সাতটি দফায় ভারতের লোকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে । মোট ভোটার ছিল ৯৬ কোটি ৮০ লাখ এবং ৬৪ কোটি ২০ লাখ ভোটার ভোট দিয়েছেন, ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬৬.৩ শতাংশ। এই নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ফল ঘোষণার পর প্রায় সব রাজনৈতিক দল বিজয় উৎসব করেছে। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে তাদের কাছেই সরকার গড়ার প্রথম নিমন্ত্রণ আসা স্বাভাবিক; কিন্তু তার জন্য বিজেপির প্রয়োজন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের (এনডিএ) জোট সঙ্গীদের। অন্ধ্রপ্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড) পার্টি বা চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি—এসব এনডিএ সদস্য দল মিলেজুলে বিজেপিকে সরকার গঠনের সুযোগ করে দিয়েছে। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, সেই মোদি কি রইবেন এই মোদি? কন্যাকুমারীতে ধ্যানভঙ্গের পর তিনি বললেন যে, তিনি ‘নতুন স্বপ্ন’ দেখতে শুরু করেছেন। মোদিকে যারা লক্ষ করেছেন তারা জানেন, তিনি মোটেই কবিত্বময় স্বপ্নবিলাসী নন। তার পরিভাষায় স্বপ্ন মানে নতুন অ্যাকশন প্ল্যান। যারা ভাবছেন যে, এই নির্বাচনের ফলে অন্তত দমিত হবে নরেন্দ্র মোদির অহংকার, তারা বোধ হয় ঠিক ব্যাপারটি বুঝতে পারেননি। অধিকাংশ আইন সংশোধিত হয় সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়—কেবল কিছু সাংবিধানিক পরিবর্তনের জন্য আয়োজন হয় বিশেষ গরিষ্ঠতার, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার। সরকারের বিপুল অর্থভান্ডার, ইডি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং পেগাসাস জাতীয় সফটওয়্যার হাতে থাকলে সব আইনপ্রণেতা কি থাকতে পারেন প্ররোচনার ওপরে? নরেন্দ্র মোদির গত দশ বছরের মতিগতি দেখে কিন্তু ভারতের জনগণ তাকে পরিত্যাগ করেননি। ২০১৯ সালের চেয়ে অধিক শতাংশের মানুষ এবার তাকে ভোট দিয়েছেন। তিনি পূর্ণ সমর্থন পেয়েছেন দিল্লির মতো ধনী শহরে, অথবা উত্তরাখন্ড বা হিমাচল প্রদেশের মতো রাজ্যে, যেখানে বাস করতেন মূলত উচ্চবর্ণের ধনী জমি মালিক, যাদের মধ্যে অনেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জড়িত হওয়ার দরুন বিজেপির দেশপ্রেম সংক্রান্ত কথাবার্তায় বিশেষ স্পর্শকাতর। ব্যাপক অর্থে, সম্পন্ন শহুরে মানুষের সমর্থন আদায় করেছেন মোদি। দুটো পাঁচ বছর চালিয়েছেন মোদি। আর অঙ্ক মেলাতে তার জুড়ি নেই। এত কিছুর পরও দক্ষিণে ভোট বেড়েছে বিজেপির। শুরু এবং শেষ জানা ছিল আগেই। কিন্তু শুক্রবার দুপুরে এনডিএর নেতা হিসেবে নরেন্দ্র মোদির পুনর্নির্বাচন পর্বের বাকি অংশে ‘চমক’। বক্তাদের তালিকায়, শরিকি ঐক্যের ছবি তুলে ধরায়, এমনকি ব্যক্তি মোদির পরিবর্তে এনডিএর ‘মাহাত্ম্য’ প্রচারেও। যা দেখে বিরোধীদের একাংশ প্রধানমন্ত্রীর এক দশক আগেকার স্লোগানে ঈষৎ মোচড় দিয়ে বলছেন, এ হলো ‘সব কা সাথ, মোদি কা বিকাশ’। অর্থাৎ, নিজেকে তুলে ধরার জন্য সবার শরণাপন্ন হতে হচ্ছে মোদিকে। বাস্তবে হলোও তা-ই। এনডিএর একের পর এক শরিক দলের নেতা মোদির প্রশস্তি গাইলেন। এনডিএ তো বটেই, বিজেপির অন্দরেও যে নেতার সঙ্গে মোদির সম্পর্ক ‘মসৃণ’ নয় বলেই শাসক শিবিরের সবাই জানেন, তাকেও বক্তৃতা দেওয়ানো হলো। মোদির ‘সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা’ তুলে ধরতেই পুরোনো সংসদ ভবনের সেন্ট্রাল হলের ওই বৈঠকে বিজেপি এবং সহযোগী দলগুলোর লোকসভা সাংসদদের পাশাপাশি ‘আমন্ত্রিত’ তালিকায় ছিলেন রাজ্যসভা সাংসদরাও। আমন্ত্রিত ছিলেন বিজেপি এবং এনডিএ-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা। একেবারে সামনের সারিতে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। এক ঘণ্টা ১২ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের ওই ভাষণে পুরো ভারতের রাজনীতির অলিগলির বর্ণনা দিয়েছেন। লোকসভা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভায় ভালো ফল করেছে চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি (তেলেগু দেশম পার্টি)। মঙ্গলবার হয়েছে ফল ঘোষণা। এই আবহে গত পাঁচ দিনে নাইডুর তৈরি করা সংস্থার লাভ বৃদ্ধি পেয়েছে লাফিয়ে। গত পাঁচ দিনে হেরিটেজ ফুডস সংস্থার শেয়ারের দর ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে নাইডুর স্ত্রী ভুবনেশ্বরীর সম্পত্তির পরিমাণ হয়েছে ৫৭৯ কোটি টাকা। ভুবনেশ্বরী ওই সংস্থার অন্যতম কর্তা।
৪ জুন, মঙ্গলবার ভোটের ফল ঘোষণা হয়েছে। তার আগের দিন, ৩ জুন, হেরিটেজ ফুডস সংস্থার শেয়ারের দাম ছিল ৪২৪ টাকা। শুক্রবার এই সংস্থার শেয়ারের দাম হয়েছে ৬৬১.২৫ টাকা। ১৯৯২ সালে এই সংস্থা তৈরি করেছিলেন চন্দ্রবাবু। সংস্থার ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে, ‘ভারতে যেসব সংস্থার দ্রুত বৃদ্ধি হচ্ছে, তাদের মধ্যে অন্যতম।’ দুই ধরনের ব্যবসা রয়েছে সংস্থার, দুধ এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির। এখন এই সংস্থা অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কেরালা, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, হরিয়ানা, এনসিআর দিল্লি, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশে দুধ এবং দুগ্ধজাত জিনিস বিক্রি করে।
(দুই) আমাদের দেশের নির্বাচন আর ভারতের নির্বাচনের গুণগত পার্থক্য নিশ্চয় আছে। ভারতের নির্বাচনের ইতিহাসে একজন টিএন সেশন ছিল। আর আমাদের নির্বাচনী ইতিহাসে নির্বাচন বর্জনের ইতিহাস আছে। ভারতের ৭৫ বছরের ইতিহাসে নির্বাচন বর্জনের ইতিহাস নেই। ভারতের ৭৫ বছর রাজনীতিতে জোট রাজনীতির ভাঙাগড়ার ইতিহাস আছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ইন্দিরার কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু ভারতের আদালতে উচ্চ আদালতে রাজনারায়ণ বনাম ইন্দিরা মামলা দীর্ঘ সময় ধরে চলে । ১৯৭৭ সালের জরুরি অবস্থা পর্যন্ত চলমান ছিল। প্রথমেই উল্লেখ করেছি, ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। কেউ কেউ রাজনৈতিক ভাষণে ইভিএম একটু-আধটু আপত্তির কথা জানালেও সার্বিক বিচারে তা মেনে নেয়। এবং বড় রাজনৈতিক ইস্যু করে না। এবং এবারের লোকসভা নির্বাচনে আরেক দিক দিয়ে অনন্য সাধারণ বিজয়ী দল আর বিজিত দল আনন্দ উৎসব করেছে। তার মানে সবাই জিতেছে।
(State of Uttar Pradesh v. Raj Narain)
On 12 June 1975, Justice Jagmohanlal Sinha found Gandhi guilty of electoral malpractices. Sinha declared the election verdict in the Rae Bareilly constituency “null and void”, and barred Gandhi from holding elected office for six years. While Sinha had dismissed charges of bribery, he had found Indira guilty of misusing government machinery as a government emplo–ee herself.[1] The court order gave the Congress (R) twenty days to make arrangements to replace Gandhi in her official posts. This was unprecedented. Its impact finally led to the fall of Congress regime at the centre immediately after emergency. Raj Narain became a national hero for overthrowing Gandhi’s and the Congress’s regime after 30 years of independence, initially by trouncing Gandhi in judicial battle and later in 1977 Loksabha elections.This fulfilled an unrealised dream of his friend and mentor Ram Manohar Lohia. Gandhi appealed the verdict to the Supreme Court of India, which granted a conditional stay of execution on the ruling on 24 June 1975. On 7 November 1976, the Supreme Court of India formally overturned the conviction.
(৩) এই লেখা যখন ছাপা হয়েছে তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই তার দিল্লি যাওয়া। বলা হয়ে থাকে, এখনকার সময়টা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়। কিন্তু ভেবে দেখা দরকার, সব সময় এ রকম সম্পর্ক ছিল না। সামান্য দু-একটা তথ্য দিলেই তা পরিষ্কার হবে। ২০০১ সালের আগস্ট মাসে নির্বাচনের আগে উচ্চ পর্যায়ের একটি বিএনপি প্রতিনিধিদল ভারত সফর করে। একই মাসে ২৬ আগস্টে ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ জানায়, বিএনপির নেতা রিয়াজ রহমান জানিয়েছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ভারতে গ্যাস রপ্তানি করবে। বাংলাদেশে ভারতের পণ্য উন্মুক্ত করা হবে এবং সব ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হবে। ২০০২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশ গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তিকে কার্যকর করার প্রস্তাব দেয়। স্মরণে থাকবে, এই পানি চুক্তি আওয়ামী লীগ সরকার অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে হয়েছিল। ওই পানিচুক্তি নিয়ে কত কথায় না আওয়ামীবিরোধী শক্তি বলেছিল। অথচ বেগম জিয়া সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ‘এ চুক্তিই বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছে।’ ২০০৩ সালের মার্চ মাসে, ভারত অভিযোগ করে, বাংলাদেশে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ এর কোনো প্রতিবাদ করেনি। ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভারত থেকে জঙ্গিরা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। সেখানে তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ জঙ্গিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করে লস্কর-ই-তৈয়বাসহ বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ভারত বাংলাদেশ সরকারকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে। ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে, উলফা নেতা অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের বৈঠক ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় বলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়। এই রিপোর্ট পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো হলেও এ ব্যাপারে ঢাকা কোনো প্রতিবাদ করেনি। ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে, নিরাপত্তার কারণে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় সার্ক সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। ২০০৬ সালের ২০ মার্চ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তিন দিনের ভারত সফরে যান। এই সফরে গঙ্গার পানি চুক্তি, পার্বত্য চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ ইত্যাদি কোনো প্রসঙ্গ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়নি। সত্যি সত্যি বর্তমান সময়কালকে বলা হয় ‘সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়’। একটা উদাহরণই যথেষ্ট যে, দুই দেশ খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে চার দশকের অধিক সময় অমীমাংসিত থাকা স্থল সীমান্ত চুক্তি সম্পন্ন করেছে, যেখানে বাংলাদেশ বেশি লাভবান হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে বেশি ছিটমহল পেয়েছে। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল রয়েছে, যার আয়তন ১৭ হাজার ১৪৯ একর। অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলের সংখ্যা ৫১টি, যার আয়তন ৭ হাজার ১১০ একর। বিলটি পাস হওয়ায় এসব ছিটমহল বিনিময় হতে বাধা নেই। এবং ভারতের নিম্নকক্ষ লোকসভা ও উচ্চকক্ষ রাজ্য যৌথসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়েছে। কারও কারও মনে থাকার কথা, রাজ্যসভার এক সংসদ সদস্য অধিবেশন চলাকালীন সেই কালজয়ী গানটি গেয়েছিলেন, ‘একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মুজিবরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে...’।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক