ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৪, ০২:০৩ এএম
আপডেট : ১৫ জুন ২০২৪, ০৭:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাজস্ব আদায়ের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে

রাজস্ব আদায়ের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার কর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ আয় আসবে মূলত আয়কর, ভ্যাট এবং আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক থেকে। বাজেটের এ ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ খাত থেকেই বেশি ঋণ নেওয়া হবে; যার পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আর বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা হয়েছে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি নতুন কিছু নয়। বিগত সরকারের আমল থেকেই চলে আসছে। তবে দিন দিন ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছেই, সেইসঙ্গে বাড়ছে ঋণের বোঝা। অন্যদিকে সরকার প্রতি বছর রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে, তা পূরণ হচ্ছে না। রাজস্ব ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।

এদিকে আয়কর দাতা বাড়াতে গত কয়েক বছর এনবিআরের তোড়জোড়ের ফলে বর্তমানে টিআইএনধারীর সংখ্যা ১ কোটি ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে। আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার পরিমাণও অনেকটুকু বেড়েছে। তবে টিআইএনধারীর সংখ্যা যত বেড়েছে, রিটার্ন দাখিলকারীর প্রকৃত সংখ্যা এবং প্রকৃত আয়কর দেওয়ার আশাব্যঞ্জক নয়। প্রতি বাজেটে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা দেওয়ায় রাজস্ব আয়ে সাফল্য আসছে না। কেন এটা হচ্ছে, সেটি দেখা দরকার। এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অনেক জায়গায় আমরা শুনি, অনেকে অর্থসম্পদের মালিক হচ্ছে, অনেকে ঋণখেলাপি রয়েছে, তারা কতটুকু আয়কর দিচ্ছে, তাদের আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আয়কর দিচ্ছে কি না, অর্থাৎ অতি ধনীদের আয়কর তাদের সম্পদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, সেই জায়গাটায় অনেক বড় ফাঁকি রয়েছে। যারা মধ্যবিত্ত, তারা সৎভাবে আয়কর দেয়। নিম্নবিত্তদের কাঁধে ভ্যাটের অনেক বড় বোঝা কাঁধে পড়ে। অর্থাৎ তারাও রাজস্ব দিচ্ছে। কিন্তু উচ্চবিত্তরা হয়তো দিচ্ছে, কিন্তু ছিটাফোঁটা; ওই জায়গাটা বাড়াতে হবে।

চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল সময়ে রাজস্ব আহরণ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ বেড়ে ২ লাখ ৮৯ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। গত ১০ মাসে আদায় হওয়া রাজস্বের পরিমাণ চলতি অর্থবছরের জন্য নির্ধারণ করা সংশোধিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার ৭০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা কমিয়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অর্থবছরের শেষ দুই মাসে এনবিআরকে ১ লাখ ২০ হাজার ৬২২ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি মাসে আদায় করতে হবে ৬০ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, যা বর্তমান আদায়ের পরিমাণের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের জটিলতা ঠিক না করে রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব নয়। এটি এনবিআরের হাতেও নেই।

কর আদায়ের সক্ষমতা বাড়াতে পারলে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে ব্যয় করার সক্ষমতা বাড়বে। আরও বেশি ধনী মানুষকে করের আওতায় আনতে হবে। আয়কর রিটার্ন সাবমিট করাকে অনেক কিছুর সঙ্গেই বাধ্য করতে হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনেকের সক্ষমতা বেড়েছে, তাদের কিছু ইনসেনটিভ দিয়ে আয়করের আওতাভুক্ত করতে হবে।

রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। কেন মানুষ করের আওতায় আসছে না, কেন কর ফাঁকি দিচ্ছে, সে বিষয়গুলো খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের অর্থনীতির দিকে তাকালে বোঝা যায়, নির্বাচনের প্রার্থীদের মনোনয়ন ফরম কেনা থেকে শুরু করে তাদের আয়ের বিবরণী দেখলেই বোঝা যায় সম্পদ কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে। আয়কর যারা ফাঁকি দিচ্ছে, তারা বৈষম্য সৃষ্টি করে ফেলছে সমাজে। কারণ তাদের হাতে টাকা-পয়সা চলে আসায় তারা সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়াচ্ছে, নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী জায়গাটিও দখল করে ফেলছে। মানুষকে কর দিতে বাধ্য করতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন রয়েছে। মানুষ যাতে কর দিতে আসে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যারা নেবেন, তারাই যদি কর না দেন, তাহলে তো হবে না। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত বিদেশি যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে, তাদের কাছ থেকে যেন কর আদায় করা হয় সেদিকে নজর দিতে হবে।

এখানে বাজেট বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের, বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আয় ও ব্যয়ের খাতটি বাস্তবায়নে কারা সংশ্লিষ্ট রয়েছে, সেটি দেখতে হবে। আয়ের ক্ষেত্রে যেমন এনবিআর আছে, অন্যান্য সংস্থাও রয়েছে আর ব্যয়ের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় যুক্ত। মন্ত্রণালয় ও প্রকল্পভিত্তিক কঠোর পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন দরকার। বাজেট বাস্তবায়নে সার্বিক সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে আর্থিক ও রাজস্ব খাতে সংস্কার করতে হবে। বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে হলে অর্থনীতিকে মেরামত করারও প্রয়োজন রয়েছে।

বাজেটে ঘাটতি কম হলে সেটি কাটিয়ে ওঠা যায়। কিন্তু ঘাটতি যদি বেশি হয়ে যায়, তাহলে সেটি অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ায়। সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ঠিক রাখতে হলে অবধারিতভাবে কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। কেননা বাংলাদেশকে কেউই সহজ ঋণ দিতে চাচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশের রিজার্ভ কম। প্রতি বছর এ ঘাটতি হওয়া মানেই হচ্ছে অর্থনীতির ওপর ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাওয়া। সেটা দেশি হোক আর বিদেশি হোক। সেই ঋণের বোঝা ও কিস্তি বাজেটের সিংহভাগ খেয়ে ফেলবে। সুতরাং বাজেটে ভারসাম্য হওয়ার খুব দরকার ছিল। দুটি কারণে বাজেটের আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য আসছে না।

ব্যয়ের বাজেট বাড়ানো হচ্ছে। সেখানে সুশাসন বা কৃচ্ছ্রসাধন বা ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়া হচ্ছে না। তার বিপরীতে উচ্চাভিলাষী বাজেট দেওয়া হচ্ছে এবং খরচ বাড়িয়েই যাচ্ছি। অবিলম্বে অনুশাসনহীন ব্যয় বন্ধ করতে হবে। সরকারি বিভিন্ন কেনাকাটার ক্ষেত্রে যেন খরচ বাড়িয়ে কেনা না হয়, যে বছরের প্রকল্প সে বছরেই শেষ করতে হবে। প্রকল্পের সময় বাড়িয়ে খরচ বাড়ানো যাবে না। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাড়িয়ে সরকার গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় বরাদ্দ দিতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন।

সরকার প্রশাসনে কিছু সংস্কার করুক, যেটার মাধ্যমে ব্যয় কমানো সম্ভব। এতগুলো মন্ত্রণালয় রাখার কোনো দরকার নেই। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মতো দপ্তর রেখে রেখে বড় ধরনের ব্যয় করা হচ্ছে। এগুলো ধীরে ধীরে উঠিয়ে দেওয়া দরকার। একটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যে বিশাল বাহিনী, গাড়ির বহর—এগুলোর দরকার নেই। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় যায় বাজেটের একটি বিরাট অংশ। ভর্তুকিতেও বড় ধরনের অর্থ ব্যয় করতে হয় সরকারকে। এর মধ্যে বেশ কয়েক খাতের ভর্তুকি অপ্রয়োজনীয়। আরেকটি বড় জায়গা হচ্ছে, যেগুলোতে সরকার কাজ করছে না; পাট-বস্ত্র, চিনি—এ ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি গুনছি। যেটার কোনো দরকার নেই। রেমিট্যান্সে আমরা ভর্তুকি দিচ্ছি। এটিরও কোনো দরকার নেই। তাদের তো প্রকৃত মূল্য দেওয়া হচ্ছে। এ সমস্যাগুলোর সমাধান সরকার করছে না। এসব ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, রাজস্ব আয় না বাড়াতে পারলে ঋণের চাপ কমানো যাবে না। কাজেই রাজস্ব আদায়ের গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক-বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আশুলিয়ায় বাসস্ট্যান্ডে চাঁদার দাবিতে হামলার অভিযোগ, আহত ১৩

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা / প্রথম আলোর সম্পাদকসহ ৩ জনকে অব্যাহতির আবেদন

শ্রীপুরে কারখানায় আগুনের ঘটনায় নিহত ১

সারজিসের আশ্বাসে সড়ক অবরোধ তুলে নিলেন ট্রেইনি চিকিৎসকরা

পানামা খাল কেড়ে নেওয়ার হুমকি ট্রাম্পের

বসতবাড়ি রক্ষায় অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে গ্রামবাসীর মানববন্ধন

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণ জানালেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সাংবাদিকদের দেশ ও জাতির স্বার্থে কথা বলার আহ্বান ব্যারিস্টার খোকনের

টানা ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর দৌলতদিয়া ৭নং ফেরিঘাট চালু

মতিঝিলে ছিনতাইকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য গ্রেপ্তার

১০

ইজতেমা মাঠে হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে কুমিল্লায় মহাসড়ক অবরোধ

১১

গুলশানে বিদেশি পিস্তলসহ গ্রেপ্তার ১

১২

গাজায় শিশু হত্যার তীব্র নিন্দা পোপ ফ্রান্সিসের

১৩

শাহবাগে বেসরকারি ট্রেইনি চিকিৎসকদের বিক্ষোভ

১৪

‘ফ্রেন্ডলি ফায়ারে’ নিজেদের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করল মার্কিন সেনারা

১৫

সন্দ্বীপবাসীর কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণ করবে ফেরিঘাট : বিএনপি নেতা মিল্টন

১৬

বাড্ডায় ছিনতাই করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা ৩

১৭

চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করল সেই পাকিস্তানি জাহাজ

১৮

সংলাপে বক্তারা / গত ১৫ বছর গণমাধ্যম জনগণের কথা বলেনি

১৯

‘বঙ্গবন্ধু রেল সেতু’র নাম পরিবর্তন

২০
X