সোমবার সন্ধ্যায় এটিএন নিউজের চিফ রিপোর্টার সহকর্মী আরাফাত সিদ্দিকী সোহাগ ফোন করে জানতে চাইলেন, ভাই, শফী ভাই কি মারা গেছেন? প্রশ্ন শুনে আমি চমকে গেলাম। অবিশ্বাসে বললাম, হয়তো ভুল শুনেছেন। শফী ভাই তো ভালো আছেন। আজও তো ফেসবুকে সক্রিয় দেখলাম। পরে চেক করে দেখলাম ২০ ঘণ্টা আগেও তিনি ফেসবুকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা ‘দেখা হবে’ শেয়ার করেছেন। তখনো কি তিনি জানতেন আর দেখা হবে না। শফী ভাই ফেসবুকে নানা পোস্ট করতেন। সরকারি দল করলেও সরকারের বিচ্যুতির নানা সমালোচনা করতেন অবলীলায়। বয়স ৬৩ হলেও দেখে বোঝার উপায় ছিল না। ছোটখাটো গড়নের শফী ভাই ছিলেন প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, সব বয়সের মানুষের সঙ্গে মিশতেন বন্ধুর মতো। তার মৃত্যুর খবর তাই অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়। কিন্তু মৃত্যু তো আর আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কল্পনার সীমা মেনে চলে না। কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেল আমাদের যৌবনের সাহস শফী আহমেদ সত্যি আর নেই। সন্ধ্যায় উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালের ডাক্তাররা তার মৃত্যু নিশ্চিত করলেও আসলে শফী ভাই মারা গেছেন বিকেলেই উত্তরার নিজ বাসায়। সময়টা অবশ্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। অনেকক্ষণ ঘুমানোর পর ডাকতে গিয়ে দেখা গেল, তিনি আর সাড়া দিচ্ছেন না। ঘুমের মধ্যেই চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি ছাত্রনেতা শফী আহমেদ।
শফী ভাইয়ের মৃত্যুর খবর আমাকে হঠাৎ স্মৃতিকাতর করে তুলল। বয়সের কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করতে পারিনি। তবে আমাদের প্রজন্মের সেরা সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। আমাদের যৌবনকে আমরা মহিমান্বিত করেছিলাম স্বৈরাচার হটানোর কাজে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম এক সাহসী সংগঠকের নাম শফী আহমেদ। এখনকার প্রজন্মের কাছে শফী আহমেদ কেউ নয়, নিছক ভুলে যাওয়া এক নাম। কিন্তু শফী আহমেদ ছিলেন ছাত্ররাজনীতির এক কিংবদন্তি।
ইদানীং ছাত্ররাজনীতি নিয়ে নানান নেতিবাচক আলোচনা হয়। বুয়েটের মতো দেশসেরা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি থাকা না থাকা নিয়ে তুলকালাম হয়। অথচ এই বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস। তেইশ বছরের মুক্তি সংগ্রাম, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণআন্দোলন—সবকিছুতেই সামনের সারিতে ছিলেন ছাত্রনেতারা। ছাত্ররাজনীতির সেই গৌরবের ইতিহাস আজ বিস্মৃতপ্রায়। ছাত্রনেতাদের এখন সাধারণ ছাত্ররা ভয় পায়। অথচ একসময় ছাত্রনেতারা শুধু ছাত্রদের নয়, দেশের মানুষের নায়ক ছিলেন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রনেতাদের ভালোবাসত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে তাদের বক্তৃতা শুনত। সাধারণ ছাত্রদের ভরসার জায়গা ছিল ছাত্রনেতারা। শফী ভাইয়ের মৃত্যুর পর সাংবাদিক ইরাজ আহমেদ লিখেছেন, আড়ালে তিনি শফী ভাইকে ‘ছাতা’ বলে ডাকতেন। বিপদ যাই আসুক, শফী ভাই সবাইকে আগলে রাখতেন। শুধু শফী ভাই নন, ছাত্রনেতাদের অনেকেই সাধারণ ছাত্রদের বিপদে ছাতা হয়ে আড়াল করে রাখতেন।
বিরাশি থেকে নব্বই—স্বৈরাচার এরশাদের এই ৯ বছরের শাসনকাল ছিল বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়। তিরাশির মধ্য ফেব্রুয়ারিতে এরশাদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধটা গড়েছিল ছাত্ররাই। নব্বইয়ে গণআন্দোলনও গড়েছেন ছাত্ররাই। নব্বইয়ের ১০ অক্টোবর শহীদ জিহাদের লাশ সামনে রেখে গড়ে ওঠা সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় এরশাদের পতন নিশ্চিত হয়েছিল। এই সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের অন্যতম কারিগর ছিলেন শফী আহমেদ।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতির সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আরও ছোট করে বললে মধুর ক্যান্টিন। দারুণ সহাবস্থান ছিল সেখানে। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজ আর মৌলবাদী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির ছাড়া সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারত। একটা অলিখিত দখলদারিত্বও ছিল। টিএসসি থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত রাস্তার উত্তরপাশের হলগুলো ছিল ছাত্রদলের দখলে আর দক্ষিণপাশের হলগুলো ছিল ছাত্রলীগের দখলে। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর দেশে গণতন্ত্র এলেও শিক্ষাঙ্গনে শুরু হয় এক অগণতান্ত্রিক পরিবেশ। আগে যেখানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকতেই পারত না, এরশাদ পতনের পর থেকে সেখানে শুধু ক্ষমতাসীনদেরই আধিপত্য। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ; এভাবেই চলে আসছে ৩৪ বছর। স্বৈরাচার হটিয়ে আমরা কী অদ্ভুত গণতন্ত্র যে আনলাম!
জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসনামলেও ডাকসুতে পাঁচবার নির্বাচন হয়েছে। আর এরশাদ পতনের পরের ৩৪ বছরে হয়েছে মাত্র একবার। নির্বাচন দিলেই পরাজয়ের শঙ্কার কারণে ২০১৯ সালের পর সরকার আর সে পথে হাঁটেনি। পুরো ক্যাম্পাস দখলে থাকার পরও ছাত্রলীগের হারার ভয় কেন, এটা কি কখনো ভেবে দেখেছেন ছাত্রলীগ নেতারা। তার মানে তারা জোর করে দখলদারিত্ব কায়েম করলেও ভালোবাসা পাননি। ভয় দেখিয়ে দখল করা যায়, ভালোবাসা জয় করা যায় না।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের এক দশকে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের অন্তত ১০০ ছাত্রনেতা ছিলেন দেশজুড়ে পরিচিত নাম। অন্তত ২০ জন তো ছিলেন সুপারস্টার। যাদের অনেকেই এখন নানা পর্যায়ে জাতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমি এখনো অন্তত ৫০ জন ছাত্রনেতার নাম বলতে পারব টানা, যাদের অনেকের সঙ্গে আমাদের এখনো যোগাযোগ আছে, আছে সেই ভালোবাসার টান। গত ৩৪ বছরে এক নুরুল হক নুর ছাড়া সারা দেশের মানুষ এক নামে চেনে, এমন আর কোনো ছাত্রনেতা নেই। সেই নুরও যতটা আলোচিত, তার চেয়ে বেশি সমালোচিত। অনেকেই বলেন, ডাকসুর ভিপিদের নামের তালিকায় সবচেয়ে বেখাপ্পা নামটি নুরুল হক নুর।
বলছিলাম শফী আহমেদের কথা। তিনি মারা গেছেন আওয়ামী লীগার হিসেবে। কিন্তু দেশজুড়ে তার পরিচিতি আসলে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ‘ছাত্রলীগ’ নামে একাধিক সক্রিয় সংগঠন ছিল। আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের পাশাপাশি জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগও বেশ জনপ্রিয় ছিল। তাই আলাদা করতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে সংগঠনকে ব্র্যাকেটবন্দি করা হতো। যেমন ছাত্রলীগ (সু-র) মানে সুলতান-রহমান বা ছাত্রলীগ (হা-অ) মানে হাবিব-অসীম আওয়ামী লীগ সমর্থিত। আবার ছাত্রলীগ (শি-মু) মানে শিরিন-মুশতাক, ছাত্রলীগ (না-শ) মানে নাজমুল-শফী; ছিল জাসদ সমর্থিত। এরশাদ আমলে একবার দুই ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন মিলে ডাকসুতে প্যানেল দিয়ে জয় পেয়েছিল। ভিপি হয়েছিলেন আওয়ামী ছাত্রলীগের সুলতান মনসুর, জিএস জাসদ ছাত্রলীগের মুশতাক আহমেদ, এজিএস ছাত্র ইউনিয়নের নাসিরউদদোজা। তখন মাঠ ছিল উত্তাল, আন্দোলনমুখর। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে শফী আহমেদ ছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ছোটখাটো গড়নের হলেও মিছিলে, মিটিংয়ে, স্লোগানে, লড়াইয়ে শফী ভাই সবসময় সামনের কাতারেই থাকতেন। তবে শফী ভাইয়ের আসল কৃতিত্ব ছিল কৌশল প্রণয়নে। ছাত্রঐক্যের বৈঠকে আন্দোলনের কৌশল ও কর্মসূচি নির্ধারণ, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে দারুণ পারঙ্গম ছিলেন তিনি। আন্দোলন নস্যাৎ করতে স্বৈরাচারের দোসরদের নানা কৌশলও নস্যাৎ হয়ে যেত শফী ভাইয়ের পাল্টা চালে।
ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল অধ্যায় শেষে জাতীয় রাজনীতিতে পা রেখেছিলেন শফী আহমেদ। জাসদ হয়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। তবে আওয়ামী লীগ থেকে কিছুই পাননি তিনি। ছাত্রলীগের কমিটিতে তার সভাপতি নাজমুল হক প্রধান জাসদে থেকেই এমপি হয়েছেন। কিন্তু শফী ভাই আওয়ামী লীগে এসে মনোনয়নই পাননি। একেবারে পাননি বললে ভুল হবে। ২০০৭ সালের নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে সেবার নির্বাচনই হয়নি। এরপর চারটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা জয় পেয়েছে, কিন্তু শফী ভাইয়ের কপালে আর মনোনয়ন জোটেনি। মনোনয়ন না পেলেও রাজনীতি ছাড়েননি তিনি, ছাড়েননি এলাকার জনগণকেও। নেত্রকোনার হাওরের মানুষ তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। মনোনয়ন না পেয়ে শফী ভাই যতটা বঞ্চিত হয়েছেন, তার মতো তীক্ষ্ণ মেধার একজন মানুষকে কাজে লাগাতে না পারায় আওয়ামী লীগের ক্ষতিও কম নয়। অবশ্য আওয়ামী লীগে এখন স্মার্ট হাইব্রিড নেতাদের দাপটে শফী ভাইয়ের মতো মাটি-মানুষের নেতারা বড্ড বেমানান। শফী ভাইদের থাকা না থাকায় এখন আর কিচ্ছু যায় আসে না। শফী ভাইয়ের বুকভরা অভিমান ছিল; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে, অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কখনো আপস করেননি। তিনি জাসদ ছাড়লেও জাসদ তাকে ছাড়েনি। আগেও যেমনটা বলেছি, আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও তার পরিচিতি ছিল জাসদ হিসেবেই। শফী ভাই হয়তো পুরোপুরি আওয়ামী লীগার হতেই পারেননি। মৃত্যুর পর গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সর্বত্রই জাসদ এবং বাম ঘরানার সাবেক ছাত্রনেতাদের হাহাকার।
সাবেক ছাত্রনেতা ও সাংবাদিক মহসিন আব্বাস শহীদ মিনারে বলছিলেন, স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য প্রতিরোধের দুর্ভেদ্য দেয়াল গড়ে তুলেছিল। শফী আহমেদের বিদায়ে সেই দেয়ালের একটি ইট খসে পড়ল। আস্তে আস্তে হয়তো দেয়ালটাই খসে পড়বে। সময়ের নির্মম থাবা হয়তো একদিন সেই দেয়াল নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তবে ইতিহাসে থাকবে ছাত্ররাজনীতির সেই গৌরবের কথা, ছাত্রনেতাদের সেই বীরত্বের গল্প। আবার কি কখনো ছাত্ররাজনীতি ফিরে পাবে গৌরবের কাল?
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ