আমরা কথায় কথায় বলি, আমাদের টাকায় সরকার চলে। কথার কথা মনে হলেও কথাটা কিন্তু সত্যি। এমনিতে বছরে যাদের আয় সাড়ে ৩ লাখ টাকার ওপর, তাদের নির্ধারিত হারে আয়কর দিতে হয়। আয়কর হলো প্রত্যক্ষ কর। কিন্তু আয়কর ছাড়াও আরও অনেক ধরনের পরোক্ষ কর আছে, যা দেশের প্রত্যেকটি মানুষকেই কোনো না কোনোভাবে দিতে হয়। আপনি দোকানে গেছেন রুটি কিনতে। রুটির দাম ১০ টাকা, ভ্যাট দেড় টাকা। মোট দাম দিচ্ছেন আপনি ১১ টাকা ৫০ পয়সা। এই ভ্যাটের দেড় টাকা কিন্তু সরকার পাবে। ফলে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো না কোনোভাবে সরকারকে কর দিতে হয়। আসলে করজালে আমরা সবাই বন্দি। মোবাইলে কথা বললে কর দিতে হবে, মেট্রোতে চড়লে কর দিতে হবে।
আসলে কর আমাদের সবাইকেই দিতে হয় এবং দেওয়া উচিত। আমরা কর না দিলে সরকার চলবে কীভাবে। এই যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, জনগণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার নানা আয়োজন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড—এ বিশাল ব্যয়ভার বহন করতে হলে সরকারকে তো আয় করতে হবে। এই যে এবার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট প্রস্তাব পেশ করা হলো, তাতে আয়ের পরিকল্পনা মাত্র ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। তার মানে আগামী অর্থবছরে সরকারের ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আমরা যদি মোট ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা কর দিতাম, তাহলে বাজেটে ঘাটতি থাকত না, সরকারকেও আর ঋণভারে জর্জরিত হতে হতো না। কিন্তু ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা আয় করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ধারণা, ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত সেটাও অর্জিত হবে না। একটা স্বাস্থ্যকর অর্থনীতিতে আয়-ব্যয়ের এত ফারাক থাকে না।
কর দেওয়া আসলে দেশপ্রেমের অংশ। আমাদের টাকায় আমাদের দেশ চলছে, এটা বলার মধ্যেও কিন্তু দেশকে নিজের মনে করার একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু বাংলাদেশে ট্যাক্স দিয়ে দেশপ্রেমিক সাজার মানসিকতা নেই বললেই চলে। বরং কীভাবে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া যায়, সারাক্ষণ সে চেষ্টাই চলে। এ প্রবণতার কারণ অবশ্য দ্বিপক্ষীয়। ট্যাক্সদাতা ও গ্রহীতা, সমস্যা আছে দুপক্ষেই। দাতারা মনে করে, ট্যাক্স একটা ভয়ংকর প্রক্রিয়া। একবার ট্যাক্সের খাতায় না উঠলে মৃত্যুর আগে আর রক্ষা নেই। যারা ট্যাক্স নেন, সেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সবাই রক্তচোষা মনে করে। এই মনে করায় অবশ্য খুব একটা ভুল নেই। রাজস্ব বোর্ড নানাভাবে সাধারণ করদাতাদের হয়রানি করে। ফলে মানুষও সারাক্ষণ রাজস্ব বোর্ডকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। ১৮ কোটি মানুষের দেশে টিন সার্টিফিকেট আছে, এমন মানুষের সংখ্যা মাত্র এক কোটির আশপাশে। তাও নানা কাজে টিন সার্টিফিকেট লাগে বলে, এ সংখ্যাটা বেড়েছে। তবে ট্যাক্স দেন এমন মানুষের সংখ্যা মাত্র ৪০ লাখের মতো। নিম্নমধ্যম আয়ের একটি দেশ, যে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৮৪ ডলার, যে দেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের মর্যাদা অর্জন করেছে; সে দেশে অন্তত চার-পাঁচ কোটি মানুষের ট্যাক্স দিতে পারার কথা। অথচ আমাদের দেশে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের সবচেয়ে কম দেশগুলোর একটি। সবাই ঠিকঠাকমতো ট্যাক্স দিলে বাংলাদেশের আর কোনো সমস্যাই থাকার কথা নয়। ১৮ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ৪০ লাখ লোক ট্যাক্স দেয় এটা অবিশ্বাস্য।
সরকারের হিসাবে অবশ্য বাংলাদেশের ছয়-সাত কোটি মানুষের ট্যাক্স দেওয়ার কথা। কারণ বাংলাদেশে এখন করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা। তার মানে মাসে আপনার আয় ৩০ হাজার টাকা হলেই আপনাকে কর দিতে। যারা চাকরি করেন, মূল বেতন ৩০ হাজার ধরলে, যাদের মোট বেতন ৪২ হাজার টাকা; তাদের সবারই ট্যাক্স দেওয়ার কথা। মাসে ৩০ হাজার বা ৪২ হাজার টাকা আয় করে এমন লোকের সংখ্যা ছয়-সাত কোটি তো হওয়ারই কথা। ঢাকায় সিএনজিচালক, উবারচালক, এমনকি অনেক রিকশাচালকের আয়ও মাসে ৩০ হাজার টাকার বেশি। ঢাকা শহরে মাসে অন্তত ৫০ হাজার টাকা আয় করতে না পারলে তো সেই পরিবারের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর কথা। তারা আগে খাবার কিনবেন না ট্যাক্স দেবেন। করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা! এটি একটি হাস্যকর কৌতুক। মাসে ৩০ হাজার বা ৪২ হাজার টাকা আয় করেন, এমন মানুষের পক্ষে ট্যাক্স দেওয়ার কথা ভাবাও মুশকিল। বাস্তবতা মানলে করমুক্ত আয়সীমা অন্তত ১০ লাখ টাকা করা উচিত। করমুক্ত আয়সীমা ১০ লাখ টাকা করলেও আপনি কর দেওয়ার মতো অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ পাবেন। এই পাঁচ কোটি মানুষের কাছ থেকে ঠিকঠাকমতো কর আদায় করতে পারলে, দেশে আর কোনো সংকটই থাকবে না। দেশে অন্তত হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটে থাকেন, এমন সবার আয় বছরে সাড়ে ৩ লাখ টাকার বেশি। বাংলাদেশে হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট কয়টি আছে আর ট্যাক্স দেন কজন। এখানেই রাজস্ব বোর্ডের ব্যর্থতা। যারা নিয়মিত সরকারি-বেসরকারি চাকরি করেন, তারা ছাড়া আর কেউ ট্যাক্স দিতেই চান না। কিন্তু বাকিদের খুঁজে বের করার কোনো চেষ্টাই নেই এনবিআরের। গ্রামে অনেককে চিনি যারা ব্যবসা-বাণিজ্য, এমনকি চাষবাস করেও আমার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আয় করেন। তাদের যখন আমি আয়করের কথা বলি, তারা হাসেন।
কালো টাকা সাদা করার বিষয়টি নিয়ে এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। আমরা বলি বটে সাদা টাকা, কালো টাকা। তবে টাকার কোনো রং নেই। সহজ কথা হলো, যে টাকা আপনি হিসাব দিতে পারবেন, সেটি সাদা; যার হিসাব দিতে পারবেন না, সেটি কালো। আপনি যদি ঘুষ-দুর্নীতি করে টাকা আয় করেন, তার তো হিসাব দিতে পারবেন না। বেতন পান ৪০ হাজার টাকা, বাসা ভাড়া দেন ৫০ হাজার টাকা; এমন মানুষ আপনি চেনেন না? তারা বাকি টাকা কই পায়? বাকি টাকাটাই কালো। আমার পরিচিত লোক আছেন, যিনি মাসে বড়জোর ৬০ হাজার টাকা আয় করেন। কিন্তু ঢাকায় তার প্লট-ফ্ল্যাট মিলে অন্তত ৫০ কোটি টাকার সম্পদ আছে। আমি খালি ভাবি, এই লোক ট্যাক্স দেন কি না, দিলে কীভাবে তার ট্যাক্স ফাইল মেলান। বেতনের আয়ে টানাটানি করে সংসার চালানো এই আমাকে প্রতি বছর ট্যাক্স ফাইল মেলাতে হিমশিম খেতে হয়। বারবার দেখি কোনো কিছু বাদ পড়ে গেল কি না। আমার সেই সম্পদশালী পরিচিত ভদ্রলোক অবশ্য লোকে দেখে ফেলার ভয়ে গাড়িও কেনেন না। কোটিপতি মানুষ চলাচল করেন সিএনজিতে। আরেক ব্যবসায়ী বন্ধুকে চিনি, যিনি সবসময় ক্রেডিট কার্ড বা ব্যাংক লেনদেন এড়িয়ে যেতে চান। তার গাড়িতে সবসময় ক্যাশ টাকা থাকে। সরকার যে ক্যাশলেস দেশ বানাতে চাচ্ছে, কালো টাকার দৌরাত্ম্যে তা কখনোই সম্ভব হবে না। কালো টাকা মানুষ ব্যাংকেও রাখে না। বাসায় রাখে অথবা জমি-ফ্ল্যাট কেনে। কারণ জমি-ফ্ল্যাট কেনায় অনেক কালো টাকা আড়াল করা যায়। পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ এক দিনে গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। বেনজীরের কেনা ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট চারটির দাম দেখানো হয়েছে মাত্র ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অথচ অভিজাত ওই ফ্ল্যাটের বাজার মূল্য ২৫ কোটি টাকারও বেশি হওয়ার কথা। তার মানে শুধু ফ্ল্যাট কেনাতেই বেনজীর প্রায় ২৩ কোটি কালো টাকা আড়াল করেছেন।
তবে বাংলাদেশে সিস্টেমের কারণে অনেকের সাদা টাকাও কালো হয়ে যায়। আমার কয়েক বন্ধু মিলে কিস্তিতে একটা প্লট কিনেছিল। ২০ বছর পর তারা সেই জমি বিক্রি করেছে, ভালো লাভও পেয়েছে। প্রায় কোটি টাকায় জমি বিক্রি হলেও রেজিস্ট্রি দেখানো হয়েছে ২০ লাখ টাকা। এখন তাদের ২০ বছর ধরে তিল তিল করে গড়া সম্পদের ৮০ লাখ টাকা কিন্তু কালো হয়ে গেল। তারা কীভাবে আয়কর ফাইলে এ টাকার হিসাব দেবেন?
আয়কর আর কালো টাকা সাদা করার মধ্যে একটি নৈতিক বৈপরীত্য আছে। আয়করের সর্বোচ্চ সীমা ৩০ শতাংশ। বছরে আপনার আয় ২০ লাখ টাকা বেশি হলে আপনাকে ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। কিন্তু আপনি যদি কালো টাকা সাদা করতে চান, ১৫ শতাংশ কর দিলেই হবে। ১৫ শতাংশ কর দিলে আপনার কালো টাকার উৎস নিয়েও কোনো প্রশ্ন করা হবে না। অথচ বৈধ আয়ে কর দিলেও আপনাকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। একটু এদিক-সেদিক হলে আপনাকে জরিমানাও দিতে হতে পারে। আপনি যদি চালাক হন, তাহলে কী করবেন? ২০ লাখ টাকার বেশি আয় গোপন করবেন, সেটাকে কালো হওয়ার সুযোগ দেবেন এবং সময়মতো ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে সাদা করে নেবেন। সাদা হলে কর ৩০ শতাংশ, কালো হলে ১৫ শতাংশ। সিস্টেমই কি সৎ মানুষকে কর দিতে নিরুৎসাহিত করে, অসৎ মানুষকে উৎসাহিত করছে না?
সাদা-কালোর এই চক্কর দেখে আমার ‘হাওয়া’ ছবির সেই গান মনে পড়ে যাচ্ছে—‘সাদা সাদা কালা কালা, রং জমেছে সাদা কালা…’।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ