১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে শুরু হওয়া আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, যা আরবদের কাছে ‘অক্টোবর যুদ্ধ’ এবং ইসরায়েল তথা পশ্চিমাদের কাছে ‘ইয়ম কিপ্পুর’ যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধের অংশ হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছিল সৌদি আরবসহ অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী আরব দেশ। তেল সরবরাহ বন্ধ করার ফলে পশ্চিমা বাজারে তেলসহ অন্যান্য পণ্যের দাম আকাশ ছুঁতে শুরু করে। ১৯৭৪ সালে আমেরিকার মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। অর্থনীতি ব্যাপক চাপে পড়ে যাওয়ায় সৌদি আরবের সঙ্গে ১৯৭৪ সালের ৮ জুন তথাকথিত নিরাপত্তার বিনিময়ে ডলার ছাড়া অন্য কোনো মুদ্রায় কারও কাছে তেল বিক্রি না করার শর্তে চুক্তি করে আমেরিকা।
চুক্তির ফলে আমেরিকার অনেক সুবিধা হয়ে যায়, তেলের সরবরাহ নিরঙ্কুশ হয়; সৌদি আরবসহ প্রায় পুরো আরবের ওপর নিয়ন্ত্রণ আসে; আরব দেশগুলো মার্কিন সংস্কৃতি এবং পণ্যের বাজারে পরিণত হয়। তেলের বিনিময়ে কাগজ ছাপিয়ে দিয়ে দিলেই হয়। তাও সব দিতে হয় না। অর্ধেকের বেশি জমা থাকে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ১৯৭৩ সাল থেকে ডলারের পেছনে স্বর্ণ বা অন্য কোনো কিছুর সমর্থন নেই। তার ওপর একটু বেকায়দায় পড়লেই আমেরিকা ডলার ছাপিয়ে বাজারে ছেড়ে মুদ্রাস্ফীতি ঘটায়, যার থেকে রেহাই নেই অনেক দূরে থাকা আমাদের মতো ছোট অর্থনীতির দেশেরও। এ চুক্তিটির মেয়াদ গত ৭ জুন শেষ হয়ে গেলেও তা আর নবায়ন করেনি পৃথিবীর এক নম্বর তেল রপ্তানিকারী দেশটি। ফলে সৌদি আরব এখন যে কোনো দেশের সঙ্গে যে কোনো মুদ্রায় তেলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র কেনাবেচা করতে পারবে। আমেরিকার চুক্তি নবায়ন না করায় শুধু সৌদিরই নয়, দাসত্ব ঘুচেছে সব তেল উৎপাদনকারী দেশের। যুগান্তকারী নেতায় পরিণত হয়েছেন সে দেশের মুকুটপ্রাপ্ত রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমান।
আমেরিকার সঙ্গে ৫০ বছর আগে করা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা সৌদির জন্য যুগান্তকারী ঘটনা। মোহাম্মদ বিন সালমান রাজনীতিতে আসার পর থেকেই বদলে যেতে শুরু করে সৌদি-আমেরিকা সম্পর্ক। তুর্কির সৌদি দূতাবাসে আমেরিকার প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার সৌদি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকে কেন্দ্র করে সৌদি-আমেরিকা সম্পর্ক চরমে পৌঁছায়। সে পরিস্থিতি এবং বদলে যাওয়া ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সৌদি আরবের সম্পর্কোন্নয়ন ঘটে চীনের সঙ্গে। চীনের মধ্যস্থতায় দীর্ঘদিন ধরে মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকা ইরানের সঙ্গে নতুন করে শুরু হয় কূটনৈতিক সম্পর্ক; সৌদি পায় ব্রিকস সদস্য পদ; বেড়ে যায় দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন, বিনিয়োগ; যুক্ত হয় পশ্চিম ছাড়া বাকি দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে।
সৌদির এ চুক্তি নবায়ন না করাটা সম্ভব হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী নতুন বিশ্ববাস্তবতায়। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় ন্যাটো, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং তাদের মিত্ররা। আমদানি-রপ্তানি, গ্যাস লাইন, তেল লাইন, ইত্যাদি বন্ধ করা ছাড়াও ডলারের মাধ্যমে সব দেশের সঙ্গে লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং তাদের কাছে রাখা রাশান আমানতের খেয়ানত করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই চীনের বাণিজ্যের ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা এবং করারোপ করেছে তারা। তারও আগে ইরান, সিরিয়া, লিবিয়ার টাকা মেরে দিয়েছিল বিশ্ব মোড়লের তকমা পাওয়া দেশটি। বিশ্ব মোড়ল তার মাস্তানির অস্ত্র হিসেবে বাণিজ্য এবং ডলারকে অন্যায্যভাবে ব্যবহার করেছে বহু দেশের ওপর। রাশিয়ার বাণিজ্য এবং আমানত আটকে দেওয়ার পর পশ্চিমাদের কাছে আমানত রাখা আর কেউ নিরাপদ মনে করছে না। বিপজ্জনক মনে করছে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণাধীন বিশ্ববাণিজ্যের সামগ্রিক ব্যবস্থাকে। এতসব কারণে ডলারের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে এসে স্বাবলম্বী হতে চাইছে সবাই। ইউরো চালু করার মাধ্যমে ইউরোপ অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে ডলারের রাজত্ব থেকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ডলার বিশ্ববাণিজ্যকে এতটাই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে যে, ডলার থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। তবুও চেষ্টা করছে অনেকেই। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ প্রচেষ্টা বেড়ে যায় বহুগুণে। বিশ্ববাণিজ্যে চালু হয়ে যায় নতুন শব্দ ‘ডিডলারাইজেশন’। চীন, ভারত, রাশিয়া, ব্রাজিল, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়াসহ বড় বড় সব দেশ ডলারে বাণিজ্য এবং সঞ্চয় করা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। চালু করে নিজ নিজ মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের। রাশিয়া-চীন, রাশিয়া-ভারত, ইরান-চীন, ইরান-ভারত, ব্রাজিল-চীন, ইত্যাদি লেনদেনগুলো এখন আর ডলারের মধ্যস্থতায় হচ্ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আমাদের বৈদেশিক লেনদেন এবং বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় কীভাবে করা উচিত এ নিয়ে বছর দুয়েক আগে লিখেছি সমকালে। আমরাও এখন চীন, ভারত এবং রাশিয়ার সঙ্গে অনেক লেনদেন ডলার ছাড়াই করছি। বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে ডলারের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাজারে আসছে ‘ব্রিকস মুদ্রা’। আগামী অক্টোবরে এ মুদ্রা চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কখনো এতটা চাপে পড়েনি মুদ্রার রাজা, ডলার।
ডলারের এমন কঠিন সময়ে সৌদির চুক্তি নবায়ন না হওয়ায় তেলের বাজার হাতছাড়া হয়ে গেল ডলারের। বিশ্ববাণিজ্যে জ্বালানি তেলের অংশ ১৩ শতাংশ বা প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এত বড় বাজারে এখন আর নিয়ন্ত্রণ নেই ডলারের। এক ধাক্কায় অনেকখানি দুর্বল হয়ে গেল ডলার। ডলার দুর্বল হলে বিশ্ববাণিজ্যে আমেরিকার মাস্তানি করার সুযোগ কমে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে শুধু ডলার ছাপিয়ে সারা দুনিয়া থেকে বাকিতে মাল কেনার সুযোগ। আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পৃথিবীর সব দেশের দেওয়া ঋণের পরিমাণ শুধু বেড়েই চলে। কমে না। আমেরিকা কারও ধার শোধ করে না। সুযোগ পেলেই মেরে দেয় অন্যের জমা রাখা টাকা। ডলারে সঞ্চয় জমা রাখার প্রবণতাও কমে আসছে। আমেরিকার ট্রেজারি বন্ড না কিনে এখন সোনা কিনছে অনেক দেশ। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সোনা কিনেছে চীন ও ভারত। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-এপ্রিল সময়ে ভারত ২০২২ সালের পুরো বছরের তুলনায় দেড়গুণ বেশি সোনা কিনেছে। চীন ২০২৩ সালে কিনেছে ২২৫ টন, যা ১৯৭৭ সালের পর সবচেয়ে বেশি। সমগ্র পৃথিবী ২০২৩ সালে সোনা কিনেছে ১ হাজার ৩৭ টন; ২০২২ সালে কিনেছে ১ হাজার ৮২ টন, যা ১৯৫০ সালের পর সবচেয়ে বেশি। পশ্চিমাদের বিশ্বাস নেই। সোনা কিনে এখন আর কেউ পশ্চিমা দেশে ফেলে রাখতে ভরসা পাচ্ছে না। মাত্র কয়েক দিন আগে ১০০ টন সোনা দেশে এনেছে ভারত। পুরোদমে চলছে ডিডলারাইজেশন।
আমেরিকার দাসত্ব চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রভাব শুধু সৌদি-আমেরিকা সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বদলে যাবে বিশ্বরাজনীতি এবং বাণিজ্যের বর্তমান কাঠামো, পদ্ধতি, নেতৃত্ব। বহুকেন্দ্রিক পৃথিবী বিনির্মাণে মাইলফলক হয়ে থাকবে মার্কিন বলয় থেকে সৌদির এ বেরিয়ে আসা। পূর্ব-পশ্চিম রাজনীতির মিলনস্থলে অবস্থান করা উদীয়মান অর্থনীতি বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে সৌদির দাসত্ব মোচন। তার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন করার এখনই সময়।
লেখক: চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট