এক নিদারুণ গণহত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। প্রায় পাঁচ লাখ প্রাণের করুণ নির্দয় মৃত্যু ঘটেছে। লাখ লাখ লাশ নিয়ে বসে থাকা স্তব্ধ মৃতদেহের ‘মালিকের’ ছবিও প্রকাশিত হয়েছে। যদিও মানুষ নিহত হলে আমরা হিসাব করি না ‘এত টাকার মানুষ মারা গেল’ কিংবা ‘এত মানুষের মৃত্যুতে এত টাকার ক্ষতি হয়েছে’। কিন্তু সাম্প্রতিক গণহত্যার ক্ষেত্রে ‘মৃতদেহের’ আর্থিক হিসাবও করা হয়েছে। কীভাবে করা হয়েছে তা নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। খবরে প্রকাশ—‘পুলিশ ট্রাক আটকে রাখায় প্রাণ গেল ৫ লাখ টাকার মৌমাছির’।
‘মৃত মৌমাছি নিয়ে হতাশ মৌচাষির’ ছবি প্রকাশ করেছে দৈনিক কালবেলা (সূত্র: ১৮ মে, ২০২৪)। কীভাবে মারা গেল এই পাঁচ লাখ অসহায় মৌমাছি? ঠাকুরগাঁওয়ের মৌচাষি খলিফর রহমান প্রতি বছর বিভিন্ন মৌসুমে তার মৌবাক্সগুলো নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যান। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, হেমন্ত নানা ঋতুতে নানা ফুল ফোটে। গ্রীষ্ম-বর্ষা মৌসুমে তিনি কয়েক বছর ধরে রাজবাড়ী জেলার বসন্তপুর ইউনিয়নের শায়েন্তাপুর গ্রামে আসা-যাওয়া করেন। এবারও গত ১৩ মে দিনাজপুর থেকে ট্রাকে করে রাজবাড়ী আসছিলেন। ট্রাকের ভেতর ২৫১টি মৌবাক্সে ছিল লাখ লাখ মৌমাছি।
রাজবাড়ীর মনসার বটতলায় একটি প্রাইভেট কারের সঙ্গে ট্রাকটির ধাক্কা লাগে (গণমাধ্যম লিখেছে সামান্য ঘষা লাগে)। যাহোক, এরপর প্রাইভেট কারচালক পুলিশকে জানায় এবং পুলিশ এসে ট্রাকের কাগজপত্র ঠিক আছে কি না, তা দেখার জন্য ট্রাকটিকে দাঁড় করিয়ে রাখে প্রচণ্ড গরমের ভেতর। মৌচাষি খলিফার বারবার পুলিশদের বলেছিলেন, মৌবাক্স ও মৌমাছিদের কথা। গরমে মৌমাছিরা মারা যেতে পারে এ আকুতি জানিয়েছিলেন। গণমাধ্যম জানায়, পুলিশ ট্রাক তিন ঘণ্টা আটকে রাখে। স্মরণ রাখা জরুরি, এপ্রিলের তীব্র তাপপ্রবাহের পর এ সময়েও দাবদাহে পুড়ছিল দেশ। তীব্র গরমে ট্রাকের ভেতর দমবন্ধ বাক্সে ছটফট করতে করতে নির্মম মৃত্যু হয় পাঁচ লাখ মৌমাছির। তিন ঘণ্টা পর ছাড়া পেয়ে যখন মৌচাষি খলিফর রহমান রাজবাড়ীর সেই শায়েন্তাপুর গ্রামে পৌঁছেন, তখন সব শেষ। ট্রাক থেকে নামিয়ে বাক্সগুলো খুলে দেখেন মৌবাক্সের সব মৌমাছি মরে পড়ে আছে। এই ক্ষতিগ্রস্ত মৌচাষি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) থেকে মৌচাষের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
মৌমাছিরা মারা যাওয়ায় এবার মধু উৎপাদন ব্যাহত হলো। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, তার প্রায় ৫ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। কেউ এ মৌমাছি গণহত্যার দায়দায়িত্ব নেয়নি কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত মৌমাছির পাশে দাঁড়ায়নি এখনো। বরং রাজবাড়ী সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গণমাধ্যমে জানান, মৌচাষিদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব বিসিকের, তিনি ক্ষতিগ্রস্ত মৌচাষিকে তার নিজ জেলার বিসিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
২০ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হলো ‘বিশ্ব মৌপতঙ্গ দিবস’। ২২ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস। আর আগের সপ্তাহের ভেতর এমন নির্দয় মৌমাছি গণহত্যা ঘটল। এবারের বিশ্ব মৌপতঙ্গ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মৌপতঙ্গ সুরক্ষায় তরুণদের অংশগ্রহণ’ এবং প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের প্রতিপাদ্য ‘প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় পরিকল্পনার অংশ হোন’। গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করার নামে রাজবাড়ীতে মৌমাছিদের এ করুণ মৃত্যু উভয় আন্তর্জাতিক দিবসের মূল সুরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় দেশে বিদ্যমান আইন ও নীতিকে লঙ্ঘন করে। মৌমাছি গণহত্যার ঘটনাটি কোনোভাবেই আড়াল করা বা ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
মৌমাছির মতো জীবন্ত প্রাণদের পরিবহনের সময় আমাদের দায়িত্ব ও সতর্কতা বাড়াতে হবে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিবরণে এ ঘটনায় পুলিশের দায়িত্বহীনতা এবং প্রাণ-প্রজাতির প্রতি অসংবেদনশীল আচরণ প্রকাশিত হয়েছে। একই সঙ্গে দেশজুড়ে যারা মৌচাষ করছেন এবং প্রতিনিয়ত মৌমাছি পরিবহন করছেন, তাদের মৌমাছি পরিবহনে আরও বেশি সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল হতে হবে। পাঁচ লাখ মৌমাছির মৃত্যুর কারণে হয়তো এ ঘটনাটি আমাদের সামনে এসেছে। কিন্তু বিভিন্ন ঋতুতে মৌমাছি পরিবহনের সময় কত কোটি মৌমাছির মৃত্যু ঘটে, তা আমাদের অজানা। এভাবে বাণিজ্যিক মৌচাষকে টিকিয়ে রাখার জন্য যদি প্রতিনিয়ত নানাভাবে মৌমাছিদের মৃত্যু ঘটে, তাহলে আমাদের সতর্ক হওয়া জরুরি—এভাবে উৎপাদিত মধুতে মৌমাছির রক্তের দাগ আছে।
বিশ্বব্যাপী মৌমাছিসহ প্রাকৃতিক পরাগায়নকারীরা জীবনঝুঁকিতে আছে। উধাও হচ্ছে তাদের আবাসস্থল, বিপজ্জনক হয়ে উঠছে তাদের বিচরণ এলাকা এবং ভয়াবহভাবে কমছে খাদ্যউৎস। প্রতিদিন প্রাকৃতিক পরাগায়নকারীরা এ গ্রহের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। মৌমাছি, ভ্রমর, প্রজাপতি, ফড়িংসহ অমেরুদণ্ডী পরাগায়নকারীদের প্রায় ৩৫ ভাগ এবং বাদুড়ের মতো মেরুদণ্ডী পরাগায়নকারীদের প্রায় ১৭ ভাগ পৃথিবীব্যাপী বিপন্ন। এমনকি বিশ্বজুড়ে ফলমূল ও শাকসবজির চাষ কমে গিয়ে ভুট্টা ও আলুর মতো বাণিজ্যিক ফসলের আবাদ বাড়াতে মৌমাছিদের খাদ্যউৎস কমে যাচ্ছে। ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী মৌপতঙ্গ দিবস পালিত হয়। দিবসটি ঘোষণার ক্ষেত্রে স্লোভেনিয়া সরকারের ভূমিকা আছে, কারণ তারা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ দিবসের প্রস্তাব করেন। স্লোভেনিয়ার এক মৌচাষি পরিবারে জন্মগ্রহণকারী অ্যান্টন জানসা, যাকে আধুনিক মৌচাষবিদ্যার পথিকৃত বলা হয়, তার জন্মতারিখ ২০ মে। অ্যান্টনের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাই তার জন্মতারিখটি মৌপতঙ্গ দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়।
এই যে এত মৌমাছি মারা গেল তাতে কি শুধু একজনমাত্র মৌচাষির ক্ষতি হলো? কিংবা দেশে সামগ্রিক মধুর উৎপাদন কিছু কমে গেল? জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা কিংবা জাতীয় অর্থনীতিতে এর কিছু প্রভাব পড়ল? কিন্তু কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ও পরিবেশের ক্ষেত্রে কি প্রভাব হলো? এই হিসাব কে করবে? বিশ্ব প্রাণপ্রকৃতিতে মৌমাছি বা পরাগায়নকারীদের অবদান নতুনভাবে বলার কোনো বিষয় নয়। মৌমাছি ফসলের প্রাকৃতিক পরাগায়ন ঘটায়। এ ছাড়া আমরা খাদ্য পাব না এবং বীজ পাব না। পরাগায়ন রুদ্ধ হলে কৃষি উৎপাদন এবং বৃক্ষপ্রজাতির প্রাকৃতিক বিকাশ বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু পরাগায়ন নয়; মৌমাছি পৃথিবীকে মধু ও মোম উপহার দিয়েছে। আর সেই মৌমাছিকে এভাবে নির্দয়ভাবে কীভাবে মেরে ফেলা সম্ভব? যে মৌমাছিগুলো মারা গেল তাদের মাধ্যমে রাজবাড়ী এলাকায় যে বিপুল পরাগায়ন হতো এবং ফসলের উৎপাদনে ভূমিকা রাখত তা লঙ্ঘিত হলো। এর দায়দায়িত্ব কেন প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ নেবে না?
মৌমাছিসহ পতঙ্গ ও প্রাণপ্রজাতির সঙ্গে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া দরকার এ নিয়ে বহু আলাপ আছে। ১৯৬২ সালে রাচেল কার্সন তার ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বইতে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর কীটনাশকের ভয়াবহ প্রভাবের প্রশ্নকে সামনে আনেন এবং লিওপোল্ড ভূমি-নীতিবিদ্যার মাধ্যমে খাদ্যশৃঙ্খলের সবাই টিকে থাকা ও না থাকাকে সামনে এনেছিলেন। আর এসব বহু তর্কতালাশ আমাদের পরিবেশচিন্তাকে অগ্রসর ও বিকশিত করেছে। আমরা কীভাবে বাঁচব, কী আমাদের খাওয়া দরকার, কীভাবে চাষ ও উৎপাদন হবে কিংবা প্রাণপ্রকৃতির অন্যান্য প্রজাতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য কেমন হওয়া দরকার—এরকম নানা প্রশ্ন নানাভাবে বিশ্বজুড়ে উঠতে থাকে এবং বিকশিত হতে থাকে নানামুখী পরিবেশগত দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মতৎপরতা। পিটার সিঙ্গারের ‘অ্যানিমেল রাইটস (১৯৭৬)’ ও ‘প্র্যাকটিকাল এথিকস (১৯৭৯)’ পুস্তকসমূহ প্রজাতিবাদকে সমালোচনা করে মানুষ ভিন্ন দুনিয়ার অপরাপর প্রাণিকুলের অধিকারকে গুরুত্ব দেয়। মানুষ ও পরিবেশের ভেতর সম্পর্কের ক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধকে নিয়ে আলাপ করে পরিবেশ-নীতিবিদ্যা (এনভায়রনমেন্ট এথিকস)। পাঁচ লাখ মৌমাছি মেরে ফেলা কোন ধরনের নীতিনৈতিকতা? এমনকি প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মূল্যবোধগুলোও প্রাণপ্রজাতির এ ধরনের খুনখারাবির বিরুদ্ধে। তাহলে আমাদের পুলিশ কিংবা মৌচাষিরা কী ধরনের পরিবেশ-নৈতিকতা ধারণ করছেন?
মৌমাছিসহ প্রাণবৈচিত্র্য এবং প্রকৃতি সুরক্ষায় সংবিধান, বৈশ্বিক সনদ ও দেশের আইননীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। সংবিধানের ১৮(ক) ধারায় উল্লেখ আছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ ১৯৯২ (সিবিডি) স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবেও মৌমাছিদের জীবনমান সুরক্ষায় বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। সকল আইন, নীতি, সনদ ও সংবিধানের অঙ্গীকার লঙ্ঘন করে লাখ লাখ মৌমাছির নির্দয় হত্যার কি তাহলে কোনো ন্যায়বিচার হবে না?
২০০৬ সালে জোনাকি পোকাদের সঙ্গে এমন আরেক নির্দয় ঘটনা ঘটেছিল। ঢাকা শহরে উপর্যুপরি বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের জন্য ঢাকা দোকান মালিক সমিতি ঢাকা শহরে জোনাকি পোকা ছেড়ে এক প্রতিবাদ কর্মসূচির কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারা হুমকি দিয়েছিলেন যদি এপ্রিলের ১৫ তারিখের ভেতর বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হয়, তবে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে তারা ঢাকা শহরের রাস্তায় গ্রাম থেকে জোনাকি পোকাদের ধরে এনে ছেড়ে দেবেন। জোনাকি পোকা সংগ্রহে নরসিংদী জেলার শিবপুরের গ্রামে গ্রামে মশারি জালের মাধ্যমে অনেকেই তখন জোনাকি পোকাদের ধরা শুরু করেছিলেন। এই যে আমরা স্যাপিয়েন্স মানুষরা আমাদের কোনো স্বার্থ চরিতার্থ করতে কখনো জোনাকি পোকা, কখনো মৌমাছিদের জীবননাশ করছি—এসব দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি। প্রাণপ্রজাতির ওপর মানুষের আক্রোশ ও নির্দয় ব্যবহার থেকে সরে আসা জরুরি। ১৯২০ সালের ‘দ্য ক্রুয়েলিটি টু অ্যানিমেল অ্যাক্ট’ রহিত করে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ‘প্রাণিকল্যাণ আইন’ তৈরি করে। ওই আইন অনুযায়ী কোনো প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া যাবে না, বিনোদনের জন্য প্রদর্শন করা যাবে না, পরিবহনের সময় অল্প জায়গায় দমবন্ধ অবস্থায় রাখা যাবে না। প্রাণিকল্যাণ আইন অনুযায়ী দীর্ঘ তিন ঘণ্টা মৌমাছিদের কষ্ট দেওয়া অন্যায় এবং একই সঙ্গে মৌচাষি যেভাবে মৌমাছিদের পরিবহন করেছেন তাও কষ্টদায়ক। আশা করি রাষ্ট্র নিহত মৌমাছিদের আহাজারি টের পাবে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্রশস্ত করবে প্রাণসংবেদনশীল অঙ্গীকার।
লেখক: প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যবিষয়ক গবেষক