ড. শামসুল আলম
প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৪, ০২:৪৯ এএম
আপডেট : ০৯ জুন ২০২৪, ০৮:২৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পরিমিত প্রগতিশীল উন্নয়নবান্ধব বাজেট

পরিমিত প্রগতিশীল উন্নয়নবান্ধব বাজেট

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আগামী অর্থবছরের জন্য (২০২৪-২৫ অর্থবছর) ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন ৬ জুন ২০২৪। বাজেটটি বর্তমান সময়ের প্রতিফলন। একটি পরিমিত বাজেট এবং এখানে প্রগতিশীলতার দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই বাজেটে কৃষি সহায়ক অনেক আমদানি পণ্যের শুল্ক কমানোর কথা বলা হয়েছে।

দেশে বর্তমানে দুটি মূল সমস্যা বিদ্যমান। একটি হলো, দেশের রিজার্ভ সংকট কাটছে না। আরেকটি হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বাড়তি অবস্থায় স্থিতিশীল রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি ও বাস্তবতাকে স্বীকার করেই বাজেটটি করা হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় ঠেকাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে অনেক উৎপাদন উপকরণ ব্যয়ও বেড়ে গেল। এ ছাড়া মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কিছুটা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে উৎপাদনও ব্যাহত হয়েছে। সব মিলিয়ে বাজেটে উৎপাদন উপকরণ ও যন্ত্রপাতি—অনেক ক্ষেত্রে কিন্তু আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে বা কমানোর কথা বলা হয়েছে।

কৃষি উপকরণেও আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। আমদানি শুল্ক কমানোয় শিল্পায়নে কিছুটা সহায়তা করবে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই আমদানি শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। এর মাধ্যমে স্থানীয় শিল্পেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সাময়িকভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণমূলক ঠিক হলেও এখন আমাদের এর থেকে বের হয়ে আসা উচিত। এখন প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করতে দেওয়া উচিত। আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে যাতে আবার ব্যয় বাড়িয়ে না দিই সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির দিকে কিন্তু মনোযোগ বাড়াতে হবে। ক্রমান্বয়ে যদি বিনিয়োগ কমে যায় তাহলে কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এতে বড় একটা শ্রেণি বেকার ও ছদ্ম বেকার হয়ে যাবে।

বেসরকারি বিনিয়োগ উজ্জীবিত করতে হলে সুদের হার যাতে নেমে আসে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। সুদের হার কমিয়ে আনতে আমাদের পলিসি রেট নিয়ে চিন্তা করতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য শিল্প, সেবা ও কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়ানো ও ব্যয় কমানো জরুরি। নীতি সুদহার যাতে আর না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। উচ্চ সুদে বিনিয়োগ করে মুনাফা করা কঠিন। উচ্চ সুদহারে বিনিয়োগ স্তিমিত হয়ে যাবে এবং এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকার তো সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে, ভালো প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকতে হবে। কারিগরি শিক্ষা এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের উচিত কারিগরি শিক্ষার প্রসারে বেসরকারিও খাতকে উৎসাহিত করা।

বেসরকারি খাত যদি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারে তাহলে বিদ্যমান সংকট যেমন বেকারত্ব, ছদ্ম বেকারত্ব বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমানে দেশের বাজারে যাদের বিনিয়োগ আছে, তারা যাতে মুনাফা নিয়ে যেতে পারে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।

ভৌত অবকাঠামো নিয়ে আমাদের উদ্বেগের দিন শেষ হয়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ সন্তোষজনক, ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু হয়েছে। কিন্তু আমরা নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারছি না। এখন যারা বিনিয়োগ করছেন তারা পুরোনো বিনিয়োগকারী এবং সাধারণত পুনর্বিনিয়োগ করছেন। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা যে অভিযোগ করছেন সেটা হলো, অর্জিত মুনাফা তুলে নিতে পারছেন না। বিনিয়োগ আকর্ষণের বিষয়গুলো হয়তো সরাসরি বাজেটে থাকে না; কিন্তু নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

মূল্যস্ফীতি কমানো দরকার। সরকার যেমন চায় তেমনি বেসরকারি খাতও চায়। আশা করা যায়, কয়েক মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে। কারণ আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিং সূচক বেড়েছে, কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে বোরোর ভালো ফলন হয়েছে। এটা যদি অব্যাহত থাকে আশা করা যায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।

বাংলাদেশের কর আহরণ বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে কর আহরণ। সব মিলিয়ে বলা যায়, অর্থনীতিতে একটা পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে, আমাদের ভীত বা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, অর্থ পাচার প্রতিরোধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে আমরা আগের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসতে পারি।

আয়ের পরিমাণ অনুযায়ী কয়েক ধাপে ভাগ করে কর কাঠামো করা হয়েছে। এর ফলে ধনীরা বেশি কর দেবেন। হলে এটা যথার্থ হয়েছে। এবারের বাজেটে আয় করের ওপরে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বপ্রণোদিত হয়ে কর দেওয়াকে উৎসাহিত করা হবে। ইলেকট্রনিক্স সিস্টেম ডিভাইস প্রসারের কথা বলা হয়েছে, যেটা আগেও ভাবা হয়েছিল; কিন্তু কার্যকর করা হয়নি। আমাদের নতুন অর্থমন্ত্রী বলছেন তিনি এ দিকটাতে জোর দেবেন।

প্রতিটি দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তাদের ট্যাক্স সার্টিফিকেটের কপি প্রতিষ্ঠানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। আমার কাছে এটা একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি মনে হয়েছে। প্রতিটি দোকানের ক্রেতারা এতে জানতে পারবেন যে দোকানের ট্যাক্স সার্টিফিকেট আছে কি না। আমার মনে হয় এতে ট্যাক্সের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এ ছাড়া আমদানিকৃত ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন, ফ্রিজের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে দেশীয় পণ্য আরও প্রসারিত হবে।

এবারের প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জও দেখা যায়। অর্থের ঘাটতির জন্য আমাদের একটি ছোট পরিসরের বাজেট করতে হলো। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এবার ৯ লাখ কোটি টাকার বাজেট করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা করেছি ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট। আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি কম এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপরে চাপ রয়েছে। এজন্যই বাজেটের আকার ছোট করতে হয়েছে।

আমাদের জন্য ইতিবাচক দিক হলো, ২০২৪-এর শুরুতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়েছে। রেমিট্যান্স বেড়েছে দুই বিলিয়ন ডলার। আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। সুতরাং যথাযথ ব্যবস্থাপনায় বাজেটের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কঠিন হবে না। তবে বাজেটের সর্বোচ্চ এবং যথাযথ বাস্তবায়নটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

আমাদের চলতি অর্থবছরের বাজেট সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে পারিনি অর্থের অভাবে নয়, ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার কারণে। দেশে তেমন অর্থের সংকট নেই। হয়তো আমাদের অদক্ষতা রয়েছে। সরকারের সব প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন। সুশাসন এবং জবাবদিহি ছাড়া বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হবে।

লেখক: সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইকুয়েডরের ম্যাচে আর্জেন্টিনার জন্য অপয়া রেফারি!

বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করবে বিএনপি 

৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ

রোনালদোকে হারাতে চান এমবাপ্পে

বেলিংহ্যামের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিল রিয়াল

জাতীয় পর্যায়ে একক অভিনয়ে প্রথম হওয়ায় নিশাত তাছনিমকে সংবর্ধনা

অপরাধী থেকে ধর্মগুরু বনে যাওয়ার রোমহর্ষক কাহিনী

কোটাবিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা

ঢাকায় বাসচাপায় মোটরসাইকেল চালক নিহত

মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের দাবি

১০

চলন্ত ট্রেন আটকে দিল আন্দোলরত শিক্ষার্থীরা

১১

বিদেশি শিক্ষার্থীদের সুখবর দিল ডেনমার্ক

১২

উইম্বলডনের তৃতীয় রাউন্ডে জোকোভিচ

১৩

চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে / ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ঘিরে অস্বস্তি

১৪

বিশ্বরেকর্ড হয়নি, তবে ৫৯২ রান তুলে টাই করেছে গ্লামারগন

১৫

মানবতাবোধ কোনো ধর্ম দেখে না : মেয়র আইভী

১৬

অধ্যক্ষের ছেলের বিয়েতে বাধ্যতামূলক ৫০০ টাকা চেয়ে নোটিশ

১৭

জাবি শিক্ষার্থীদের ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ

১৮

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে পররাষ্ট্র সচিব

১৯

সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ বন্ধু নিহত

২০
X