‘আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরী?
বলো কোন্ পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী।’
বেশ কয়েক দিন ধরে রবিঠাকুরের এই কবিতাটি বারবার মনে পড়ছে। আর ভাবছি, শিক্ষা নিয়ে আমাদের রথী-মহারথী-মহাজন-আমলা-কামলার গুচ্ছ জোট জাতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় নিয়ে ঠেকাবে! অনেকেই বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে সব ধ্বংস হয়ে যাবে, অনেকটাই গেছে। তারা বলছেন, দেড় বছর আগে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার পর শিক্ষার যে দশা দাঁড়িয়েছে, তাতে স্পষ্ট, স্মার্ট নাগরিক বানানো ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বানানোর নামে নাজেল করা শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে লেখাপড়া যাও অবশিষ্ট ছিল, তাও প্রায় গেছে, বাকিটুকুও যায় যায়।
বড় পরিবর্তন নিয়ে বছর দেড়েক আগে শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। শুরু থেকেই এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে পক্ষ-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা। বিপক্ষ ধারাই প্রবল। নতুন শিক্ষাক্রমে শেখানোর ধরন বদলে গেছে, প্রথাগত পরীক্ষা উঠে গেছে ও যাচ্ছে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পুরোটাই মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমের ভিত্তিতে। চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচটি বিষয়ে কিছু অংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। বাকি অংশের মূল্যায়ন হবে সামষ্টিকভাবে, অর্থাৎ পরীক্ষার ভিত্তিতে। তবে আগের মতো কোনো পরীক্ষা হবে না। অভিভাবকদের একাংশ মনে করেন, পুরোনো শিক্ষাক্রমের মতো পরীক্ষা থাকা দরকার, না হলে শিক্ষার্থীরা পড়বে না। একই কথা কিন্তু আরও অনেকেরই। আবার কেউ কেউ এও মনে করেন, যেসব কারণে কিশোর গ্যাং তৈরি হয় তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে, পরিবার ও সমাজের ইতিবাচক চাপ না থাকা। এর সঙ্গে আছে রাজনীতির দুর্বৃত্তদের দ্বারা অপব্যবহার, রন্ধ্রে রন্ধ্রে মাদকের আগ্রাসন বাণিজ্য। এ অবস্থায় পরীক্ষার চাপ উঠে গেলে কিশোর গ্যাং তৈরির ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত হবে। এমনটাই মনে করা হচ্ছে।
অনেকেই মনে করেন, নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় হরিণের পিঠে গাধার বোঝা চাপানোর মতো কাণ্ড করা হয়েছে। এর আওতায় শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এইচএসসি পরীক্ষা হয় এখন। নতুন শিক্ষাক্রমে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি বোর্ডের অধীনেই আলাদা পরীক্ষা হবে। তারপর এ দুই পরীক্ষার ফল সমন্বয় করে প্রকাশ করা হবে এইচএসসির ফল। দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বই পড়তে হবে। উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে হবে বিভাগ বিভাজন। নতুন পদ্ধতির মূল্যায়নে তিনটি চিহ্ন দিয়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থান নির্ণয় করা হবে। যেমন ত্রিভুজ চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হবে শিক্ষার্থী ‘দক্ষ’। বৃত্ত দিয়ে বোঝানো হবে অগ্রগামী বা মাঝারি এবং চতুর্ভুজ দিয়ে বোঝা যাবে পারদর্শিতার ‘প্রারম্ভিক স্তর’। একেকটি ক্লাসে এখনকার মতো বিপুল শিক্ষার্থী নিয়ে সঠিকভাবে শেখানো কঠিন। প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে অতিরিক্ত হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা কোথায় যাবে? আরও প্রশ্ন আছে, শিক্ষকদের দ্বারা মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়েও। নতুন নিয়মে শিক্ষকদের এখতিয়ার ও খবরদারি বাড়বে। ফলে তাদের হাতে শিক্ষার্থীরা অধিক মাত্রায় জিম্মি হয়ে পড়বে। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের এক অংশের বক্তব্য হচ্ছে, ‘শিক্ষকদের কাছে কোচিং না করলে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। নতুন নিয়মের অসিলায় হয়তো অভিভাবকদেরও কোচিং করার জন্য চাপ দেওয়া হবে। অথবা চাপ দেওয়া হবে অন্য ‘কিছুর’ জন্য! নাটক-সিনেমার ক্ষেত্রে যেমনটা হয় আরকি।
বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন কোনো কিছু যেমন আগের মতো নেই, তেমনই নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও। কোনো ক্ষেত্রেই আগের পবিত্রতা অথবা শুদ্ধতা নেই। সবই চলে বাণিজ্যিক ধারায়। ইতিহাস-ভূগোল-দর্শন সিকায় তুলে রেখে অর্থনীতিই যেন ধ্যানজ্ঞান! এর সঙ্গে অন্য প্রাপ্তির বাসনা তো আছেই। যার খবর প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষা পিঠ থেকে প্রায়ই খবর হয়। সাম্প্রতিককালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ও শিক্ষকদের বিষয়ে যেসব খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তা তো এক কথায় ভয়াবহ। আর এটি মনে করার কোনো কারণ নেই, স্কুল-কলেজের শিকক্ষরা পূতপবিত্র ধারায় বিধি মোতাবেক চলছেন। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদের অবস্থা উল্লুক প্রবণতাকেও হার মানায়। এর কারণও নিয়ন্ত্রণহীনতা। বিশেষ করে বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ওপর সরকারের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এগুলো চলে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও তার ‘চক্র’ যেমন যা ইচ্ছা তা করতে পারেন, তেমনই স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার কর্ণধারই হচ্ছেন মূল ক্ষমতার কেন্দ্র। অনেক ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিই সর্বেসর্বা। আর তারা নিয়োগ হন রাজনৈতিকভাবে, এমপির ডিও লেটারের ভিত্তিতে। অনুমান করা কঠিন নয়, স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটির পদে মাননীয় সংসদ সদস্য এবং আনারের মতো ‘অতিমাননীয়’ সংসদ সদস্যদের ডিও লেটারের ভিত্তিতে বহু বছর ধরে কারা ম্যানেজিং কমিটিতে রয়েছেন। এ ব্যাপারে অনেক উদাহরণ আছে। এ ক্ষেত্রে বরিশালের এক গার্লস স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির উদাহরণ দেওয়া যায়। যিনি সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। আবার বয়সেও বেশ তরুণ। বয়সের বিষয়টি এ কারণে প্রাসঙ্গিক যে, ১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি অভিযোগে উল্লিখিত গার্লস স্কুলের চুক্তিভিত্তিক এক শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আবার অন্য কেচ্ছা-কাহিনি রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে, নিয়োগবাণিজ্য। ফলে নিয়মিত শিক্ষকদের তুলনায় চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকদের সংখ্যা বেশি। সেই প্রবচন, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়। আর শিক্ষককুল? তারা তো ব্যাকুল থাকেন কোচিং-বাণিজ্য নিয়ে। বিশেষ করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ধ্যানজ্ঞানই হচ্ছে কোচিং-বাণিজ্য। আর এজন্য ব্যবহার করা হয় স্কুলেরই শ্রেণিকক্ষ। এ ক্ষেত্রে অনেক অপকৌশল তো আছেই। এ নিয়ে কেউ যেন প্রশ্ন করার নেই। শুধু প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে ‘ভাগের ভাগ’ দিলেই
হলো। অনেকেই বলছেন, ১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে এক শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করার নেপথ্য কারণ হচ্ছে কোচিং-বাণিজ্যের ভাগ নিয়ে বিরোধ।
বাস্তবতা যা দাঁড়িয়েছে তাতে প্রধান করণীয় হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অরাজকতার ধারা থেকে টেনে তোলা। অবশ্য সেই সময় যদি এখনো অবশিষ্ট থেকে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলায় না এনে চলমান হেনতেন কারবারের ধারায় সর্বনাশ আরও গভীরে চলে যাবে। এদিকে যারা নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছেন, তাদের মধ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদের মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘নতুন শিক্ষাক্রমটি ভালো এবং অনেক উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নিয়ে শুরু করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নটি ঠিকমতো না হলে এটি হয়তো শিক্ষার্থীদের বিপদে ফেলবে। এ ছাড়া শিক্ষার মান, বৈষম্য এবং যথেষ্ট অর্থায়নের সমস্যা তো আছেই।’
অধ্যাপক মনজুর আহমদের বক্তব্যে যে ‘যথেষ্ট অর্থায়নের’ কথা বলা হয়েছে, তা কিন্তু গভীরভাবে অনুধাবনযোগ্য। অনেকেই জানেন, আমাদের নানান উন্নয়নে অর্থায়ন করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিদেশি টাকা নেওয়া হয় নির্বিচারে। যেন মামা বাড়ির দুধ-ভাত। ভাবখানা এই—অবারিতভাবে দিচ্ছেন অবতার, দুহাত পেতে নাও! কিন্তু ফেরত দেওয়ার সময় যে ‘ফাটে’ সেটি আর বিবেচনায় নেওয়া হয় না। এর ফল হচ্ছে, দেশের অর্থনীতির চলমান দৈন্যদশা। এরপরও নানান উন্নয়নের নামে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। কারণ প্রকল্পই হচ্ছে বিকল্প পথে অঢেল অর্থ লোটার অবারিত সুযোগ। মূলত এজন্যই নেওয়া হয় নানান প্রকল্প। এর বেশিরভাগের সুফল তো দূরের কথা, কুফল এমনভাবে জাতির ঘাড়ে চেপে বসে, যা আর সরানো যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে ঘাড় কেটে ফেলার মতো পরিস্থিতি হয়। এরকম প্রকল্প কিন্তু শিক্ষায়ও অনেক আছে। এর সঙ্গে আরেকটি যুক্ত হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় ‘লার্নিং এক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন (লেইস)’ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। অক্টোবর ২০২০ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৮ পর্যন্ত মেয়াদে প্রজেক্টটি বাস্তবায়িত হবে। এ প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাড়ে ৯৮ শতাংশ ঋণ হিসেবে দেবে বিশ্বব্যাংক। যার পরিমাণ ৩ হাজার ২৫৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ ৩০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। সরকারের বিনিয়োগ ৪৮ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে লেইস প্রজেক্ট গ্রহণের জন্য সরকারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে গত বছর ২২ নভেম্বর। বর্ণনা অনুসারে এই লেইস প্রকল্পের তিনটি মূল লক্ষ্য হচ্ছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের শিখন ত্বরান্বিত ও ধরে রাখার হার বৃদ্ধি, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও সহনক্ষমতা উন্নয়ন। কে জানে এরকম আরও কত প্রকল্প আসবে নতুন শিক্ষাক্রমকে ‘সফল’ করার অসিলায়!
শিক্ষা প্রসঙ্গে গভীরে গেলে স্বর্ণযুগের বেশ আলোচিত ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ সিনেমার কথা উল্লেখ করা যায়। এ সিনেমার অনেক মেসেজের মধ্যে একটি ছিল, আয়না ভেঙে গেলে তা কার্যকারিতা হারায়। আর জোড়া দেওয়া যায় না এবং কোনো কাজে লাগা তো দূরের কথা, হয়ে পড়ে বিপজ্জনক। কুমতলবে হোক, অথবা অর্বাচীনতাপ্রসূত হোক, দেশের শিক্ষাকে হয়তো ভাঙা কাচের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর নতুন শিক্ষাক্রম আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে হিমালয়ে আরোহণের মর্যাদা দেবে, নাকি শবযাত্রা নিশ্চিত করবে, তা যখন কর্তারা বুঝবেন তখন কি আর কিছু করার থাকবে? আর বলে রাখা ভালো, ওপরের শিক্ষার বারোটা কিন্তু মোটামুটি আগেই বেজেছে। সব মিলিয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আছে খাদের কিনারে। এমনটাই মনে করেন অনেকে। অবশ্য, আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা কী মনে করেন, তা অবশ্য বলা কঠিন!
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রম্যলেখক