে কঠোর প্রশিক্ষণ শেষ করেছিলেন। অল্প কয়েক দিন পরেই শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ শেষ করে রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে তাদের শপথ নেওয়ার কথা ছিল। তারপরই যোগ দেবেন সেনাবাহিনীর নবীন অফিসার হিসেবে।

তখন সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি একটানা দুই বছর মেয়াদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক সনদ অর্জনের জন্য বিজ্ঞান বা কলা বিষয়ে পড়তে হতো। ওই দুজন সিনিয়র ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র। তাত্ত্বিক পরীক্ষা শেষে তারা রসায়ন পরীক্ষাগারে ব্যবহারিক পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। এমন সময় একজন প্রশিক্ষক তাদের কাছে রসায়নের কিছু সূত্র লেখা কাগজ দেখতে পান, যা পরীক্ষাগারে নেওয়ার নিয়ম ছিল না। ঊর্ধ্বতন মহলকে জানানো হলে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিএমএ থেকে তথা সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত হয়।

সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমরা অর্থাৎ চারটি ব্যাচের ক্যাডেটরা বিশাল প্যারেড গ্রাউন্ডের তিন দিক ঘিরে দাঁড়ালাম।‌ খোলা দিকটায় দাঁড়ালেন আমাদের কয়েকজন প্রশিক্ষক। দোষী সাব্যস্ত দুজনকে এরপর হাজির করা হলো সবার সামনে। তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ ও বিচারের রায় পড়ে শোনানো হলো। সিনিয়র একজন অফিসারের আদেশে এগিয়ে এলেন আরেকজন প্রশিক্ষক। হিংস্রতার সঙ্গে ওই দুজন ক্যাডেটের পোশাক থেকে সামরিক বাহিনীর ঐতিহ্যগত চিহ্ন যেমন কাঁধের ব্যাজ (এপুলেট), মনোগ্রাম (ফরমেশন সাইন) প্রভৃতি টেনে ছিঁড়ে ফেললেন। ব্যান্ডের তালে তালে তাদের দুজনকে হাঁটানো হলো আমাদের সামনে দিয়ে। সেখান থেকেই তাদের একটি গাড়িতে তুলে বের করে দেওয়া হলো বিএমএ থেকে।

তাদের জীবন থেকে দুটি বছর চলে গেল কোনো প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন ছাড়াই। দুই বছর পরও তারা এইচএসসি পাসই রয়ে গেলেন। বাবা-মার স্বপ্ন, সামাজিক অবস্থান সবকিছু মুহূর্তেই চুরমার হয়ে গেল। বেশ কয়েক বছর পর সেনাবাহিনীর একজন মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সুযোগ ঘটেছিল। তার ব্যাখ্যামতে, সেনা অফিসারদের সামনে অবৈধভাবে কিছু অর্জনের অনেক সুযোগ আসবে। এমনকি সামান্য একটি গোপন তথ্যের বিনিময়ে অনেক বড় অঙ্কের অর্থ বা সম্পদের প্রলোভন বিচিত্র নয়। এ অবস্থায় কেউ যদি মাত্র কয়েক নম্বর বেশি পাওয়ার জন্য নিজের সততার সঙ্গে আপস করে পরীক্ষার সময় কোনো অনৈতিক কিছু করে, তবে দেশ-জাতি বা সেনাবাহিনী তার কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করতে পারে? তিনি আরও বলেন, এটি ‘ন্যারসিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার’ (Narcissistic Personality Disorder) নামের একটি মানসিক রোগও হতে পারে, যা নীতি-নৈতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে চোখ বন্ধ করে শুধু ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার ও নিজের অর্জন বৃদ্ধির দিকে মানুষকে ধাবিত করে। মনোবিজ্ঞানীর ব্যাখ্যা সেদিন আমার মনে ঝড় তুলেছিল, কারণ তখন ছিল স্বৈরাচারের যুগ।

চাকরি জীবনে আরেকটি ঘটনা মনে দাগ কেটেছিল। একদিন জানলাম আমাদের সিনিয়র একজন অফিসার অকালে চাকরি হারিয়েছেন। তিনি কারও অফিস বা বাসায় গেলে কিছু কিছু জিনিস লুকিয়ে নিয়ে আসতেন। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, এটি একটি মানসিক রোগ। নাম ক্লিপটোমেনিয়া (Kleptomania)। এ রোগে আক্রান্তরা যে শুধু কোনো দামি বা লোভনীয় কিছু সরিয়ে ফেলে, এমনটি নয়। তারা হয়তো এর চেয়ে দামি কিছু কেনার ক্ষমতা রাখেন। তথাপি মানসিক অসুস্থতার কারণে অন্যের কিছু নিয়ে আসেন।

ওই সিনিয়র অফিসার আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। বিএমএতে প্রশিক্ষণের সময় থেকেই তার সঙ্গে সখ্য ছিল। একসঙ্গে বহুবার ক্যানটিন, অফিসার্স মেস বা বাইরের রেস্তোরাঁয় খেয়েছি। কোনোদিন বিল দিতে দেননি। বিল দিতে গেলেই ‘সাবধান’ (অ্যাটেনশন) কমান্ড দিতেন, যার অর্থ হাত-পা সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকো আর সামনে তাকাও। এমন অফিসারের চাকরি হারানোর সংবাদে কষ্ট পেয়েছিলাম। কারণ ততদিনে অনেক রথী-মহারথীর অগাধ সম্পদ অর্জনের খবর নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছিল। তারা প্রায় সবাই পারিবারিক ব্যবসা বা উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পদের মালিক বলে দাবি করেছেন। কেউ কৃষি বা মৎস্য চাষে ভাগ্য বদল করেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিক সম্পদশালী ঘরের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়তে যায়, পুলিশ বা প্রতিরক্ষা বাহিনীর কঠোর প্রশিক্ষণ, নিয়ন্ত্রিত জীবন ও সীমিত বেতন তাদের আকর্ষণ করে না। কোন যুক্তিতে পারিবারিক ধন-সম্পত্তির কথা বলা হয়, তা তদন্ত করে না কেউ। যে শ্বশুর নিজ কন্যা বা জামাতাকে বাড়ি-গাড়ি বা জমি উপহার দেন, তার আয়ের উৎস বা ইনকাম ট্যাক্স ফাইল খোঁজে কয়জন? কৃষি আর মৎস্য চাষেই যদি এত আয়-রোজগার হতো, তবে গ্রামের ছেলেগুলো জমি বিক্রি করে বিদেশে শ্রমিক হতো না।

সাম্প্রতিককালে ১৫ লাখ টাকার ছাগল, বংশ মর্যাদাসম্পন্ন কোটি টাকার গরু, হালি ধরে ফ্ল্যাট ক্রয়, তরুণ টিকটকারকে নিয়ে মধ্যবয়সী নারীর প্রচারণা, কন্যা বা নাতনির সমবয়সীদের বিয়ে করে সগৌরবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিচরণ নিয়ে একটু জানার চেষ্টা করলাম। জানলাম এসবও এক ধরনের মানসিক রোগ, নাম ‘হিস্ট্রিওনিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার” (Histrionic Personality Disorder)।

ইদানীং দেশের শীর্ষ পদে থাকা অনেকের নৈতিক স্খলনজনিত প্রামাণ্য প্রতিবেদন প্রচারিত হচ্ছে। একজন সাবেক মন্ত্রী বিদেশের ২৬০টি বাড়িঘর কিনেছেন বলেও খবর বেরিয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি, সাবেক সেনাপ্রধান, সাবেক পুলিশপ্রধান, সাবেক ব্যাংকের চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রধান প্রকৌশলী, সিনিয়র রাজস্ব কর্মকর্তা কিংবা সরকারি চিকিৎসকরা শুধু ব্যক্তিই নয়, এক একটি প্রতিষ্ঠান। ‘ব্যক্তির দায় সরকার বা বাহিনী বা প্রতিষ্ঠান নেবে না’ বলে ইদানীং দাবি করা হয়। তাদের জানা প্রয়োজন, কখন একজন ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

গুণীজনদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে যাওয়ার কথা। তবে বাস্তবে যা হচ্ছে, তা দেখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা ‘দুই বিঘা জমি’র দুটি চরণ মনে পড়ল—‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভূরি ভূরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’। স্কুল জীবনে আমাদের পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাসে ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, টাইফয়েড প্রভৃতি রোগ ও তার প্রতিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওপরে উল্লিখিত মানসিক রোগ ও তার প্রতিকার পাঠ্য পুস্তকের সাম্প্রতিক সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করলে কেমন হয়?

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

ইমেইল: [email protected]

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১০

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১১

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১২

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৩

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

১৪

আশুলিয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক সমাবেশ

১৫

কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

১৬

পাকিস্তানের জলসীমায় বিপুল তেল-গ্যাস মজুতের সন্ধান

১৭

বিসিবির দুর্নীতির তদন্ত দাবি সাবেকদের

১৮

পাবিপ্রবি ছাত্রলীগ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ

১৯

জেল খেটেছি তবু শেখ হাসিনার মতো পালিয়ে যাইনি : সাবেক এমপি হাবিব

২০
X