রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অবশ্য পাঠ্য বিষয় হলো রাষ্ট্র সৃষ্টির মতবাদ বা তত্ত্ব। পৃথিবীতে রাষ্ট্র নামক একটি সংগঠন, ব্যবস্থাপনা বা কৌশলের শিকড় ও নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানকারীরা বেশ কিছু তত্ত্ব দিয়েছেন, যার অন্যতম ঐশ্বরিক তত্ত্ব বা ডিভাইন থিওরি। এ তত্ত্বের প্রবর্তকরাই সর্বপ্রথম রাষ্ট্র সৃষ্টির ইতিহাস সর্বপ্রথম সামনে নিয়ে আসেন এবং দাবি করেন যে, রাষ্ট্র কোনো মানব সৃষ্ট সংগঠন বা ব্যবস্থাপনা নয়, বরং রাষ্ট্র হলো সৃষ্টিকর্তার সৃজনকৃত একটি ব্যবস্থাপনা। আর শুধু তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান, যারা সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদপুষ্ট বা মনোনীত।
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও মানসম্মান, ক্ষমতা, ঐশ্বর্য প্রভৃতি অর্জন ধরে রাখা কিংবা হারানোর বিষয়টি সম্পূর্ণ সৃষ্টিকর্তার করুণা বা পরীক্ষার কৌশল বলে বর্ণিত আছে। পবিত্র কোরআনের ৩নং সুরা আল ইমরানের ২৬নং আয়াতে বলা হয়েছে—‘বলো, হে আল্লাহ, তুমি সমুদয় রাজ্যের মালিক। যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করো আর যার থেকে ইচ্ছা রাজ্য কেড়ে নাও। আর যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করো আর যাকে ইচ্ছা অপদস্থ করো। তোমারই হাতে সবরকম কল্যাণ, নিশ্চয়ই তুমি সব বস্তুর ওপর ক্ষমতাবান।’ পবিত্র বাইবেলে লেখা আছে, ‘ঈশ্বরকে মনে রাখো, তিনি তোমাদের সম্পদ গড়ার সক্ষমতা দান করেন...’ (সূত্র: বাইবেল গেটওয়ে)। হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ শ্রীমৎ ভগবত গীতার অষ্টম খণ্ডের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪১ থেকে ৫০নং বাণীতে মানুষের কর্মের প্রতি নজর দেওয়ার তাগিদ রয়েছে, ফলাফলের ওপর নয়। এর মধ্যে ৪৭নং বাণীতে ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, ‘... তুমি কখনো কোনো কর্মের ফলাফলের নেপথ্যে তুমিই কারণ অর্থাৎ তোমার কৃতিত্ব বা প্রচেষ্টাকে গণ্য করো না। এমনকি কোনো কর্মফলকে তোমার দায়িত্ব পালন না করার ফলশ্রুতিও মনে করো না ...।’ (সূত্র: ওয়ার্ডপ্রেস ডট কম)। তবে বৌদ্ধ ধর্মমতে, ‘কর্ম ও ফলাফলের মাঝে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক।’ (সূত্র: বৌদ্ধ নেট ডটনেট)।
একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ার নেপথ্যে মানুষের কর্মগুণই মুখ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ইতিহাস তার ব্যতিক্রম সাক্ষ্য দেয়। ফলে প্রায়ই কতজনকে ডিঙিয়ে কবে কাকে কোন বিচারে প্রতিষ্ঠানের প্রধান করা হয়েছে, তা নিয়ে চলে রসালো আলাপ। উদাহরণ হিসেবে জেনারেল মইন উ আহমেদের কথা বলা যায়। অনেকজনকে ডিঙিয়ে তাকে সেনাবাহিনী প্রধান করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া কিন্তু এক-এগারো ও পরবর্তী সময়ে জেনারেল মইন উ আহমেদ ও সেনাবাহিনীর আরও কিছু সিনিয়র অফিসারের হাতে সপরিবারে লাঞ্ছিত হন খালেদা জিয়া। ক্ষমতায় থাকতে কোনো ভুল বুঝতে পারেননি বেগম জিয়া। এক-এগারোর কুশীলব হিসেবে জেনারেল মইন উ আহমেদও নিজের ভুল বুঝতে পারেননি। খালেদা জিয়া গৃহবন্দি আর মইন আমেরিকায় বেশ কষ্টে আছেন বলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই খবর আসে।
জেনারেল মইন উ আহমেদের পর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে সর্বাধিক আলোচিত নাম জেনারেল আজিজ আহমেদ। সম্প্রতি এ জেনারেলকে সপরিবারে আমেরিকা যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সে দেশের সরকার। সেনাবাহিনী চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রায় তিন বছর পর তার ওপর অর্পিত অভিযোগ ও অবরোধ মেনে নেওয়া তার জন্য, সেনাবাহিনীর জন্য এবং জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। তিনি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অর্থাৎ দুটি বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিরল সম্মান ও সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। তবে তার ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূল গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য-উপাত্ত সর্বোপরি মার্কিন অবরোধ প্রমাণ করে যে, তিনি তার প্রাপ্য সম্মানের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি।
একই সময়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে পুলিশ বাহিনীর সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। তিনিও পরম সৌভাগ্যবান পুলিশ অফিসারদের একজন, যিনি একাধারে ডিএমপি, র্যাব ও পুলিশপ্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন। মার্কিন অবরোধ আগেই অর্পিত ছিল তার ওপর। এবার দেশ-বিদেশে স্ত্রী, কন্যা ও নিজ নামে থাকা কল্পনাতীত পরিমাণের জমি, রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় বেশ কিছু ফ্ল্যাট, অগণিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা, ব্যাংকে থাকা টাকা এবং বহুবিধ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিরাট অঙ্কের শেয়ার ক্রয় বা অর্জন করে তিনি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন।
এ বছরের ২৬ মে প্রকাশিত একটি ইংরেজি দৈনিকের তথ্যমতে, ডিএমপি, র্যাব ও পুলিশপ্রধান থাকাকালে স্ত্রী, কন্যা ও নিজ নামে তিনি শত শত বিঘা জমি, বেশ কিছু ফ্ল্যাট ও লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অংশ ও শেয়ার ক্রয় করেন। বেনজীরের দাবি মতে, যদি পারিবারিক কৃষি এবং মৎস্য খাত থেকে অর্জিত লাভের টাকায় এত সম্পদ কেনা সম্ভব হতো, তবে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে শীর্ষ অর্থনীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারত। ক্ষমতায় নেই এমন কৃষক, কৃষি উদ্যোক্তা ও মৎস্য খামারিদের আয় এবং জাতীয় সংসদ ও উপজেলার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কৃষি ও মৎস্য খাত থেকে আয়ের একটি তুলনামূলক চিত্রই বলে দেয় সমস্যাটা আসলে কোন জায়গায়।
প্রায় এক যুগ ধরে ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নাজমুল হাসান পাপন এমপি। এ বছর তার ক্ষমতার মুকুটে যোগ হয়েছে আরেকটি পালক। তিনি এখন দেশের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী। তিনি নিজে মুকুটবিশিষ্ট সম্রাট হলেও ক্রিকেট বা ক্রীড়া জগতের কোথাও তিনি দেশের জন্য সাফল্যের মুকুট এনে দিতে পারেননি।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) দীর্ঘদিনের প্রধান তথা সভাপতির দায়িত্বে আছেন কাজী সালাউদ্দিন। ২০০৩ সালে তিনি প্রথমবারের মতো সহসভাপতি ও ২০০৮ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর থেকে তাকে আর পদ ছাড়তে হয়নি। তবে বাংলাদেশ ফুটবলের কোনো গৌরব গাথার কল্যাণে তিনি যে ১৬ বছর ধরে ফুটবলের কান্ডারির দায়িত্ব পালন করে চলেছেন, তা বলার সুযোগ নেই। বরং এ সময়ে ফেডারেশন অব ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনস (ফিফা) সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বাফুফের ললাটে এঁকে দিয়েছে কলঙ্কের তিলক। গত ২৫ মে সালাউদ্দিনের ডান হাত তথা সিনিয়র সহসভাপতি, বাফুফের অর্থ কমিটির প্রধান এবং বর্তমান মহান সংসদের সংসদ সদস্য সালাম মুর্শিদীর বিরুদ্ধে ফিফার টাকায় ক্রয়সংক্রান্ত অনিয়মের কারণে ১৩ লাখ টাকা জরিমানা ধার্য করেছে ফিফা। গত বছরই ফিফা তহবিলের অপব্যবহার ও ক্রয়সংক্রান্ত অনিয়ম করে সে ব্যাপারে ভুয়া দলিল উপস্থাপনের অভিযোগে বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে দুই বছরের জন্য ফুটবলসংক্রান্ত সব কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অধিকতর তদন্তের পর এ মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়; তারপর ধার্যকৃত জরিমানার পরিমাণ ২৬ লাখ টাকা। একই সঙ্গে বাফুফের সাবেক প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আবু হোসেন ও সাবেক প্রধান পরিচালনা কর্মকর্তা মিজানুর রহমানকে ১০ হাজার সুইচ ফ্রাঁ করে জরিমানা সঙ্গে দুই বছরের জন্য ফুটবলসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা
হয়েছে। বাফুফের প্রধান হিসেবে বড় কোনো ট্রফি দেশে আনতে না পারলেও কলঙ্কের চারটি তিলক তার আমলে আমাদের ফুটবল ও জাতিকে লজ্জা দিয়েছে।
একটি বাহিনী, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের প্রধান হওয়ার সুযোগ পাওয়া নিঃসন্দেহে গৌরবের বিষয়। বিশেষত পুলিশ, সেনাবাহিনী বা সরকারি প্রশাসনে বহুবিধ নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে সমসাময়িক অনেকেই শীর্ষ আসনে প্রায় একই সময়ে বসার যোগ্যতা অর্জন করেন। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রায় সমদক্ষতার সবার মধ্য থেকে একজনের নির্বাচিত হওয়াটি অবশ্যই পরম গৌরব ও বিরল সৌভাগ্যের প্রতীক। কিন্তু লোভ বা অন্য কোনো কারণে এ গৌরব বা সৌভাগ্যকে অবহেলা করা গুরুতর অন্যায়।
শেষ করব দেশের গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক ও বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীর তথ্য জানিয়ে। সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম ও তার স্ত্রী বিরুদ্ধে ৪ কোটি টাকারও বেশি সম্পদ আছে সন্দেহে ২০২৩ সালে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই বছর এই প্রধান প্রকৌশলীর বগুড়ায় থাকা ২৫০ শতক জমি ও প্রায় অর্ধকোটি টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। এ বছর ২৮ এপ্রিল এই প্রধান প্রকৌশলী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে কেনা ১ কোটি ১৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ফ্রিজ করেন আদালত। অন্যদিকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী মো. শামীম আখতার। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকা ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারকে গত ১৫ মে ধাওয়া দিচ্ছেন একদল ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। এরপর গাড়ি নিয়ে দ্রুত অফিস প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে জীবন বাঁচান তিনি। মিন্টো রোডে সরকারি নির্মাণকাজে দুর্নীতিতে ধরা পড়ায় দুজন প্রকৌশলীকে বদলির কারণে তার ওপর আক্রোশ ছিল ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের। এখন তারাই প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারের বিরুদ্ধে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যাচেষ্টা এবং চাকার নিচে ফেলে একজনের পা জখম করার অভিযোগ করেছে। এমন একটি ঘটনা এ দেশে তেমন প্রচার পায়নি বলা চলে। তবে কি দুর্নীতিই এ দেশের স্বাভাবিক ধর্ম, যা খবর হওয়া উচিত নয়?
নোট: লেখা শেষ করার পর দেখলাম পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুলের বিশাল সাম্রাজ্যের খবর এবং তা পড়ে অনেকের মতো আমিও স্তম্ভিত-বাক্যহারা।
লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা। গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
Email: [email protected]