ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৪, ০২:১৬ এএম
আপডেট : ২৯ মে ২০২৪, ০৮:১৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কালো টাকা সাদা করতে অনাগ্রহের কারণ

কালো টাকা সাদা করতে অনাগ্রহের কারণ

আবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। জানা যায়, আসছে বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হচ্ছে। স্বাধীনতার অর্ধশতাধিক বছরে এ পর্যন্ত মোট ২১ বার নানাভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে সুযোগটি মিলেছে ৪০ বছর। সাধারণত দেশের অভ্যন্তরে উপার্জিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেওয়া হয় দেশের বাইরে পাচার করা অর্থ দেশে আনার সুযোগ। কিন্তু এখনো সুযোগটি কেউ নেননি।

বারবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে সমাজ একটি বার্তা দেয় যে, ‘তুমি দুর্নীতি করো, আমি বৈধ করে দেব।’ তাই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দুর্নীতিসহায়ক। বছরের পর বছর এ সুযোগ দিয়েও তেমন সাড়া পায়নি সরকার। অর্থাৎ কালো টাকা সাদা করার সুযোগগুলো কার্যত অকার্যকরই থেকে গেছে। আবার কালো টাকার মালিকদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। তবে কোনো দেশই বাংলাদেশের মতো ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’র ব্যবস্থা করেনি। ওইসব দেশ কয়েকবার স্বল্প সময়ের জন্য সুযোগটি দিয়েছে। তাদের এ নাগরিকরাও সুযোগ লুফে নেন। কারণ, সুযোগ না নিলে শাস্তি প্রদানের হুমকিও দিয়ে রেখেছিল সেসব দেশ। অথচ বাংলাদেশে ঢালাওভাবে এবং প্রায় সবসময় সুযোগ দেওয়া হলেও এর সুফল মেলে না। কালো টাকার মালিকরা মনে করেন, এ সুযোগ ভবিষ্যতে আরও মিলবে, অথবা সাদা না করলেও কিছু আসে যায় না।

দেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে ৫ থেকে ২০ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এর বাইরে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি ক্রয় এবং শেয়ারবাজার ও শিল্প খাতে বিনিয়োগের বিপরীতেও এ সুযোগ মিলেছিল। নৈতিকতার সঙ্গে সমঝোতা করে কালো টাকার সুযোগ দেওয়া হয়। অথচ তেমন কর আদায় হয় না। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ সুযোগ দিয়ে সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় করা হয়। জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত কালো টাকা সাদা হয়েছে মাত্র ৪৭ হাজার কোটি টাকা।

১৯৭৬ সালের এপ্রিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার প্রথমবারের মতো কালো টাকার মালিকদের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেয়। ওই সময়ে একশ টাকার নোট বাতিল করা হয়। এরপর ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান তার সামরিক শাসনামলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেন। পরে একে একে এরশাদ সরকার, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার (১৯৯৬-২০০১), বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার (২০০১-২০০৬), তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-০৮) এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদেই সুযোগটি দেওয়া হয়। শুধু ১৯৯১-৯৬ সালের বিএনপি সরকারের আমলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান প্রথম বাজেট বক্তৃতায় এ ধরনের সুযোগ না দেওয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু পরের মেয়াদে (২০০১-০৬) তিনি কথা রাখতে পারেনি। এনবিআরের সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঘোষণায় এসেছে, মানে সাদা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের ১৫ বছরে মাত্র ৯৫ কোটি টাকা সাদা হয়। আওয়ামী লীগের শেষ তিন মেয়াদে (২০০৯-২৩) প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে।

সাধারণত সাদামাটা ঘোষণায় কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু সুযোগ না নিলে কী শাস্তি দেওয়া হবে, তা বলা হয় না। অবশ্য জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৬ সালে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলা হলেও তেমন সাড়া মেলেনি। এরপর ২০০৬-০৭ সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। প্রকাশ করেছিল সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকা। ওই বছর প্রায় ৩২ হাজার করদাতা ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা সাদা করেন। মূলত ভয়েই তখন প্রচুর মানুষ সুযোগটি নেন। সম্প্রতি খবর প্রকাশ পেয়েছে, ‘দুবাইয়ে গুপ্তধনের পাহাড়’ রয়েছে। আর সেখানে রয়েছে বাংলাদেশিদের প্রায় চারশজনের নাম। যাই হোক, কালো টাকা সাদা করা আর পাচারকৃত টাকা ফেরত আনা অসম্ভব। কারণ কালো টাকা সাদা করার প্রতি আগ্রহ নেই। আর পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার জন্যও নয়।

২০২০-২১ অর্থবছরে এযাবৎকালের এক বছরে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সাদা হয়। সেবার জমি-ফ্ল্যাট কিনে ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কিংবা নগদ টাকা সাদা করেছেন ১১ হাজার ৮৫৯ জন ব্যক্তি। কভিডের কারণে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সীমিত হওয়ায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন বেশি। অতীতের সরকারগুলো কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল। ২০২৩ সালের জুনে বর্তমান সরকার বিদেশে পাচার করা অর্থকে বৈধ করার সুযোগ দেয়। মাত্র ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া হয়।

সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘কেউ সুযোগ গ্রহণ না করলে সরকারের কিছু করার নেই। আমরা এ প্রস্তাবকে বিবেচনায় নিয়ে বাজেট তৈরি করিনি। আমরা বাজেটে এ সুযোগটি রেখেছি।’ অবশ্য তিনি ঠিকই বলেছেন। যেহেতু এ সম্পর্কিত কোনো আইন ও শাস্তির বিধান নেই, তাই কালো টাকা সাদা করার প্রতিও কারও আগ্রহ নেই। বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৫০ বছরে কালো টাকা ও অর্থ পাচারের পরিমাণ ১৪৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে পুঞ্জীভূত কালো টাকার পরিমাণ ১৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি আর বিদেশে অর্থ পাচারের পরিমাণ ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। দুবাই, কানাডাসহ পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে টাকা পাচার করছে কালো টাকার মালিকরা। গড়ে তুলছে বিলাসবহুল বাড়ি আর দামি গাড়ি। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হলেও কোনো সাড়া নেই।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক-বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

দেশে ফিরলেন আমিরাতে ক্ষমা পাওয়া ১৪ বাংলাদেশি

আজকের নামাজের সময়সূচি

শহীদ আমিনুলের সন্তানদের দায়িত্ব নিল ইত্তেফাকুল উলামা

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

১০

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

১১

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

১২

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

১৩

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১৪

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১৫

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১৬

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১৭

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৮

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

১৯

আশুলিয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক সমাবেশ

২০
X