বাংলাদেশের নতুন বাজেট সামনে রেখে তাৎক্ষণিকভাবে তিনটি প্রধান বিষয় সামনে আসে। এক. সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফেরানো। এখানে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার বাজার চাহিদার ভিত্তিতে পড়তে দেওয়া এবং রিজার্ভ রক্ষার মধ্যকার একটিকে বেছে নিতে হবে সরকারকে। টাকার মান ধরে রেখে বাজারে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। এখন একদিকে ২৫ বিলিয়ন ডলার খোয়া গেছে, তবুও টাকার মান ধরে রাখা যায়নি। যেহেতু রিজার্ভ দুই মাসের আমদানি বিলের চেয়ে কমে গেছে, তাই বাজারে রিজার্ভ বিক্রি অসম্ভব। এক মাসের আমদানি বিলের সমান বকেয়া এবং মাত্র দুই মাসের আমদানি বিলের সমান রিজার্ভ নিয়ে (বাস্তবে বিলিয়ন ডলারে এক অঙ্কের ঘরে) এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি সরকার। এ অবস্থায় নতুন শক এলে টাকার মান ‘ফ্রি ফল’ করতে দেওয়া এবং মুদ্রা সরবরাহ আরও সংকোচনের বিকল্প থাকবে না। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফেরাতে ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফেরাতে হবে, এজন্য ঋণ জালিয়াতি এবং খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে বড় অপরাধীদের শক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। গ্রাহকদের আমানতের অর্থ ফেরতের একটা দফারফা করে, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মার্জ নয়; বরং সরাসরি বন্ধের কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সরকার ও প্রশাসনের পরিচালনা ব্যয় আক্ষরিক অর্থে রাজস্ব আয়ের অর্ধেকে নামাতে পারবে। সেক্ষেত্রে পরিচালনা ব্যয় দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা লাগবে। অর্থনৈতিক সংকটের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি সমাধান নির্ভর করবে সরকার পরিচালনা ব্যয় কতটা কমাতে পারবে, তার ওপর। তৃতীয় বিষয়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও কৃষি নিরাপত্তা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে দেশের সাত কোটি দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য ভর্তুকি বাড়াতে হবে, কৃষি ভর্তুকি দেড় গুণ বাড়াতে হবে, সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধের ভুল পদক্ষেপ থামাতে হবে, ডিজেলের দাম কমাতে হবে। এসবের জন্য সবার আগে সরকারের ব্যয় বড় সংকোচনের বিকল্প নেই।
সংকট উত্তরণের কথা বলে যে বাজেটটি দেওয়া হয়েছিল গত বছর, সেটি ছিল দেশের ইতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট বাজেট। এটা ছিল অবাস্তব ও গলাভরা কিছু সংখ্যার সমাহার মাত্র, যার সঙ্গে বাস্তবতার দূরতম সম্পর্ক রাখা হয়নি। ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতি ছিল ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। বছরের শুরুতেই প্রাক্কলিত ঘাটতি ৩৫ ছিল, বছর শেষে ঘাটতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থবছরের ১০ মাসে বাজেট বাস্তবায়ন ছিল ৪৯ শতাংশ মাত্র। এরকম অথর্ব বাজেট বাংলাদেশ আগে দেখেনি।
বর্তমান বাজেটের সংখ্যাগুলোর অধিকাংশের ‘এরর মার্জিন ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি’। সরকারি তথ্যকে এরকম হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিতে ভুল বার্তা দেওয়া হচ্ছে এবং পলিসি ডিজাস্টার হচ্ছে একের পর এক। বাংলাদেশকে কী ঠিক করতে হবে, নতুন বাজেট কী একই ধারার লোকরঞ্জনবাদী হবে কি না! নতুন বাজেট কী এরকম ফেব্রিকেটেড হবে, নাকি সরকার তথ্য জালিয়াতিমুক্ত ইকোনমিক মডেলিংনির্ভর প্রাক্কলন করবে?
টানা ২২ মাস উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ পিষ্ট, টানা ২৬ মাস শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্য স্থিতির হারের অর্ধেকের চেয়ে কম। এমন অবস্থায় জ্বালানির দাম বাড়িয়ে, সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে, সার ও ডিজেলের দাম বাড়িয়ে, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার জীবনযাত্রাকে কঠিনতম বাস্তবতার মুখে ঠেলে দিয়েছে। নতুন বাজেট কি এ থেকে স্বস্তি দিতে পারবে, পারলে সেটা কীভাবে? একমাত্র সমাধান পরিচালনা ব্যয় সংকোচন করে অর্ধেকের নিচে নামানো। এবারের অর্থমন্ত্রী প্র্যাকটিসিং ইকোনমিস্ট নন। অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন ঋণখেলাপি ক্লাবের শীর্ষ অভিযুক্ত একজন উপদেষ্টা। তারা কাজটা পারবেন? আইএমএফের চাপে ভর্তুকি বন্ধের গণবিরোধী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, বিপরীতে তাদের মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাব মানা হচ্ছে না। অপখরচ ও বাজে খরচ না থামিয়ে, মানহীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ না থামিয়ে ‘লো হ্যাংগিং ফ্রুট’ হিসেবে পাবলিক ওয়েলফেয়ার স্প্যান্ডিং কমানোতে মানুষের যাপিত জীবনের সর্বত্র ক্ষুধা ও পুষ্টির, সংসার চালানোর কষ্ট ছড়িয়ে গেছে।
সরকারের পরিচালনা ব্যয় মোট রাজস্ব আয়ের দেড় গুণ বা বেশি। রাজস্ব আয় দিয়েও পরিচালনা কুলাচ্ছে না, উল্টো ঋণ করতে হচ্ছে। সমুদয় বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প এডিপি চলছে অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণ দিয়ে। এই তামাশা হীনম্মন্যকর। বাজেট সংশোধন করে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের মতো মৌলিক বরাদ্দ সংকুচিত করা হয়েছে। এরকম উদ্দেশ্যহীন লুটের বাজেট প্রণয়ন বন্ধ হোক!
দুই. প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে প্রায় ৩ শতাংশ কম এবং মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশার চেয়ে অন্তত ৪ শতাংশ বেশি। এটা নির্দেশ করে স্ট্যাগফ্লেশন। এর মানে হচ্ছে, একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে আয় সংকোচন ও বেকারত্ব। এ অবস্থায় টাকার অবমূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক ঋণে সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের, জ্বালানির দাম বাড়ানো হচ্ছে, শুল্ক কমানো, আমদানিতে ভর্তুকি কমানো হচ্ছে। অনেক ভেরিয়েবল একই সঙ্গে মডেলিং ছাড়াই প্রয়োগ হচ্ছে, এতে করে কোন উদ্যোগটি অর্থনীতিতে কী প্রভাব রাখছে—সেটি সরকার জানছে না। সুদের হার ৩ বা ৫ শতাংশ বাড়ালে অর্থনীতির কোন খাতে কী প্রভাব পড়বে, মানি সাপ্লাই ও বিনিয়োগের কোন চ্যানেল কীভাবে রেসপন্স করবে, তা বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইআরডি জানে না, তাদের হাতে মানসম্পন্ন কোনো মডেলিং টুল নেই, যে কারণে আমরা দেখি ঘনঘন নীতির পরিবর্তন।
তিন. আন্তরিকতা থাকলে নতুন বাজেটটি ‘ক্রাইসিস বাজেট’ হওয়ার কথা। রিজার্ভ পতন ঠেকাতে ফিস্কেল কনস্ট্রাকশন দরকার। এতে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়বে। এরকম পরিস্থিতিতে সরকারি ও জনপ্রশাসনের পরিচালনা ব্যয় কমিয়ে সে অর্থ দিয়ে দরিদ্রদের সুরক্ষার জন্য ওয়েলফেয়ার এক্সপেন্ডিং বাড়ানোর পলিসি দরকার। সরকারকে যে কোনো মূল্যে ঘাটতি বাজেট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ঘাটতি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হতে পারে, ৩৫-৫০ শতাংশ হতে পারে না। নতুন মন্ত্রিসভাকে জনপরিসরে স্বস্তি ফেরানোর জন্য ফ্রেশ আইডিয়া নিয়ে আসতে হবে। বিএনপির পিণ্ডি চটকানো ছাড়া বর্তমানে সরকারের কোনো কর্মসূচি নেই। এরকম অকর্মণ্য আওয়ামী লীগ সরকার আমরা আগে দেখিনি। নিম্নবিত্তের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা, ভাতা, টিসিবির বাজেট বাড়ানো, মৌলিক চিকিৎসা ব্যয় কমানোর উদ্যোগ, কৃষিপণ্যের বাজারমূল্য নিশ্চিত, কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পের সুদ মওকুফ, এসএমইর বিকাশে সহজ ঋণ প্রকল্প—এসব কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। বাজেট যাতে এসব নিয়ে ভাবে। অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান কৌশল নিয়ে সরকারের বড় পরিকল্পনা দরকার, বিদেশ যাওয়ার খরচ কমানোর উদ্যোগ দরকার। প্রবাসী শ্রমবাজারের জন্য স্কিল ডেভেলপমেন্ট এবং স্কিল মাইগ্রেশনে বিনিয়োগ না করলে রেমিট্যান্স আয় টেকসই হবে না। ভেতর থেকে ধ্বংস হওয়ার মতো দুটি খাত হচ্ছে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা। সরকার শিক্ষকদের দক্ষ না করে, পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি না করে, শিক্ষা বিনিয়োগ সংকুচিত করে, শিক্ষক ট্রেনিং না দিয়ে একের পর এক নতুন কারিকুলাম চাপিয়ে দিয়ে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মোটিভেশন এবং ক্যারিয়ার ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। একদিকে চাকরির হাহাকার, অন্যদিকে দক্ষ প্রার্থীর দুর্ভিক্ষ। লাখ লাখ আবেদনকারী, কিন্তু যোগ্য প্রার্থীর অভাব। এ অবস্থায় সরকার কীভাবে শিক্ষা ও দক্ষতার নতুন কর্মকৌশল প্রণয়ন করবে, সেটি তাকে এ বাজেটে অ্যাড্রেস করতে হবে।
স্বাস্থ্য খাত আমাদের দারিদ্র্য তৈরির অন্যতম উৎসব, বিগত বছরের স্বাস্থ্য খাতে মানুষের ব্যয় এত বেড়েছে যে, বহু পরিবার যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিল, তারা নিচে নেমে আসছে। তাই আগামী বাজেটে সরকারের মাথাপিছু চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় ফেসিলিটি তৈরির একটি রোডম্যাপ দরকার। সর্বোপরি সরকারকে বেকারত্বের ডাটাবেস বানাতে হবে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর ত্রুটিপূর্ণ বেকারত্বের সংখ্যা দিয়ে দেশের কর্মসংস্থানকে টেকসই করা যাবে না।
লেখক: টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক