দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং এই দলের সরকার ঘাড় থেকে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদকে ফেলে দিতে চাচ্ছে। গত মঙ্গলবার এক দলীয় অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এই দুজন আওয়ামী লীগের কেউ নন।
তাহলে প্রশ্ন জাগে তাহলে তারা কার? একটা কথা ঠিক যে, এ দুজন দল করতেন না, কিন্তু আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার কর্তৃক তারা এসব পদে বসেছিলেন এবং সরকারের অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে তাদের এ দুটি পদে বসাত না, এটা সবাই জানে। আওয়ামী লীগের প্রতি দলীয় আনুগত্যের কারণেই তারা এ শীর্ষ পদে এসেছেন।
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে বেনজীর ও আজিজ ইস্যুটি এড়িয়ে যেতে চায় আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু নাগরিক মনে প্রশ্ন জাগছে ঠিকই যে, বেনজীর ও আজিজের দুর্নীতি এবং বেআইনি কর্মকাণ্ডের দায় কি সরকার এড়াতে পারে? আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অবশ্য বলেই যাচ্ছেন যে, তাদের কর্মকাণ্ড ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হবে।
সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কারণে’ যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের ৭০৩১ (সি) ধারার আওতায় বাংলাদেশের সাবেক জেনারেল আজিজ আহমেদের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ‘তার কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ন করতে ভূমিকা রেখেছে’।
দেশের ভেতরে জেনারেল আজিজকে নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ নেই। অবশ্য তার ভাইদের বিষয়ে অনেক রিপোর্ট হয়েছে, যেখানে আইন অমান্যের বড় নজির আছে। তবে সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির যে ফিরিস্তি বের হচ্ছে, তা পড়ে শেষ করা যাচ্ছে না। একটা মানুষ সরকারি পদ ব্যবহার করে দেশ-বিদেশে এত সম্পদ দখল করতে পারেন, এত অর্থ কামাতে পারেন তা অবিশ্বাস্য। একেবারে রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। প্রায় প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্তে তার জমির খবর আসছে। বেনজীর আহমেদের সামগ্রিক বিষয়টি বিবেচনা করলে সেটা আর দুর্নীতির পর্যায়ে থাকে না, একেবারে নিরেট কুকর্ম বলেই প্রতীয়মান হয়।
তারা দুজন সরকারে ছিলেন, সরকারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে কাজ করেছেন। জেনারেল আজিজ সেনানিবাসে বাস করেছেন বিধায় মানুষ থেকে কিছুটা দূরেই ছিলেন। কিন্তু জনজীবনে বেনজীর আহমেদের উপস্থিতি ছিল একেবারে আলাদা। তার ভাব-ভঙ্গিমায় দৃশ্যমান ছিল যে, তিনিই সরকার, সরকারি কর্মচারী নন। এই যে এত অনিয়ম, দুর্নীতি, দখল এগুলো সবই হয়েছে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে এবং সেটা সরকার জানত না এমন কথা কোনো অপ্রকৃতস্থ মানুষও বিশ্বাস করবে না।
এ দুই ব্যক্তির কাণ্ড নিয়ে এখন আওয়ামী লীগ-বিএনপি তর্কযুদ্ধ হচ্ছে। ওবায়দুল কাদের আর মির্জা ফখরুল রীতিমতো ঝগড়া করছেন। এতে করে ক্ষমতা ব্যবহার করে দুর্নীতি করার বিষয়টি আড়ালে চলে যাচ্ছে। কিন্তু আলোচনা এবার যখন উঠেছে, কিছুদিন হলেও চলবে। বাংলাদেশে উন্নয়ন নিয়ে যত আলোচনা হয় বা হয়েছে, দুর্নীতি নিয়ে ততটা হয় না এবং হয়নি। এবার কিছুটা শুরু হলো।
সরকার এ আলোচনা চায় না। কিন্তু মানুষ চায়। হাতের কাছে যাকে পাবেন, তাকেই একটা প্রশ্ন করলে দশজনের মধ্যে অন্তত আটজন বলবেন, দুর্নীতিই বড় ইস্যু। দ্রব্যমূল্যের পাগলা আঘাতে মানুষের জীবন যে আজ পর্যুদস্ত তার মূলে এই দুর্নীতি। বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণ, সরকারের কেনাকাটা, উন্নয়নের আরও নানা প্রকল্প, নিয়োগ, বদলি, রাজনৈতিক মনোনয়ন প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয় বলে মানুষের শক্ত ধারণা আছে। আর আগ্রাসী দুর্নীতি ও অনিয়মে ব্যাংক খাতের দুরবস্থার কথা
সবাই অবগত।
অর্থাৎ দুর্নীতি বিষয়টি কোনো সরলরৈখিক কিছু নয়। তার বহু স্তর, বহু মাত্রা, বহু দিক রয়েছে। সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত, সরকারের পুরো গায়েই অনিয়মের কলঙ্ক—এমন দাবি করার জন্য এ লেখা লিখছি না। কিন্তু বলতে হচ্ছে যে, দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেশের বিচারহীনতা চলছে। বেনজীরের ব্যাপারে কথা উঠেছে। তদন্ত শুরু হয়নি এখনো। হয়তো তদন্ত হবেও। কিন্তু কখনো জানা যাবে না কোথায় তার কতখানি দোষ ছিল যেমন করে বেসিক ব্যাংক লোপাটকারী আবদুল হাই বাচ্চুর দুর্নীতির বিষয়টি জনপরিসর থেকে হারিয়েই গেছে।
দুর্নীতি এক কথা আর জনপরিসরে সেই দুর্নীতির নির্মাণ সম্পূর্ণ অন্য কথা। দুর্নীতি অনেকেই করে। কিন্তু বেনজীর আহমেদ দুর্নীতির নতুন বৈশিষ্ট্যের নির্মাতা। এক ব্যক্তি এতটা আগ্রাসী, এতটা দখলবাজ, এতটা ক্ষমতা প্রয়োগ, তার এত দিকে থাবা—এমনটা আগে দেখা যায়নি। তিনি নিজে হয়ে উঠেছেন দুর্নীতির এক তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ।
ওবায়দুল কাদের মিডিয়াকেও দুষেছেন। বলেছেন মিডিয়া কেন আগে রিপোর্ট করেনি। বেনজীরের মতো সরকারের সবচেয়ে আস্থাবাজন ক্ষমতাধর ব্যক্তির দুর্নীতির রিপোর্ট যে করা যায় না, করার মতো পরিবেশ দেশে নেই সেটা ওবায়দুল কাদের ভালো করেই জানেন। কিন্তু রাজনৈতিক ময়দানে তাকে এসব কথা বলতে হয়। তবে এ কথা সত্য যে, দুর্নীতির বহুমাত্রিক ঘটনা শেষ পর্যন্ত একমাত্রিক আখ্যানে পরিণত হলো বেনজীরকে কেন্দ্র করে এবং তাতে গণমাধ্যম ও প্রচারের ভূমিকা অবশ্যই আছে।
দুর্নীতি জিনিসটা বাংলাদেশে নতুন নয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি সংস্থা প্রতি বছর একটি সূচক প্রকাশ করে—করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স। বিশ্বের প্রায় সব দেশে সমীক্ষা করে মাপা হয়, কোন দেশের মানুষ নিজেদের দেশকে কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করেন। সেই সূচকে দেখা যায়, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগেও দুর্নীতির মাপকাঠিতে গোটা দুনিয়ায় আমরা যে জায়গায় ছিলাম, তার থেকে অবস্থা না বদলে খারাপের দিকেই আছি।
সাধারণ মানুষ প্রতিদিন যে দুর্নীতির শিকার হন এবং যে দুর্নীতি করেন, তা ছোট মাপের দুর্নীতি। পুলিশের ঘুষ খাওয়া, সরকারি দপ্তরে ফাইলের স্থিতাবস্থা ভাঙতে টেবিলের নিচ দিয়ে কিছু আদান-প্রদানের মতো দুর্নীতি, বিদ্যুৎ ও পানির বিল দিতে ঘুষ দেওয়া, জমির খাজনায় টাকা দেওয়া, কর কমবেশি করতে নজরানা দেওয়ার মতো দুর্নীতিতে মানুষের তীব্র রাগ হয়, দুর্নীতির ধারণাও বাড়ে। কিন্তু এসব দুর্নীতির দায় পুরোটাই সরকারের ঘাড়ে চাপানো মুশকিল। কারণ সরকারি কর্মকর্তারা যেন মানুষকে সেবা দেন সেজন্য তাদের বেতন আর সুবিধা হয়েছে আকাশচুম্বী।
কিন্তু মিডিয়া যখন বেনজীর আহমেদের মতো নায়কোচিত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে দেয়, তখন বিষয়টি আর সাধারণ পর্যায়ে থাকে না যে সরকার অস্বীকার করবে। রাজনীতি এ উন্মোচনকে বিচিত্রভাবে ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু তাতে দায় এড়ানো যায় না। খুচরা দুর্নীতির দায় সরকার না নিলেও এসব বড় দুর্নীতির দায় নিতেই হয়।
গোটা দেশজুড়ে দুর্নীতির যে রমরমা চলছে, তার কারণ রাজনৈতিক। কারণ ক্ষমতা কাঠামোকে ব্যবহার করেই এসব দুর্নীতি হয়। আর সে কারণেই যে দলের সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, এই দুর্নীতি ঠেকানোর উপায় নেই। বিএনপি আমলে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কথাটা ভেবে দেখতে হবে সেই বিবেচনাতেই। ব্যাংক খাতে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক আর্থিক জালিয়াতি, পি কে হালদারের লিজিং ডাকাতি, কোনো একক ব্যক্তির ব্যাংক খাত দখলের কেলেঙ্কারি, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি সবই হয়েছে ক্ষমতাবানদের দ্বারা। বেসরকারি ক্ষেত্রেও যে বড় বড় অনিয়ম হয় সেগুলোই রাজনৈতিক যোগসাজশে। এগুলো সবই বড় বড় দুর্নীতি, কিন্তু তেমন কিছু হয়নি কারও।
দুর্নীতির গল্পগুলো এখন মানুষের সামনে উন্মোচিত। শাস্তির ভয় নেই, তাই সামাজিক স্তরে গল্প তৈরি হলেও ব্যক্তি বিচলিত হয় না। সে দুর্নীতি করে। দুর্নীতি দমনে স্থায়ী ভূমিকা গ্রহণ করে নীতিজ্ঞান। আমাদের রাজনীতিতে নীতি বলে কিছু নেই আর সে কারণেই শাসনব্যবস্থা হয়ে ওঠে দুর্নীতি-সহায়ক।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল