আজ একজন মানুষের গল্প বলব, যিনি এক শতাব্দী ধরে অতি সাধারণ গ্রামীণ জনপদে পৃথিবীর আলো-বাতাস-জলের স্পর্শ পেয়ে চলেছেন। আজন্মকাল কৃষিজীবী এ মানুষটির ১০০ বছর বয়সেও শরীরে তেমন কোনো রোগব্যাধি বাসা বাঁধেনি। তিনি হলেন খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া ইউনিয়নের ঘোনা বড়ডাঙ্গা গ্রামের শতবর্ষী চৈতন্য কুমার বিশ্বাস। এই এলাকার সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষ বলে দাবি করছেন তার স্বজন ও এলাকাবাসী।
কয়েক প্রজন্ম প্রত্যক্ষ করা চৈতন্য বাবু বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী। প্রান্তিক জনপদের সমাজ-সংস্কৃতির মিশ্র টানাপোড়েন, কুসংস্কার, বর্ণবিদ্বেষ, ব্রিটিশ শাসনামল, জমিদারি অত্যাচার, কৃষক আন্দোলন, দেশ ভাগ, পাকিস্তানি দুঃশাসন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও শরণার্থী জীবনের সেই কঠিন সময়গুলো এখনো তার স্মৃতির পাতায় ভেসে বেড়ায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের অত্যাচারে ভিটেমাটি ফেলে উদ্বাস্তু হয়ে, চরম উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর স্বাধীন দেশের নিজ জন্মভিটায় ফিরে সংখ্যালঘুর তকমা নিয়ে কাটিয়ে দিলেন বহুকাল। দীর্ঘ জীবনে বহু ঘাত-প্রতিঘাত আর সমাজের নানা অনাচার মুখ বুজে সহ্য করে চলেছেন তিনি।
চৈতন্য কুমার বিশ্বাস, ১৯২৪ সালের ১১ জুন বাংলার এ মধু মাসে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার গুটুদিয়া ইউনিয়নের (তৎকালীন ভাণ্ডারপাড়া ইউনিয়ন) ছোট্ট জনবসতি ঘোনা বড়ডাঙা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নিত্য জোয়ারভাটায় প্লাবিত, খাল-বিল জলাভূমিবেষ্টিত তৎকালীন অজপাড়াগাঁয়ের এক বিত্তহীন কৃষক পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। ব্রিটিশ আমলের প্রান্তিক কৃষক শ্রীমন্ত বিশ্বাস আর রবিদাসী বিশ্বাসের সংসারে চৈতন্য বাবুরা চার ভাইবোন ছিলেন। মাথা গোঁজার মতো একটু ভিটেবাড়ি আর সামান্য কিছু কৃষিজমিতে হালচাষই ছিল তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপায়।
সুঠাম দেহের অধিকারী শতবর্ষী চৈতন্য বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা হলো সেদিন। কথা প্রসঙ্গে তিনি তার শৈশব স্মৃতিকে রোমন্থন করতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন। জীবনের পরতে পরতে নানা ঘটনার মধ্যে তিনি যেন অনেকটা এড়িয়ে যেতে চান। আলাপচারিতায় বললেন, ‘ব্রিটিশ পিরিয়ডে জিলেরডাঙ্গায় এট্টা পাঠশালা ছিল, সেই পাঠশালায় আমি ক্লাস টু পর্যন্ত পড়ালিখা করিছি। ছোটবেলায় খেলাধুলাও করিছি খুব। ফুটবল, হাডুডু, ভলিবল, গোল্লাছুট, সাঁতার কাটা এসব খেলিছি। এট্টু বয়স বাড়লি তহন কৃষিকাজ করতাম। মহিষির লাঙল চষিছি। খাবারও খাতি পারতাম বেশ; এহনও মোটামুটি পারি। তহন খাবার-দাবারে ভেজাল ছিল না। নদী-খাল-বিলির টাটকা মাছ, ক্ষেতের তরকারি, বাড়ির হাঁস-মুরগি এসব যথেষ্ট খাইছি। সকালে কোনো দিন পান্তাভাত, ফেনাভাতও খাইছি। সারা জীবন যথেষ্ট পরিশ্রম করিছি, তেমন কোনো রোগব্যাধি আমার হইনি। এহন শরীরী কিছু সমস্যা হয়েছে, তবে বড় ধরনের কোনো অসুখ আমার নেই। সব মিলোয়ে আছি মোটামুটি, সময় কাটে যাচ্ছে কোনোমতে।’
শতবর্ষী চৈতন্য বাবুকে দেখলে যেন কোনো এক শতবর্ষী বৃক্ষের কথা মনে পড়ে। তার কুঞ্চিত ঝুলে পড়া চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে কালশিটে দাগ আর হাতের গাঁট ও পায়ের পাতার রুক্ষ কঠিন কড়াগুলো দেখে তাকে আমার বহু বছর অযত্নে অবহেলায় ঝড়ঝাপ্টা সামলে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকা কোনো মহিরুহের মতোই মনে হয়। মহিরুহ যেমন অনড় অটল স্থির দাঁড়িয়ে রয় তার বহু বছরের ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে চলা দৃঢ় কঠিন কুঞ্চিত কাণ্ডের বাকলে শরীর জড়িয়ে, তেমনি এই চৈতন্য বিশ্বাসের শরীরে যেন ছড়িয়ে থাকা বাকল দেখতে পেলাম আমি। সাদা ধবধবে চুলের কয়েকটি ধারা ঝুলে থাকে তার বিষণ্নতায় ভরা মুখমণ্ডলজুড়ে। চৈতন্য বাবুর পরনে সাদা ধুতি ছিল ঠিকই কিন্তু গায়ের জামাটা তার মতোই হয়তো বড্ড বয়সী, প্রিয়জন হারা, অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকা এক শতবর্ষীর মলিন আচ্ছাদন মাত্র।
বসবাসের ঘর বলতে কিছুই নেই। নাতির ছাপরাঘরের বারান্দা নিয়েও তেমন আফসোস নেই। প্রত্যন্ত গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচারে শতবর্ষ পার করে দিলেন চৈতন্য দাদু। বিশেষ স্বপ্ন, বড় আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়ার খুব বেশি দোলাচল ছিল না তার। একমাত্র পুত্রসন্তানকে নিয়ে আরেকটু ভালো থাকতে চেয়েছিলেন তিনি; সেখানেই যত হতাশা। স্বস্তি আর শান্তির দেখা মেলেনি কখনো; তারপরও আজ অবধি তিনি দিনমান উদয়-অস্ত বসে থাকেন তার চিরচেনা মানুষ আর প্রকৃতির মুখ চেয়ে। তাকে কেউ দেখলে ভাববে খুব মন দিয়ে কিছু ভাবছেন। কার কথা খুব বেশি মনে পড়ে, এমন প্রশ্নে তিনি তার স্ত্রীকে স্মরণ করেন। প্রিয়জনের কথা বলতেই তার দৃষ্টির ভাঁজে খেলে যায় এক অজানা সম্মোহন।
ভালো থাকুন চৈতন্য দাদু। আরও অনেক বছর এ জনজীবনের বিচিত্র রূপ অবলোকন করুন; এই কামনা করি।
তথ্যঋণ: শতবর্ষী চৈতন্য কুমার বিশ্বাসের প্রাথমিক এবং তার জীবনগাথা সম্পর্কে লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ ও সহযোগিতা করেছেন ডুমুরিয়ার কৃতী মানুষ, বাংলাদেশ সচিবালয়ের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নিখিল রঞ্জন মণ্ডল