আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫ অর্থবছর) প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৫ দশমিক ২ শতাংশ এবং জিডিপির শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ ছিল ৩৮ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ফলে আগেরবারের চেয়ে এবার বরাদ্দ বেড়েছে ৩ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। গত ২০ বছর ধরে বাজেটের মোট বরাদ্দের ৫ শতাংশের কাছাকাছি থাকে স্বাস্থ্যের জন্য। এবারও তাই হয়েছে।
বাংলাদেশের বাজেটের পরিমাণ বেড়েছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, বিপরীতে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বেড়েছে তার থেকে একটু বেশি। স্বাস্থ্য খাত শ্রম নিবিড় একটি সেবা খাত। সেহেতু জনবলের বেতন-ভাতা পরিশোধে বড় একটি ব্যয় হয়। প্রতি বছর বেতন-ভাতা স্বাভাবিক নিয়মে ৫ শতাংশ হারে বাড়ে অর্থাৎ ইনক্রিমেন্ট হয় ৫ শতাংশ। বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া ৩ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকার একটি বড় অংশ চলে যাবে বর্ধিত বেতন-ভাতা পরিশোধে। দেশে এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। স্বাস্থ্য খাতে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। ওষুধের দাম, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় বেড়েছে। ফলে সরকার যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে আগে যে পরিমাণ ওষুধ-যন্ত্রপাতি কিনেছে, আগামী বছর সে পরিমাণ কিনতে বাড়তি অর্থ গুনতে হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের কয়েকটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। জরুরি স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় ২ হাজার কোটি টাকা, গবেষণায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কভিড-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে ডেঙ্গু মাঝেমধ্যেই কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করছে। এ ক্ষেত্রে জরুরি স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় রাখা বরাদ্দ ব্যয় করে মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করা গেলে ভালো। কিডনি ডায়ালাইসিসের কিট ও ফিল্টার ও ডেঙ্গু টেস্টের কিট আমদানির ওপর শুল্ক রেয়াত দেওয়া হয়েছে। এতে ডায়ালাইসিস ও ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যয় কমবে।
সমালোচনার জায়গা আছে অনেক। বাজেট গতানুগতিক। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বিদ্যমান সমস্যার প্রতিফলন ঘটেনি। বাজেট বরাদ্দ করা হয় কতগুলো খাতে। প্রতিটি উপখাতে কিছু কার্যক্রম থাকে। নতুন কার্যক্রম তৈরি অথবা যেসব কার্যক্রম রয়েছে সেগুলোর পরিসর না বাড়ানো হলে বাজেট বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ থাকে না। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নতুন পরিসরগুলো তৈরি হয়নি। স্বাস্থ্য খাতে ডাক্তার, নার্সসহ অন্যান্য সহায়তাকারীর প্রচুর পদ খালি রয়েছে। এসব পদে যদি লোক নিয়োগ দেওয়া হতো তাহলে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর যৌক্তিকতা তৈরি হতো। যেহেতু নিয়োগের কোনো উদ্যোগ এখনো গ্রহণ করা হয়নি, সেহেতু সেটির জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়নি। মেডিকেল যন্ত্রপাতি আমদানির শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই স্বাস্থ্যসেবা সর্বজনীন করার পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
স্বাস্থ্যসেবা খাতে অনেক জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। ল্যাবের ঘাটতি রয়েছে, জনবল ও ওষুধের ঘাটতি রয়েছে, যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতি পূরণের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলে বাজেট বরাদ্দ রাখা যেত। গত বছর যে কার্যক্রমগুলো রয়েছে আগামী বছরও একই কাজ করা হবে, যেহেতু বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। আগে নতুন প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে, সেটি পাস করতে হবে। পরে সে অনুযায়ী বাজেট চাওয়া যেতে পারে। আগামী অর্থবছরে রাজশাহী, সিলেট ও চট্টগ্রামে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়েছে। সেজন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, সেই বরাদ্দ যথেষ্ট কি না। প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে হবে, প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদিত হতে হবে, সেই অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে অর্থ বরাদ্দ চাইতে হবে, অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট বরাদ্দ দেবে। অর্থ মন্ত্রণালয় স্বপ্রণোদিত হয়ে বাজেট বরাদ্দ দেবে না, তাদের সে সুযোগও নেই।
আমাদের চাওয়া হলো স্বাস্থ্য খাতে প্রদত্ত বরাদ্দ সঠিকভাবে ব্যয় করা এবং মানসম্পন্ন কাজ নিশ্চিত করা। চলতি অর্থবছরের জন্য বাজেটে ৩৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, যেটি সংশোধিত বাজেটে ২৯ হাজার কোটি টাকায় চলে আসে। ৯ হাজার কোটি টাকা কমে গেছে। বছর শেষে দেখা যাবে, ২৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে বড় একটি অংশ ব্যয় করতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
আমার প্রস্তাব থাকবে, স্বাস্থ্য খাতে প্রস্তাবিত বাজেট থেকে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ যেন না কমানো হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৪১ হাজার কোটি টাকাই যেন থাকে এবং সেটি যেন যথাযথ ব্যয় হয় এবং মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত হয়। স্বাস্থ্য বরাদ্দের যথাযথ ব্যয় নিশ্চিত করতে হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিজের দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা লাগবে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ব্যয় করতে না পারার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অন্য অনেক কিছু দায়ী। স্বাস্থ্য বাজেট বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ যেসব কারণ রয়েছে, সেগুলোর সমাধান করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও চেষ্টা করতে হবে অর্থ যথাযথভাবে ব্যয়ে। যতটুকু বাজেট পাওয়া গেছে ততটুকু যথাযথভাবে কাজে লাগানো গেলে অনেক সুফল মিলবে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যের জন্য যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, স্বাস্থ্য বিভাগের সামর্থ্য না থাকায় সেটিও খরচ করা যায় না। ফলে কোথাও ব্যয় বাড়িয়ে, কোথাও কমিয়ে প্রতি বছর একই কাজ করা হচ্ছে। ১৭ কোটি মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য যে সামর্থ্য, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সক্ষমতা দরকার, তা না বাড়িয়ে শুধু বরাদ্দ বাড়ালে তাতে খুব বেশি কিছু আসে-যায় না।
লেখক: অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়