সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৪, ০২:৫৩ এএম
আপডেট : ৩০ মে ২০২৪, ০৭:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আনার তো আনাড়ি ছিলেন না

আনার তো আনাড়ি ছিলেন না

দাগি অপরাধী বা অপরাধের বিস্তর রেকর্ড আছে এমন ব্যক্তিকে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দেওয়া ঠিক কি না, এমন একটা প্রশ্ন এখন বড় করেই দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি কলকাতায় খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের অতীত জীবন সম্পর্কে নানা তথ্য বেরিয়ে এলে এ প্রশ্নটি উঠতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অবশ্য বলেছেন, তার দল অন্য কোনো রেকর্ড দেখেনি, দেখেছে আনারের জনপ্রিয়তা। স্পষ্টতই ওবায়দুল কাদেরের এ উক্তিতে একটা নৈতিক অনুজ্ঞা নিহিত আছে।

জনপ্রিয়তাবাদ নামে এক নতুন বিষয় আমাদের সামনে। জনপ্রিয়তাবাদ জনকল্যাণকেন্দ্রিক, জনমুখী, এবং জনতাই তার শুরু ও শেষ। জনপ্রিয়তাবাদ সমাজের নানা আইনবহির্ভূত কাজকে সহ্য করে না। কিন্তু আনারের জনপ্রিয়তার ধরন একেবারেই আলাদা। তিনি আওয়ামী লীগ করতেন, কিন্তু মাঠপর্যায় থেকে উঠে আসা নেতা নন। আন্ডারগ্রাউন্ড দল করতেন, সীমান্ত চোরাচালান এবং স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গেও সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে এখন গণমাধ্যম বলছে। আনোয়ারুল আজিমকে ধরিয়ে দিতে ২০০৭ সালে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করেছিল বাংলাদেশ পুলিশ। তার বিরুদ্ধে দেশের আদালতেও তখন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। এরপরও তিনি পলাতক থাকায় ২০০৮ সালে চুয়াডাঙ্গার একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছিল।

আনোয়ারুল আজিম গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা জমা দেন, তাতে তিনি নিজের বিরুদ্ধে ২১টি মামলা থাকার কথা উল্লেখ করেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মামলাগুলোর কোনোটিতে খালাস, কোনোটিতে অব্যাহতি পেয়েছেন তিনি। একটি জাতীয় দৈনিক লিখেছে, আবেদ আলী নামে এক বিএনপি নেতা এলাকায় মাদক কারবার করতেন। যে ব্যবসায় আনারকে যুক্ত করেন তিনি। মাদকের মাধ্যমে সীমান্তে চোরাচালানের সূত্র খুঁজে পান আনার। শুরু করেন ভারতীয় শাড়ি ও ভিসিপির অবৈধ চালান দেশে আনা। নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে সীমান্তে এ ব্যবসা পরিচালনা করতেন তিনি। এতে স্বল্প সময়ে অনেক টাকা আসতে থাকে তার হাতে। ১৯৯০ সালের দিকে এলাকার পরিতোষ ঠাকুর নামে এক স্বর্ণ চোরাকারবারির সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এরপর থেকে শুরু করেন স্বর্ণ চোরাচালান। ১৯৯৩ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় তখন তিনি পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে কমিশনার হিসেবে নির্বাচন করেন। ১৯৯৬ সালে যুক্ত হন আওয়ামী লীগে। তাকে সে সময় আওয়ামী লীগে নিয়ে আসেন বর্তমান কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব হোসেন খান। এরপর বিএনপির শেষ সময়ে মামলার কারণে ভারতে চলে যান। ২০০৮ সালে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোল ওয়ারেন্ট জারি করে। ওই বছরের শেষে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন কালীগঞ্জে ফিরে আসেন তিনি। ২০১০ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর ফের শুরু হয় এমপি আনারের রাজত্ব। আস্তে আস্তে নিজের বলয় তৈরি করতে থাকেন। কোণঠাসা করতে থাকেন যাদের হাত ধরে আওয়ামী রাজনীতিতে হাতেখড়ি তাদের; বিশেষ করে যার হাত ধরে এলাকায় ফিরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করেন, তৎকালীন এমপি আবদুল মান্নানকেও আস্তে আস্তে কোণঠাসা করতে শুরু করেন। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হওয়ার পর থেকে কালীগঞ্জে শুরু হয় আনোয়ারুল আজিমের একচ্ছত্র শাসন।

এর অর্থ হলো, আনার কোনো আনাড়ি মানুষ ছিলেন না। সেই তাকেই কি না এমন নির্মম খুনের শিকার হতে হলো আখতারুজ্জামান শাহীনের পরিকল্পনায়, যার সঙ্গে প্রায় ৩০ বছরের বন্ধুত্ব ছিল। খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী হিসেবে চিহ্নিত চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়াও আনারের ঘনিষ্ঠজনই ছিলেন।

আনার মাঝেমধ্যেই কলকাতা যেতেন। আর তাকে সেখানে অনুসরণ করত খুনিরা। বাংলাদেশ এবং কলকাতার গোয়েন্দারা বলছেন, এর আগে দুবার তাকে খুনের পরিকল্পনা করা হয়। তৃতীয়বারের চেষ্টায় সফল হয় খুনিরা। খুনের আগে আনোয়ারুলকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ডেকে নেওয়া হয় কলকাতার সঞ্জিভা গার্ডেনসে। সেখানে তার ওপর চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করা হয় এবং এখন পর্যন্ত লাশের কোনো চিহ্ন মেলেনি।

ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, যশোরসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে একসময় সর্বহারা পার্টির দাপট ছিল। গলাকাটার রাজনীতি নামে পরিচিত এসব দলের সদস্যদের কাছে খুন করা ছিল স্বাভাবিক বিষয়। তথ্য বলছে, ২০০৭ সালের কোনো একসময় আনোয়ারুল আজিম সর্বহারা পার্টি-সংশ্লিষ্ট একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের (হুন্ডি-স্বর্ণ চোরাচালান) আনুমানিক ৪ হাজার কোটি টাকার মালপত্র আত্মসাৎ করেন। এ ঘটনার পর থেকে তিনি ওই চক্রটিকে এড়িয়ে চলতেন এবং স্থানীয় রাজনীতিতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন এবং ২০১৪ সালে এমপি নির্বাচিত হন। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে প্রাণ হারাতে হয় এবং বাকি সদস্যদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান। গত কয়েক বছর ধরেই আজিমের এক বন্ধুর মাধ্যমে চক্রটি পুনরায় যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে এবং পুরোনো ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আবারও আজিমকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। সরকার দলীয় এমপি হওয়ার কারণে আজিমের আত্মবিশ্বাস ছিল প্রচুর এবং সে কারণেই চক্রটির সাজানো ফাঁদের শিকার হন তিনি। ২০০৭ সালে যেসব ব্যক্তি আজিমের স্বর্ণ ও হুন্ডির অর্থ আত্মসাৎ ঘটনায় নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন, মূলত তাদের নিকটজনদের পরিকল্পনাতেই এ হত্যার ঘটনা সংঘটিত করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ফুটে উঠেছে পুরো ঘটনার নৃশংসতায়।

এমপি আনার চালাক-চতুর লোক ছিলেন। সাহসী ও প্রতাপশালী ছিলেন। কিন্তু তাকেও ফাঁদে পড়ে জীবন দিতে হলো। অর্থের বিনিময়ে আনারকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, পাওনা টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেই তাকে ফ্ল্যাটে নেওয়া হয়। আর ব্যবহার করা হয় শিলাস্তি রহমান নামে এক নারীকে; যিনি খুনিদের সঙ্গে ঢাকা থেকেই গিয়েছিলেন। শিলাস্তিকে দিয়ে আনারের আপত্তিকর ছবি তোলা হয়েছিল।

রাজনৈতিক দলে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলে নেতা বানানো, এমপি বানানো নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। একটা লোক এভাবে উড়ে এসে এভাবে জুড়ে বসে গেল! দল জানত যে, কালোবাজারির সঙ্গে এমপি আনারের সম্পৃক্ততা আগে থেকেই ছিল। সীমান্ত অঞ্চলের প্রভাবশালী মহলের সবাই এমন কারবারে জড়িত থাকে বা তাদের জ্ঞাতসারেই এটা হয়। ফলে এটি অস্বাভাবিক কোনো ঘটনাও মনে করে না স্থানীয়রা। কিন্তু তাই এমন একজনকে এত বড় স্তরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক নয়।

রাজনীতিতে এমন ব্যক্তিদের দাপটের কারণেই মধ্যবিত্ত সচ্ছল পরিবারের পিতামাতারা সন্তানদের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণে উৎসাহ দেন না। শিক্ষিত, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের বাদ দিয়ে জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় চিহ্নিত সমাজবিরোধীদের মধ্যে পদ-পদবি আর মনোনয়ন বিলি করায় রাজনীতির গতিপথটাই বদলে গেছে। এ ভয়ংকর রাজনীতির হিংসার শিকার হয় সাধারণ মানুষ, তবে কখনো কখনো নিজেরাও হয়তো হয়ে যান, যেমন করে হয়েছেন এমপি আনার।

এ খুনের পেছনে স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের সম্পৃক্ততার পাশাপাশি ব্যক্তিগত শত্রুতা, টাকাপয়সা লেনদেন ও রাজনৈতিক বিষয় থাকতে পারে। আমাদের নেতা-নেত্রীরা নানারকম কথা বলেন। বলেন যে, অসামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িতদের দলে থাকা চলবে না। কিন্তু দল এখন তাদেরই দখলে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন যে একটা বড় সমস্যা, সেটা স্বীকার করে প্রায় সব দলই, কিন্তু সংশোধিত হয় না কোনো দলই।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২৩ নভেম্বর: ইতিহাসের আজকের এই দিনে

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

আজকের নামাজের সময়সূচি

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

১০

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

১১

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

১২

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১৩

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১৪

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১৫

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৬

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৭

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৮

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৯

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

২০
X