বিএনপি নিজের ঘরে অ্যাকশন শুরু করেছে। ঢাকাসহ চার মহানগর কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটিতেও বড় রদবদল করল। বোঝা যাচ্ছে, একই প্রক্রিয়ায় দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটিসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক স্তরে পরিবর্তন আসছে।
বিএনপির আন্দোলন নিয়ে একটি কথাই চালু আছে যে, ঈদের পর আন্দোলন। তবে সেটা কোন ঈদ, তা কোনোদিন স্পষ্ট হয়নি নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের কাছে। এবার ঈদের আগেই অবশ্য অ্যাকশনে গেছে দলটি। দলের নেতাকর্মীরা যখন ঈদুল আজহা উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই দলের হাইকমান্ড আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, দলের নানা কমিটিসহ দলের যুব ও ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল এবং যুবদলে রদবদল করা হয়েছে।
বিএনপি গত ১৭ বছর ধরে গণতন্ত্রের আন্দোলন করছে। দলের একটি ভালো জনভিত্তি থাকলেও, গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে বিএনপি বিশাল এক জোট করেও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে চেয়েছিল, তা পারেনি। কিন্তু কেন পারেনি, সেটি স্পষ্টও করেনি দেশবাসীর কাছে, এমনকি কর্মীদের কাছেও। ব্যাপক আন্দোলন করেছে, সহিংসতা মাত্রাছাড়া হয়েছে, কিন্তু কোনো পরিস্থিতিতেই সরকারকে কোণঠাসা করতে পারেনি। বরং আমরা দেখেছি, গত বছর ২৮ অক্টোবরের পর নিজেরাই সরকারি দমননীতিতে কোণঠাসা হয়েছে। বিএনপি নেতারা একটা কথা বলতেন যে, তাদের কাছে এমন একটি অস্ত্র আছে, যার প্রয়োগে সরকার সব দাবি মানতে বাধ্য হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই অস্ত্র বা কৌশল সম্পর্কে মানুষকে কিছুই বলা হয়নি।
কাজেই বলা যায়, ভোটের আগে বিএনপির আন্দোলন তত্ত্ব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, স্পষ্ট হয়নি। আসলে বিএনপি নেতৃত্ব ও দলীয় কর্মীরা মানুষের কাছে গিয়ে তাদের মনের কথা বোঝার চেষ্টাই করেননি। দলের ভেতর একটা বড় আস্থা ছিল আমেরিকাসহ বিদেশিরা একটা কিছু করবেই, বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাবেই। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অতি সক্রিয় তৎপরতা, মার্কির ভিসা নীতি, স্টেট ডিপার্টমেন্টের নানা উদ্যোগ, ডোনাল্ড লুসহ আমেরিকার বড় কর্তাদের আসা-যাওয়া একটা বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করেছিল নির্বাচনের আগে। বলা বাহুল্য, তার পুরোটাই ছিল বিএনপির অনুকূলে। কিন্তু আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি বিএনপি। তবে কি বলতে হয় মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না তাদের প্রতি?
সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতা নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা চলছে বিএনপিতে। কিন্তু কেউই বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেননি তারেক রহমানের ভয়ে। কেন্দ্রীয় নেতারা দোষ চাপান মাঠপর্যায়ের নেতৃত্বের ওপর, বলে থাকেন যে, তারা আন্দোলনে গতি সৃষ্টি করতে পারেননি। অন্যদিকে, তৃণমূলের নেতাকর্মীর অধিকাংশই মনে করেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও পরিকল্পনার অভাবে আন্দোলনে বারবার হোঁচট খেয়েছে দল। আন্দোলন সংগ্রামে নেতাদের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করছেন এখন তারেক রহমান—এমন একটা কথাও রটেছে বড় করে।
আসলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর দল বিপর্যস্ত। এখন পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেই প্রক্রিয়ায় মেয়াদোত্তীর্ণ, ব্যর্থ সব কমিটি ভেঙে দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে বিএনপি, অথচ কমিটিগুলো একে একে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে একেবারে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। জাতীয় কাউন্সিল ছাড়াই বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে বড় ধরনের রদবদল করা হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একক ক্ষমতাবলে কমিটি পুনর্গঠন, বাতিল, রদবদল শুরু করেছেন। এ ক্ষেত্রে দুয়েকজন আস্থাভাজন নেতাদের বেছে নিয়েছেন তিনি। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে এ বিষয়ে আলোচনাও হয়নি বলে জানা গেছে। এসব পদায়নের বিষয়ে দলের মহাসচিবসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারাও কিছু জানতেন না।
বিএনপিতে কোনো কমিটি গঠনে একটি ফোরামের অনুমোদন নিতে হয়। এবার করা হয়নি। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সর্বশেষ কাউন্সিল হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। আট বছরেরও বেশি সময় ধরে কাউন্সিল না হওয়ায় এ কমিটির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। তিন বছর পরপর কাউন্সিল করার বিধান রয়েছে গঠনতন্ত্রে। এবার কাউন্সিল না করেই প্রেস রিলিজ দিয়ে কমিটিতে রদবদল আনা হলো। এতে এটি স্পষ্ট হলো যে, বিএনপিতে আপাতত কাউন্সিলের কোনো সম্ভাবনা নেই।
বিএনপি নেতৃত্ব সবচেয়ে চিন্তিত তার বিদেশবিষয়ক কমিটি নিয়ে। বিএনপির বর্তমান বিদেশবিষয়ক কমিটি ভেঙে দিয়ে দুটি কমিটি গঠন করেছে দলটি। এগুলো হলো—চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি এবং স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি। ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি তারেক রহমানের নির্দেশে বিদেশবিষয়ক উইং ভেঙে দিয়ে ফেব্রুয়ারিতে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে ২১ সদস্যের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি পুনর্গঠন করে বিএনপি। এরপর একাধিকবার সদস্য বাড়ানো হয় কমিটিতে। ওই কমিটিতে স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু থাকলেও এবার জায়গা হয়নি তার। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকেও ড. আবদুল মঈন খান বা শামা ওবায়েদের তুলনায় গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়েছে। পুরো আন্দোলনেই ছিল বিদেশনির্ভরতা। মনে হচ্ছে সেই ফোবিয়া থেকে দল বের হতে পারেনি। বিদেশবিষয়ক দু-দুটি কমিটি দলের মনসতত্ত্ব প্রকাশ করে যে, দেশের জনগণের সমর্থন খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিদেশিদের সমর্থন বেশি প্রয়োজন তাদের। হঠাৎ করে দলের ভেতরে এই ঝড় দলে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। দলের নেতারা অবশ্য মিডিয়ার সামনে বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে, এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ক্ষমতা ছাড়ার পর চারটি জাতীয় নির্বাচনের দুটিতে পরাজয় আর বাকি দুটিতে অংশ না নেওয়ায় ব্যাকফুটে আছে বিএনপি। বিশেষ করে দলের ভেতরে অতি আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল এবার দ্বাদশ নির্বাচন ঘিরে। সরকার বিএনপির দাবি মানতে বাধ্য হবে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলেই ক্ষমতায় ফিরবে দলটি, এমন বিশ্বাসই ছিল সব স্তরে।
কিন্তু তা হয়নি বলেই এখন কমিটি ভাঙার হিড়িক। প্রশ্ন হলো, কমিটি গড়া বা ভাঙার তরিকা তো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হলো না। প্রায় সব নেতাকর্মীকে অন্ধকারে রেখে হঠাৎ কমিটি করে ফেলা, কাউকে রাখা, কাউকে বাদ দেওয়া, কাউকে পদোন্নতি, কাউকে পদাবনতি—সবই হচ্ছে একক ব্যক্তির ইচ্ছায়। অবশ্য বলা হচ্ছে, বিএনপি দলটি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানির মতো। চেয়ারপারসন হিসেবে তারেক রহমানের হাতেই সব ক্ষমতা। এই দলের নেতাকর্মীদের কথা বলার কোনো স্পেস নেই।
বিএনপি গণতন্ত্রের কথা বলে। দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অথচ নিজেদের দলেই গণতন্ত্র চর্চা করতে পারছে না। দলীয় প্রধান যা বলছেন তা-ই বেদবাক্য। তবে সেটা যে শুধু বিএনপিতে তা নয়, প্রায় সব দলেই। দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট চলছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ কোনো দলে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকা।
প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির কাছে প্রত্যাশা ছিল যে, একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন সংগ্রামের সফলতা, ব্যর্থতা বিবেচনা করে, বিশ্লেষণ করে দল পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করবে। এভাবে মধ্যরাতে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কমিটিগুলোতে পরিবর্তন করায় এ নিয়ে সারা দেশে দলের অভ্যন্তরে নানা ধরনের আলোচনা ও পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। কেউ কেউ খবরটি শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তবে কেউই প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারছে না রোষানলে পড়ার ভয়ে।
বলা হচ্ছে, বিভিন্ন কমিটি তছনছ করে দেওয়ার পর তারেক রহমানের এবারের মনোযোগ বিএনপির স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠনের দিকে। স্থায়ী কমিটিতে পাঁচটি শূন্য পদ রয়েছে। এ ছাড়া অন্তত তিনজন স্থায়ী কমিটির সদস্য এখন দায়িত্ব পালনে রীতিমতো অক্ষম। এ বাস্তবতায় পুরো কমিটি পুনর্গঠন করতে চান তারেক।
বিএনপির নিজেদের ভেতরকার এ ঝড় নিয়ে রাজনৈতিক মহলে অনেক কথা হচ্ছে। দল থেকেই বলা হচ্ছে, সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার কারণেই এ অ্যাকশন কার্যক্রম। প্রশ্ন হলো যে, আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বলা হচ্ছে, সেই দায় তো সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ওপরই বর্তায়। কারণ আন্দোলন সফল হলে তার কৃতিত্ব তো তিনিই নিতেন। আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে নতুন দিশা খুঁজছে বিএনপি, তবে সেটা শুধু কমিটি ভেঙে ফেলেই হচ্ছে না, দেখতে হবে অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক পরিসর কতটা সৃষ্টি করতে পেরেছে দলটি।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল