দুর্নীতির জাতীয় কৃতিত্বের তিলকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের সাবেক কমিশনার ওয়াহিদা রহমানও! সাবেক হওয়ার পর নয়, একক সিদ্ধান্তে চারটি মোবাইল অপারেটরের ১৫২ কোটি সুদ মওকুফের কুকর্মটি করেছেন ওই পদে থাকাকালেই। ফাঁস হয়েছে একটু দেরিতে। তার বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এই মানের ক্ষমতার অপব্যবহার অসংখ্য। দু-একটি ফাঁস বা গণমাধ্যমে আসে মাঝেমধ্যে ঘটনা চক্রে। ওয়াহিদা নিজেকে রাষ্ট্রের চেয়েও বড় মনে করে কাজটি করেছেন হালে ব্যাপক আলোচিত সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর বা সেনাপ্রধান আজিজসহ অন্যান্য আহমেদদের মতোই। তাদের মতো সাহসী, মেধাবী, দুর্দান্ত বিবেচনায় কত আদাব-সালাম কুর্নিশ পেয়েছিলেন তিনিও। আর চলনে-বলনে শুদ্ধাচার ও সততার প্রশংসার প্রচার ছিল অন্তহীন। সময়ের ব্যবধানে এখন কি একই দৃশ্যপট! আজিজ-বেনজীরদের ক্ষেত্রে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ছিল না। ওয়াহিদা সেটারও শিকার।
গড়পড়তা বলা হয়, নারীরা পুরুষদের মতো দুর্নীতি বা অন্যান্য কুকর্মে তত বেপরোয়া হন না। মায়ের জাত তারা। বধূ-মাতা-ভগ্নি, কন্যা-জায়া-জননীতে তারা দেবীতুল্য। আরও নানা দিক বিবেচনায় কেবল রাজনৈতিক নয়—প্রশাসন, শিক্ষা, এনজিও ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি নানা পর্যায়ে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন আশপাশের বিভিন্ন দেশের জন্য রোল মডেল। রীতিমতো ঈর্ষারও। প্রধানমন্ত্রী, সংসদের উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, জাতীয় ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ধরনের পদপদবিগুলো নয়তো রাজনৈতিক বিষয়-আশয় বিবেচনায় বাদই থাক। বিতর্কে না গিয়ে মেনেই নেওয়া যাক যে, এগুলো দলীয় মোড়কের বাহাদুরি। বাস্তবে ক্ষমতায়নে ঋদ্ধ এ নারীদের অনেকের কর্মযজ্ঞ, সততা, বিচক্ষণতা, কাজে একাগ্রতা নিজ নিজ সেক্টরে বেশ আলোচিত-প্রশংসিত।
সচিব, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ইউএনও, এসিল্যান্ড ইত্যাদি মিলিয়ে তাদের সংখ্যা এখন অগুনতি। মাঠ প্রশাসনের আরও নানা স্তরে নারীদের বাড়তে বাড়তে এখন সুসংহত। কর্মপরিবেশও বেশ অনুকূলে। কিন্তু মাঝেমধ্যে তাদের কারও কীর্তিকাণ্ড মানুষকে হতবাক করে দেয়। কোনো ক্রিয়াকর্ম পুরুষকুলকেও লজ্জায় ফেলে দেয়। কুড়িগ্রামে ডিসি থাকাকালে সুলতানা পারভীন গণমাধ্যমে টানা কয়েক দিন শিরোনাম হয়েছিলেন। মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সাংবাদিক নির্যাতন, বিনোদন সরোবর তৈরিসহ কুড়িগ্রামে আচানক সালতানাত পত্তনকারী সুলতানাকে এক পর্যায়ে প্রত্যাহার করা হয়। বিভাগীয় তদন্তও চলে। এতে তার নানা কাণ্ডকীর্তির খবর বেরিয়ে আসতে থাকে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ‘লঘুদণ্ড’ দেয়। কিন্তু আদতে সেটা কেবল বাতিল নয়, অভিযোগের দায় থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। বড় রকমের একটা শাস্তির খবর চাউরের মধ্যেই শাস্তি থেকে রেহাই দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
কদিন আগে দুষ্কর্মের নতুন এক নজিরে মাত করে দিয়েছেন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত ডিজি সেলিনা বানু। মাত্র ৯ দিন এ ভার পেয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যে দুদিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। ৭ দিনেই সেলিনা বানু ভারপ্রাপ্ত ডিজি হিসেবে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ নয়, বটগাছ হয়ে যান। এক দিনেই ছাড় করেন মাল্টিপল পাসপোর্টের ৫০০ ফাইল। নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা প্রতিটি ফাইল অনুমোদনের জন্য নিয়েছেন দেড় লাখ টাকা করে। সব মিলিয়ে এই কর্মকর্তা হাতিয়ে নিয়েছেন মাত্র সাড়ে ৭ কোটি টাকার মতো।
যশোরের মনিরামপুরে ভ্রাম্যমাণ আদালত চলাকালে সমীহ না করা এবং নিয়ম না মানায় তিন বৃদ্ধকে কান ধরিয়ে ওঠবস করানোর ঘটনায় এসিল্যান্ড সাইয়েমা হাসানকে কদিন দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে পরে পদ-পদায়নে তাগড়া করে দেওয়া হয়েছে। কয়েক দিন বেশ ভাইরাল ছিলেন শেহেলা পারভিন। তিনি সরকারি কর্মকর্তা নন। পদ-পদবিহীন। এর পরও পদ ধরলে তিনি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর খানের স্ত্রী। স্ত্রী কোনো পদ বা পদবি না হলেও এই বধূ-মাতা তার পরহেজগার স্বামীকে কুপোকাত করে দিয়েছেন। সনদ-বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর একে একে বেরিয়ে আসে ধারণারও বাইরের যত অপকর্মের খবর। কোনো জাত বা পেশাদার জালিয়াতের পক্ষেও তা অসম্ভব।
সিভিল বা পুলিশ প্রশাসনের বাইরে সরকারের অগ্রাধিকার ফর্দে বিচার, শিক্ষাসহ বিভিন্ন পর্যায়েও নারীর ক্ষমতায়ন গত কয়েক বছরে একটি ইতিবাচক ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বিশেষ করে শিক্ষা সেক্টরের এটি যুগান্তকারী ঘটনা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসিসহ বেশ উচ্চাসনে এখন অনেক নারী। সেখানেও গোলমাল বাধিয়েছেন নিয়োগ দেওয়া কয়েকজন। দেশের প্রথম নারী ভিসি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন যেনতেন দুর্নীতি নয়, অনৈতিক আরও কত কিছু করা যায়। অবসরে যাওয়ার পর নয়, টাটকা ভিসি থাকা অবস্থায়ই যার কিছু কিছু প্রকাশ পায়। এই ভিসির ৪০ বছরের শিক্ষকতা জীবনের সমাপ্তিটা ঘটে ছি-ছিতে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম নারী ভিসি হিসেবে অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম নিয়োগ পান ২০১৪ সালে। এরপর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত হয়ে ২০১৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ভিসি হন তিনি।
দ্বিতীয় মেয়াদে ভিসি থাকাকালে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতিসহ নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন আন্দোলন করলেও সরকারের যথামহল তাকে রক্ষা করেছে। চাঁদার টাকা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের পাণ্ডা কিসিমের হোমড়াচোমড়াদের ভাগ করে দেওয়ার ঘটনা ফাঁস হওয়ার পরও তাকে সেফ করা হয়েছে। এত তিনি আরও বেপরোয়া হয়েছেন। ডেমকেয়ারে অনৈতিক-অশিক্ষাসুলভ কাজের মাত্রা তিনি আরও বেগবান করেছেন। নারী ভিসির তালিকায় দ্বিতীয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিরীণ আখতার তাহলে কম যাবেন কেন? ক্যাম্পাসে ভবন নির্মাণ, নিয়োগে অনিয়মসহ নানা কীর্তি রেখেছেন তিনি। তার মেয়ে রিফাত মোস্তফা টিনাও মায়ের ছিলছিলা অক্ষুণ্ন রেখেছেন। এ নিয়ে আন্দোলন করা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নাজেহাল হতে হয়েছে। একপর্যায়ে শিরীণ আখতারকে আর না সরিয়ে পারেনি সরকারের শীর্ষমহল।
পরবর্তী সময়ে শিরীণ আখতারের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়ম তদন্ত শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি কমিটি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে রয়েছেন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। শিক্ষা-দীক্ষা এবং পরিচিতিতে তিনি নামকরা। দেশসেরা আলোচিত শিক্ষাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তি ভিসি ফজলুল হালিম চৌধুরীর কন্যা তিনি। তার এ সময়টাতে নানা অপকর্মের কারণে নিন্দনীয়ভাবে প্রায় উঠে আসছে জগন্নাথ বিশ্বদ্যিালয়ের নাম। যার কোনো কোনোটিতে সাদেকা হালিমও প্রাসঙ্গিক বা যুক্ত।
নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়নে এ সরকারের কিছু কমিটমেন্ট আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেবল কমিটমেন্ট নয়, এ ক্ষেত্রে একটার পর একটা পদক্ষেপও নিচ্ছেন। কিন্তু তার পদক্ষেপগুলো অর্থ ও গুরুত্ব হারাচ্ছে নিয়োগপ্রাপ্ত নারীদের কারও কারও কারণে। তাদের কৃতকর্মের দায় অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর নয়। কিন্তু প্রাসঙ্গিক হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর নাম। নারীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অনুভূতি, অঙ্গীকার এবং পদক্ষেপগুলোর মর্যাদা সুবিধাভোগী নারীরাও দিচ্ছেন কি না—এ প্রশ্ন আপনাআপনিই চলে আসছে। জানতে ইচ্ছা করে, এই সুবিধাপ্রাপ্ত বধূ-মাতা-ভগ্নিদের জাগালেও কি জাগছেন? চেতনায় চেতন আসে? বোঝেন আসলটা? প্রধানমন্ত্রীর উপলব্ধি ও দানের মর্যাদাটার আন্দাজ করাও কঠিন ফারজানা-শিরীণ-ওয়াহিদা-সুলতানাদের জন্য? আপনারা মোটেই সাবরিনা-পাপিয়া-এশা-মাহিয়াদের কাতারের নন। শিক্ষা, বিদ্যা, প্রশিক্ষণ, বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার কোনটায় কমতি আপনাদের?
প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার বিখ্যাত গান/কবিতা জাগো নারীতে আপনাদের জাগানোর চেষ্টা করেছেন বহ্নিশিখা, দাহিকা, ধূমায়িত অগ্নি, স্বর্গ-স্খলিতা, জয়ন্তিকা ইত্যাদি কত সোহাগী সম্বোধনে। পেরেছেন কি তাদের পটিয়ে-পাটিয়ে হলেও প্রকৃত অধিকারের ব্যাপারে বোধ-বুদ্ধি জাগাতে?
শিক্ষায় বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি বড়াই করার বিষয়। তাদের কাজের শক্তি-সৌন্দর্যের খ্যাতি প্রশ্নাতীত। নারীর ক্ষমতায়নও গর্বের ব্যাপার। এর বিপরীতে জিততে গিয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর মহতী ইচ্ছাকে কী হারে ঠকাচ্ছেন? এক এক করে বললে হয়তো ক্ষেপে যেতে পারেন মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নিরা। বোঝা দূরে থাক, হয়তো শুনতেও চাইবেন না। তাই সেই ঝুঁকিতে না গিয়ে বরং নারীকুলের বোধে টোকা দিতে কবি কাজী নজরুলের বিখ্যাত কবিতাটির ওপর ভর করেই শেষ করছি আজকের লেখা।
জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা।
জাগো স্বাহা সীমান্তে রক্ত-টিকা।।
দিকে দিকে মেলি তব লেলিহান রসনা,
নেচে চল উন্মাদিনী দিগ্বসনা,
জাগো হতভাগিনী ধর্ষিতা নাগিনী,
বিশ্ব-দাহন তেজে জাগো দাহিকা।।
ধূ ধূ জ্বলে ওঠ ধূমায়িত অগ্নি,
জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নী!
পতিতোদ্ধারিণী স্বর্গ-স্খলিতা
জাহ্নবী সম বেগে জাগো পদ-দলিতা,
মেঘে আনো বালা বজ্রের জ্বালা
চির-বিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা।
লেখক: ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন