গত ২৯ মে ‘দৈনিক কালের কণ্ঠে’ ছোট সংবাদ প্রতিবেদনের দিকে অনেকের চোখ পড়েছে ‘ফেসবুক লাইভে ভোট দেওয়ার ভিডিও ভাইরাল’। পাবনার ঈশ্বরদীতে বুথের মধ্যে মোবাইল ফোনে ফেসবুক লাইভে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট দেওয়ার ভিডিও ভাইরাল করেছেন ঈশ্বরদী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রাকিবুল হাসান রনি। নিজের ফেসবুক আইডির ওই লাইভের পোস্টে তিনি লিখেছেন: ‘অপশক্তিকে রুখে দিন, আনারস মার্কায় ভোট দিন’। লাইভে ভোট দেওয়ার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে সব মহলে সমালোচনার ঝড় বইছে। গত ২৯ মে সকালে ভোট গ্রহণ চলাকালে ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের পুরুষ কেন্দ্র থেকে ফেসবুক লাইভে গিয়ে ইভিএমে ভোট দেন এবং উসকানিমূলক বাক্য লিখে পোস্ট করেন। রাজশাহীর পবা উপজেলা নির্বাচনে সিল মারা ব্যালট নিয়ে বুথের মধ্যেই সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক ফারদিন। তার বাড়ি উপজেলার মাড়িয়া গ্রামে। ২৯ মে সকালে উপজেলার কয়রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়ে এ ঘটনা ঘটান তিনি। ফেসবুক আইডিতে ফারদিনের পোস্ট করা ছবিতে দেখা যায়, ছবিটি বুথের ভেতরে তোলা। ফারদিনের হাতে ব্যালট আছে। এতে আনারস প্রতীকে সিল দেওয়া, তবে ফারদিন বিষয়টি অস্বীকার করে জানান, তিনি কোনো ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেননি।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কী ভেবে দেখেছেন, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার বাঙালি জাতির জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছেন? বাঙালি জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা তাদের সমস্ত সম্পত্তি ট্রাস্টকে দান করে দিয়েছেন। এই মাটিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ছাড়া কেউ কি তাদের পৈতৃক ভিটা জনগণকে দান করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পৈতৃক সম্পত্তি টুঙ্গিপাড়ার বাড়িও ট্রাস্টকে দান করে দিয়েছেন। আমরা যখন বিশ্বব্যাপী ভোগবাদী রাজনীতির প্রাদুর্ভাব দেখি, তখন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার ত্যাগ সত্যি সত্যি অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। আওয়ামী লীগের সারা দেশের নেতাকর্মীরা অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে—এর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া দুষ্কর। ছাত্রলীগের এক কর্মীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এরকম কেন হচ্ছে? তখন তার উত্তর ছিল—এ-জাতীয় যত সংবাদ দেখবেন, সবারই পরিচয় সাবেক ছাত্রলীগার। আমি তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর দিয়েছিলাম, আমিও তো সাবেক ছাত্রলীগার। ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজের হাতে রুটি বেলেছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, সেই ছাত্রলীগের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কিছু নেতাকর্মী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলের ও সরকারের বদনামের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
দুই. ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর ঐতিহাসিক বাড়িটি দেশ-বিদেশের সবাই ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ নামে চেনেন। অনেকে বলেন ‘শেখ সাহেবের বাড়ি’। ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ অথবা ‘শেখ সাহেবের বাড়ি’ নামে পরিচিত হলেও এই বাড়ির প্রকৃত মালিক বেগম ফজিলাতুন নেছা রেণু। বাড়িটির জমি বরাদ্দের আবেদন থেকে শুরু করে বাড়ি নির্মাণের প্রতিটি ধাপ বেগম মুজিব নিজ দায়িত্বে সম্পন্ন করেছেন। তবে জমি বরাদ্দ পাওয়ার পর প্রতিটি পর্যায়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ নিয়েছেন।
১৯৫৬ সালে সরকারের গণপূর্ত বিভাগ থেকে ধানমন্ডি এলাকায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সচিব নুরুজ্জামান নিজ উদ্যোগে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের নামে প্লট বরাদ্দের একটি ফরম নিয়ে আসেন। এরপর বেগম মুজিব নিয়মানুসারে প্লটের জন্য আবেদন করেন এবং ১৯৫৭ সালে ধানমন্ডিতে এক বিঘা জমির একটি প্লট বরাদ্দ পান। প্লটটির দাম ধরা হয়েছিল ৬ হাজার টাকা। এককালীন ২ হাজার টাকা এবং বাকি ৪ হাজার টাকা কিস্তিতে পরিশোধের ব্যবস্থা ছিল। তখনকার দিনে ধানমন্ডি এলাকায় বাড়ি নির্মাণের জন্য জমি কিনতে তেমন কেউ আগ্রহী ছিল না। সন্ধ্যা হলে ওই এলাকায় তখন শিয়ালের ডাক শোনা যেত। ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ নির্মাণকালীন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে মাত্র দুটি বাড়ি ছিল। আশপাশে বাড়িঘর তেমন ছিল না। জমি বরাদ্দ পাওয়ার পর বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব বাড়ি নির্মাণের জন্য হাউস বিল্ডিং করপোরেশন বরাবর ঋণ চেয়ে আবেদন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে বন্দি, সে সময়ে হাউস বিল্ডিং করপোরেশন বেগম মুজিবের ঋণ মঞ্জুর করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে থাকা অবস্থায় বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব তার জমানো টাকা ও হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে প্রাপ্ত ঋণ দিয়ে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে টাকা সংকটের কারণে বাড়ির নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেলে আওয়ামী লীগের নিষ্ঠাবান কর্মী নূরুল ইসলাম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। নূরুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি বর্তমান চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানার তড্ডা গ্রামে। তিনি ঢাকার তাঁতীবাজার এলাকায় থাকতেন। আওয়ামী লীগের প্রচার কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে সবাই তাকে ‘পোস্টার নূরুল ইসলাম’ নামে চিনতেন। বঙ্গবন্ধু তাকে আলফা ইন্স্যুরেন্সে চাকরি দিয়েছিলেন। ১৯৬১ সালের প্রথম দিকে তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হলে বঙ্গবন্ধু তাকে মহাখালী টিবি হাসপাতালে ভর্তি করে দেন এবং চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহন করেন। দীর্ঘ ছয় মাস টিবি হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় নূরুল ইসলাম ‘ক্রস ওয়ার্ড’ লটারিতে ৬ হাজার টাকা পান। এই টাকা তিনি বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন। বাড়ি নির্মাণের সময় টাকার সংকট দেখা দিলে নূরুল ইসলাম তার গচ্ছিত টাকা বাড়ি নির্মাণের কাজে ব্যয় করার প্রস্তাব দেন। বেগম মুজিব তার টাকা বাড়ির নির্মাণকাজে ব্যয় করতে অপারগতা প্রকাশ করলে তিনি বারবার অনুরোধ করেন। অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে নূরুল ইসলামের গচ্ছিত ৬ হাজার টাকা বেগম মুজিব ঋণ হিসেবে নেন। পরবর্তী সময়ে ঋণের ৬ হাজার টাকা যথাসময়ে নূরুল ইসলামকে পরিশোধ করে দেওয়া হয়। ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনের সঙ্গে নূরুল ইসলামের এ সহযোগিতাও চিরস্মরণীয় হয়ে রইল। ১৯৬০ সালের ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিলাভ করেন। মুক্তিলাভের পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় আলফা ইন্স্যুরেন্সের শীর্ষপদ কন্ট্রোল অব এজেন্সিস পদে চাকরিতে যোগ দেন।
জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের কারণে প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় চাকরির আড়ালে তিনি গোপনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। এ সময় তিনি বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে বাড়ি নির্মাণকাজে সহযোগিতা করেন। তখন বঙ্গবন্ধু পরিবারসহ ৭৬ নম্বর সেগুনবাগিচায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বাড়িটির নিচতলার দুটি শয়নকক্ষ, আরও একটি ছোট কক্ষসহ মোট তিনটি কক্ষ নির্মাণ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবার-পরিজন নিয়ে ১ অক্টোবর থেকে ধানমন্ডির বাড়িটিতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয়তলার কাজ শুরু হয়ে ১৯৬৬ সালের প্রথম দিকে শেষ হয়। বঙ্গবন্ধুর পরিবার তখন দ্বিতীয় তলায় উঠে যায়। নিচতলা তখন সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হতে থাকে।
শেখ হাসিনা তার ‘স্মৃতি বড় মধুর, স্মৃতি বড় বেদনার’ লেখায় উল্লেখ করেন—‘দোতলায় ওঠার সিঁড়িগুলো তখনো প্লাস্টার হয়নি। মা খুব ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে এবং হাউস বিল্ডিংয়ের লোনের টাকা দিয়ে বাড়িটি তৈরি করেন। অত্যন্ত কষ্ট করেই মাকে এই বাড়িটি করতে হয়েছে। আব্বা মাঝে মাঝে জেলে চলে যেতেন বলে সব কাজ বন্ধ হয়ে যেত। যে কারণে এ বাড়ি শেষ করতে বহুদিন লেগেছিল।’ শেখ হাসিনা তার প্রবন্ধে আরও উল্লেখ করেন—‘কোনোমতে তিনটি কামরা করে এসে আমরা উঠি। এরপর মা একটা একটা কামরা বাড়াতে থাকেন। এভাবে ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে দোতলা শেষ হয়। আমরা দোতলায় উঠে যাই। ছয় দফা দেওয়ার পর কাজকর্মও বেড়ে যায়। নিচতলা তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই ব্যতিব্যস্ত। নিচে আব্বার শোবার কামরা লাইব্রেরি করা হয়। ড্রেসিং রুমে সাইক্লোস্টাইল মেশিন পাতা হয়। লাইব্রেরির কামরায় টাইপরাইটার মেশিন।’
তিন. দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হয় ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। সেই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৬ জন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ঘূর্ণিঝড়ের আট দিন পর মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক ডাকেন করণীয় নির্ধারণে। এর আগেই তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকায়। শুধু ১৯৯১ সালে নয়, ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময়ও শেখ হাসিনা ছুটে যান মানুষের পাশে।
৭ অক্টোবর ১৯৮৮, চাঁদপুরের বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সীমিত সাধ্য নিয়ে দেশের মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছে। অথচ সরকার মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। ১৯৯৮ সালে বন্যাদুর্গতের জন্য নিজ হাতে রুটি বানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২০ সালে ভয়াল কভিড মহামারিতেও মানুষের জন্য কাজ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ। যে কোনো দুর্যোগে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে সবার আগে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের উপকূলে ঘূর্ণিবাড় আঘাত হানে। ১০ মে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের সামনে স্বীকার করেন, দুর্যোগের আট দিন পরও সরকার সহায়তার প্রয়োজনীয়তা এবং সংগ্রহ ও বিতরণের কৌশলসংবলিত একটি মহাপরিকল্পনা সম্পন্ন করেনি। দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে বারবার প্রশ্নের মুখে তিনি বলেন, মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে একটু সময় লেগেছে।
সরকারের পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকায় পৌঁছে গিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে ত্রাণ সহায়তা দেন তিনি। জনগণকে সময়মতো সহায়তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে পদত্যাগ করার দাবি জানান শেখ হাসিনা। ২০০৭ সালের ‘সিডর’, ২০০৯ সালের ‘আইলা’ এবং ২০২০ সালে কভিডের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’—সব দুর্যোগে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ভূমিকা ছিল অনন্য।
২০০৭ সালে ‘সিডর’ ও বন্যার সময় সেনাসমর্থিত সরকারের সাজানো মামলায় কারাবন্দি হন জননেত্রী শেখ হাসিনা। জেলখানায় বসে তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দেন। বন্দি থাকায় দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে না পারায় তিনি ব্যথিত হওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক