বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-২০২৪ পালনে এ বছর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘Protect Childreen from Tobacco Industry Interfearence’. প্রতিপাদ্যের বাংলা ভাবানুবাদ করা হয়েছে—‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি।’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি যথার্থ এবং অত্যন্ত সময়োপযোগী। কারণ শিশু-কিশোর, তরুণরা ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলোর প্রধান টার্গেট। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ শিশু-কিশোর ও তারুণ্যের দেশ। বর্তমানে ৪৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশকে ‘ইয়ুথ ডিভিডেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ।
কিশোর-তরুণরাই আগামীর বাংলাদেশের রূপকার। এজন্য শৈশব ও কৈশোর পেরিয়ে যৌবন অর্থাৎ তারুণ্যে পদার্পণের সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণও বটে! কারণ অল্প বয়সেই বেশিরভাগ তরুণ ছেলেমেয়ে কৌতূহলবশত কিংবা প্ররোচনায় ধূমপানসহ ভয়াবহ মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে, বিভিন্ন গবেষণায় যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। হয়তোবা তার উপলক্ষ থাকে কোনো একটি বিশেষ দিন অথবা বিশেষ অনুষ্ঠান। হয়তো সে ভাবে আজ শুধু আনন্দ, ফুর্তি করব। কাল থেকে আর ধূমপান/মাদক গ্রহণ করব না, প্রতিজ্ঞা করব। ধূমপান, মাদকের নেশা খুবই ক্ষতিকর, মারাত্মক আসক্তি সৃষ্টি করে। সিগারেট কোম্পানির প্ররোচনা ও কৌতূহলবশত যে শিশু-কিশোররা ধূমপানের জালে জড়িয়ে পড়ছে, তাদের ফেরানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এখান থেকেই তারা ভয়াবহ মাদকের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে। পথভ্রষ্ট হয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে পড়ছে, যদিও তারা অমিত সম্ভাবনাময় নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে। ফলে সমাজে এখন ‘কিশোর গ্যাং’ অপসংস্কৃতির উদ্ভব ঘটছে, যা নিয়ে পুলিশ প্রশাসন এমনকি সরকারপ্রধানের উদ্বেগ যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলছে আমাদের। তাদের নিয়ে আমাদের স্বপ্ন অনেক। তারাই প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের কান্ডারি। জাতীয় অসংখ্য উদ্যোগ, লক্ষ্যমাত্রা এবং সেগুলোর সাফল্যও নির্ভর করছে তাদের ওপর।
শৈশব, কৈশোর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। যে সময়ে তারা নিজেকে গড়তে শেখে, যে সময়ে নিজেকে তৈরি করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সুবর্ণ সময় পার করে। তারুণ্যে অনেক স্বপ্ন এবং আশা থাকে। এটি উৎসাহের সময়, আত্মবিশ্বাসের উন্নতির সময়। যদি তারুণ্যের এ সময়ে সে কোনো ভুল করে বসে বা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারে তবে, তার পুরো জীবনটাই মূল্যহীন, বৃথা হয়ে যায়। তাই এ সময়ে যাতে তরুণরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং ভুল পথে পা না বাড়ায়, সেজন্য একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যেটা করতে পারেন অভিনয়শিল্পী, কলাকুশলীরা। তো তারাই যদি অকারণে, অযাচিতভাবে বিনোদন মাধ্যমগুলোতে সিগারেট, অ্যালকোহল, মাদকের বিজ্ঞাপন চালান তবে আমাদের আগামী প্রজন্ম রসাতলে যাবে। আইডলরা সচেতনভাবেই যদি শিশু-কিশোরদের মগজে ‘নেশার ইনজেকশন’ পুশ করতে থাকেন, তবে ফল আরও ভয়াবহ হতে পারে। তখন নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো সচেতনতা কর্মসূচি চালিয়ে আসা আমাদের মতো লোকদের চেষ্টা বৃথা হয়ে যায়। কেননা, আমি ১০ জনকে তামাকের নেশা ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করছি কিন্তু তারা ১০০ জনকে উৎসাহিত করছে!
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আগামী প্রজন্মের ওপর খুবই আশাবাদী। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে তিনি বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নতি করতে চান। শিশু-কিশোর যারা তারুণ্যে পদার্পণ করছে, এ ট্রানজিশন প্রক্রিয়াটা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারুণ্য জীবনকে মহাজীবনের দিকে পৌঁছে দেয়। তাই তরুণদের প্রতি আমার বার্তা হলো—ভিন্নভাবে চিন্তা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখতে হবে। অর্থাৎ ভালো-মন্দ বিচারের ভার নিজেকেই নিতে হবে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম তরুণদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘ভিন্নভাবে চিন্তা করার ও উদ্ভাবনের সাহস থাকতে হবে, অপরিচিত পথে চলার ও অসম্ভব জিনিস আবিষ্কারের সাহস থাকতে হবে এবং সমস্যাকে জয় করে সফল হতে হবে। এসব মহান গুণের দ্বারা তরুণদের চালিত হতে হবে। নতুন প্রজন্মের প্রতি এই আমার বার্তা।’
সমস্যা থেকে উত্তরণ ও দীর্ঘমেয়াদে পদক্ষেপ হিসেবে তরুণদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। তারুণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধনী পাস করে বাস্তবায়নে জোর দেওয়া প্রয়োজন। তাহলেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের যে সুবিধা পাওয়ার কথা তা বাস্তবে ধরা দেবে। সুতরাং বসে থাকার সময় নেই। তরুণদের রক্ষায় কাজ করতে হবে। মাদক ও তামাকের নেশায় নীল না হয়ে তরুণরা নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাই বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে আগামী প্রজন্মের সুরক্ষায় ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলো সব ধরনের অপকৌশল প্রতিহত করার অঙ্গীকার করি।
লেখক: অধ্যাপক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা (একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র)