এই লেখা যখন লিখছি, বাংলাদেশ তখন আনুষ্ঠানিকভাবে টি-২০ বিশ্বকাপের বৃত্তে প্রবেশ করেছে। মঙ্গলবার রাতেই ডালাসে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার কথা। মূল বিশ্বকাপ খেলার আগে ১ জুন ভারতের বিপক্ষে আরেকটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ শুধু ভারতের বিপক্ষেই প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে চেয়েছিল, ‘দুর্বল’ যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে খেলে সময় নষ্ট করতে চায়নি। অথচ নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, সেই ‘দুর্বল’ যুক্তরাষ্ট্রই এখন বাংলাদেশের প্রবল প্রতিপক্ষ, রীতিমতো প্রেস্টিজ ইস্যু।
টি-২০ র্যাঙ্কিংয়ে ১৯ নম্বরে থাকা যুক্তরাষ্ট্র কেন হঠাৎ ৯ নম্বরে থাকা বাংলাদেশের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠল, এটা নিশ্চয়ই আপনাদের সবার জানা। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ সর্বশেষ সিরিজ খেলেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে, তাদেরই মাটিতে। শেষ ম্যাচ জিতে কোনোরকমে হোয়াইটওয়াশ এড়িয়েছে। কিন্তু প্রথম দুই ম্যাচের যে পারফরম্যান্স তাতেই সমালোচনার সাইক্লোন শুরু হয়ে গেছে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিচরণ করা বাংলাদেশের এমন নিষ্প্রভ পারফরম্যান্সে বিস্মিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরাও। তবে মোটেই বিস্মিত নই। আমি জানি বাংলাদেশের সামর্থ্যের সীমা এতটুকুই। বাংলাদেশ খারাপ খেলেনি, যুক্তরাষ্ট্র খুব ভালো খেলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজ খেলার আগে দেশের মাটিতে বাংলাদেশ ‘দুর্বল’ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ খেলেছে এবং ৪-১ ম্যাচে জিতেছেও। সেই জয় নিয়ে কোচ-অধিনায়ক তৃপ্তির ঢেকুরও তুলেছেন। যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার আগে তারা প্রস্তুতিতে সন্তুষ্টির কথা বলেছেন। তারা ভুল বলেননি। বাংলাদেশের সামর্থ্যের মাত্রাটা তো তাদের জানা। তবে জিম্বাবুয়ে বা যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজে যা হয়েছে, তাতে আমার প্রবল আপত্তি আছে। আপত্তিটা পরাজয়ে নয়, দলের মানসিকতায়। সে কথায় পরে আসছি।
১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতে প্রথম বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে শক্তিশালী পাকিস্তানকে হারিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দেয় বাংলাদেশ। সেই সাফল্যকে পুঁজি করে পরের বছরই পেয়ে যায় টেস্ট স্ট্যাটাস। তারপর গত সিকি শতাব্দীতে বাংলাদেশ অনেক উত্থান-পতন দেখেছে বাংলাদেশ। দেশের জনগণের কাছে অন্য সব খেলাকে ছাপিয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যায় ক্রিকেট। এই ২৫ বছরে টুকটাক সাফল্য পেলেও বলার মতো কোনো অর্জন নেই বাংলাদেশের। বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন একটা টার্নিং পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছে। মাশরাফী, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ—এ পঞ্চপাণ্ডবের হাত ধরে বাংলাদেশ অনেক সাফল্যও পেয়েছে। পঞ্চপাণ্ডবের যুগ এখন শেষের পথে। মাশরাফী অনেক আগেই খেলা ছেড়েছেন। তামিমও বিদায়ী রেসে আছেন। টি-২০ দলে নেই মুশফিকও। হারিয়ে যেতে যেতে লড়াই করে দলে ফিরেছেন মাহমুদউল্লাহ। পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে আপন মহিমায় টিকে আছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তবে মানতেই হবে রাজনীতি, ব্যবসা, উদ্বোধন, বিজ্ঞাপন, পরিবার মিলিয়ে দারুণ ব্যস্ত সাকিব। ক্রিকেট এখন তার প্রায়োরিটির অনেক পেছনে। তার পারফরম্যান্সও এখন আগের মতো নেই। নাজমুল হোসেন শান্তর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন নতুন যুগে পা রাখতে যাচ্ছে। সেই যুগটা আগের চেয়ে উজ্জ্বল হবে না ম্রিয়মাণ, সেটা জানতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।
দুজন স্ট্যান্ডবাইসহ যে ১৭ জনের টিম নিয়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র গেছে, মানতে হবে এটাই বাংলাদেশের সম্ভাব্য সেরা দল। নির্বাচকদের এখানে কিছু করার নেই। গাজী আশরাফ লিপু নয়, বাংলাদেশের যে কোনো সাধারণ ক্রিকেট অনুরাগীকে দিলেও দলে কোনো উনিশ-বিশ হতো না। সাইফউদ্দিনের বাদ পড়া নিয়ে কিছুটা আলোচনা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, মেহেদী হাসান মিরাজও দলে থাকতে পারতেন। ব্যস এটুকুই। অথচ দেখুন, ভারত বা অস্ট্রেলিয়ার বাদ পড়াদের নিয়ে কোনো দল গড়া হলে তারাও বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়নের লড়াইয়ে থাকতে পারত। বাংলাদেশের সেখানে ১৫ জনের দল গড়াই মুশকিল। ইনজুরির জন্য যার বিশ্বকাপ খেলাই অনিশ্চিত, সেই তাসকিনকে বানাতে হয়েছে সহঅধিনায়ক।
এটা মানতেই হবে, বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্স কখনোই সমান্তরাল নয়। এটা অবশ্য ক্রিকেটারদের দোষ নয়। ক্রিকেট নিয়ে আমাদের আমজনতার আদিখ্যেতা অনেক বেশি। যে কোনো টুর্নামেন্ট বা সিরিজের আগে আগে প্রত্যাশার বেলুন ফুলিয়ে দূর আকাশে উড়তে থাকি। কিন্তু সেই বেলুন যখন ফুটো হয়ে যায়, আমরা যখন বাস্তবতার মাটিতে আছড়ে পড়ি; তখন ব্যথা পাই, হতাশ হই, সমালোচনা করি। প্রত্যাশার বেলুন যত বেশি ওড়ে, হতাশার বেদনাটা তত বেশি হই। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম জিম্বাবুয়েকে আমরা উড়িয়ে দেব। আমরা তো দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজ খেলতেই চাইনি। কিন্তু সেই জিম্বাবুয়ে আর যুক্তরাষ্ট্র যখন আমাদের মাটিতে নামিয়ে আনল, তখন আমাদের হুঁশ হয়েছে। এখন যদি আমরা প্রত্যাশার রাশ টেনে ধরি, তাহলে হয়তো বিশ্বকাপে আমাদের হতাশার মাত্রা কমে আসবে।
আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনুরাগী সমর্থক। শেষ বল পর্যন্ত আশা ছাড়ি না। বাংলাদেশের সামর্থ্যটা জানি বলে, এখন আর আগের মতো মন খারাপ হয় না। অবশ্য জিম্বাবুয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজে বাংলাদেশ যা খেলেছে, আমাদের সামর্থ্য ততটা খারাপ নয়। সমস্যা হলো, একটা বিশ্বকাপের আগে আমাদের ব্যাটসম্যানরা একসঙ্গে ফর্মের খরায় ভুগছেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা অধিনায়কের। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া তো দূরের কথা, নাজমুল হোসেন শান্ত এখন নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। বিশ্বকাপের ১০টি দেশের অধিনায়কদের মধ্যে বাংলাদেশের অধিনায়কের স্ট্রাইকরেট নবম। প্রতীকী হলেও এটাই আসলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বর্তমান চিত্র। বিকল্প নেই বলে, ফর্মহীন লিটন দাসকেও বিশ্বকাপে নিয়ে যেতে হয়েছে। বাংলাদেশে ক্রিকেটের একটা বড় আফসোস সৌম্য সরকারের অধারাবাহিকতা। হাথুরুসিংহের ভালোবাসায় আবার দলে ফিরলেও অধারাবাহিকতার সমস্যা কাটাতে পারেননি। তানজিদ তামিম আর তাওহীদ হৃদয়ই বলা যায় কিছুটা ফর্মে আছেন। কিন্তু তাদের সেই ফর্ম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লড়াই করার মতো নয়। টি-২০তে এখন ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইকরেট ১৬০-এর আশপাশে। কারও কারও তার চেয়েও বেশি। সেখানে আমাদের মূল ব্যাটারদের স্ট্রাইকরেট ১৩০-এর আশপাশে। টি-২০ এখন ফাইটিং স্কোর হলো ১৮০-১৯০, সেখানে আমাদের সামর্থ্য ১৫০-১৬০। পার্থক্যটা এখানেই স্পষ্ট। হুট করে বিশ্বকাপে গিয়ে আমরা ২০০ করে ফেলব, এমনটা যদি কেউ ভেবে থাকেন, তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তার বা তাদের জন্য আগাম সমবেদনা। আমাদের লক্ষ্য দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া। দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে হলে নেপাল ও নেদারল্যান্ডসকে তো হারাতে হবেই; শ্রীলঙ্কা বা দক্ষিণ আফ্রিকার একজনকেও হারাতে হবে। জিম্বাবুয়ে আর যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে যা পারফরম্যান্স, তা বজায় থাকলে নেপাল আর নেদারল্যান্ডসকে হারানোই কঠিন হবে। আমাদের টপ অর্ডার ফর্মে ফিরলেই কিছু হতে পারে। আমাদের শক্তির জায়গা এখন বোলিং। কিন্তু ব্যাটসম্যানরা ১৫০-১৬০ করলে বোলাররা বারবার জেতাতে পারবেন না। আর কে না জানে টি-২০ মূলত ব্যাটারদের লড়াই।
ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটের মধ্যে টি-২০তেই বাংলাদেশের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু টি-২০তে শক্তির ফারাক খুব বেশি থাকে না যেদিন যে দলের সবকিছু ঠিকঠাক মতো হবে, সে দলই জিতবে। এখানে শক্তি বা র্যাঙ্কিং খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের কোনো দিনই কোনো কিছু ঠিকঠাক মতো হয় না। যেখানে আমাদের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি ছিল, সেখানেই আমাদের অর্জন তলানিতে। আমি জানি বাংলাদেশ টি-২০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হবে না। দ্বিতীয় পর্বে যেতে পারলে সেটাই হবে বিশাল অর্জন। আমার আপত্তিটা অন্য জায়গায়। ভারত, অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ড—কোনো দলই সব ম্যাচ জিতবে না। জয়-পরাজয় খেলারই অংশ। কিন্তু আমার মূল আপত্তি মানসিকতায়। একদম শুরুর দিকে আমরা খুব রক্ষণাত্মক ছিলাম। জয় নয়, সম্মানজনক পরাজয়ই হতো আমাদের লক্ষ্য। কোনোরকম টিকে থাকা, মোটামুটি স্কোর করা, বোলারদের দিকে চেয়ে থাকা—এই ছিল আমাদের নিয়তি। আমাদের প্রথম জিততে শিখিয়েছেন মোহাম্মদ আশরাফুল। বাংলাদেশের প্রথম সুপারস্টার আশরাফুলই বাংলাদেশ দলে সাহসের সঞ্চার করেছিলেন। সবচেয়ে কম বয়সে টেস্টে সেঞ্চুরি করা আশরাফুল অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত বা শ্রীলঙ্কার বিশ্বমানের বোলারদের মাটিতে নামিয়ে এনেছেন। মাশরাফীর নেতৃত্বে ২০১৫ বিশ্বকাপে এবং তারপর আমরা সাহসের কিছু ঝলক দেখেছি। কিন্তু এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট থেকে সেই সাহসটাই হারিয়ে গেছে। আমরা আবার সেই সম্মানজনক পরাজয়ের যুগে ফিরে গেছি। জিম্বাবুয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দলের বিপক্ষে টস জিতে বারবার ফিল্ডিং নেওয়াটা দলের সামগ্রিক মানসিকতারই পরিচায়ক। টি-২০ হলো সাহসের খেলা—মারো নয় মরো। কিন্তু আমরা বারবার মরতে মরতে বাঁচতে চাই। কোনো কোনো দিন হয়তো বেঁচেও যাই। জিম্বাবুয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে হারজিত নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। কিন্তু খেলার স্টাইল, রক্ষণাত্মক মানসিকতা নিয়ে প্রবল আপত্তি। এই লেখা যখন পড়বেন, তখন আপনারা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচের ফল জেনে গেছেন। বাংলাদেশ হেরেছে না জিতেছে, তাতে কিচ্ছু যায়-আসে না। বাংলাদেশ কীভাবে খেলেছে, আমি সেটাই শুধু দেখতে চাইব।
আমি চাই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ মারতে নামুক। তাতে কোনো ম্যাচে মারবে, কোনো ম্যাচে মরবে। কিন্তু মরার আগে মনে মনে মরে থাকাটা, খেলার আগেই হেরে বসাটা আমাকে বেশি কষ্ট দেয়।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ