ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার
প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৪, ০৩:১২ এএম
আপডেট : ২৫ মে ২০২৪, ০৮:০২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সত্য ও ন্যায়ের সাধক নজরুল

সত্য ও ন্যায়ের সাধক নজরুল

মানুষ তার এই প্রিয় আবাসভূমি পৃথিবীকে আদি অনন্ত সময় হাতে নিয়ে কালে কালে সাজিয়েছে। তিলে তিলে গড়ে তুলেছে সভ্যতা। থরে থরে যত্ন নিয়ে নির্মাণ করেছে সভ্যতার নিদর্শন। সুকুমার প্রবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি করেছেন একের পর এক সভ্যতার ইমারত। যুগ যুগ ধরে মানুষ সময় দিয়েছে এ সৃষ্টির পেছনে। কারণ সৃষ্টি করতে শক্তি বেশি খরচ করতে হয় না, কিন্তু শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সময় নিয়ে সাধনা করতে হয়। ধ্বংস করতে সময় খুব কম লাগে। কারণ ধ্বংসে অপরিমেয় শক্তির ব্যবহার হয়। প্রকৃতিগতভাবে সৃষ্টির শক্তির চেয়ে ধ্বংসের শক্তি বেশি। ধ্বংসে যে পরিমাণ শক্তি ব্যয় হয়, তা যদি সৃষ্টিতে কাজে লাগানো যেত তাহলে সভ্যতা অনেক এগিয়ে যেত। তেমনি মানুষের মানব গুণাবলির মধ্যে ভালো-খারাপ গুণের সহাবস্থান থাকে। ভালো মানবিক গুণের দ্বারা মানুষ সৃষ্টি করে, হয় সভ্যতার বিকাশ, মানুষের খারাপ বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে মানুষ ধ্বংসে লিপ্ত হয়, হয় সভ্যতার বিনাশ। সৃষ্টির কোমল শক্তি দিয়ে খারাপ দিকগুলোকে প্রতিহত করা কঠিন। খারাপ দিকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে অনন্ত শক্তির প্রয়োজন। এ শক্তি সবার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয় না। যারা অর্জন করতে পারে তারা নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে, মানবকল্যাণে কাজে লাগাতে পারে নিজেকে। এই খারাপ শক্তিকে পরাজিত করতে খুব কমসংখ্যক লোক ধ্বংসের শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। যারা এ পন্থা অবলম্বন করেছেন তারা সমাজকে, সভ্যতাকে পরিবর্তন করতে পেরেছেন, ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন খারাপের বিরুদ্ধে। এদের শীর্ষ সৃজনশীল পুরুষ হলেন আমাদের নজরুল। যে কি না সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার একজন দূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। সত্য ও ন্যায়ের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন। তিনি সত্য প্রতিষ্ঠায় পরিমাপহীন শক্তি ব্যবহার করেছেন, যা তিনি ধ্বংসের শক্তি থেকে নিয়েছেন। তিনি ধ্বংস করেছেন ভয়ভীতি, শৃঙ্খল, পরাধীনতা, অসত্য, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনাকে। তিনি কোনো অবস্থাতেই সত্য উচ্চারণে পিছপা হননি। কোনো প্রতিকূলতা তাকে আটকে রাখতে পারেনি। কোনো মোহ তাকে ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি সত্য প্রতিষ্ঠায় আপসহীন।

তিনি কোনো ভয়েই ভীত হননি বরং সব ভয়কে জয় করে তিনি বলেছেন—

“আমি দুর্ব্বার,

আমি ভেঙে করি সব চুরমার!

আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,

আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!”

নজরুলের সত্য হলো শক্তিমান, সুন্দর, কল্যাণকর, অবিনাশী, অমর, তিনি তার নিজস্ব বঞ্চনা, বেদনা, অপ্রাপ্তি ও একেবারেই মিথ্যে প্রতিষ্ঠিত অমানবিক অসত্য অকল্যাণকর অমানবিক, অন্যায় প্রচলিত সামাজিক মিথের ওপর প্রতিষ্ঠিত মানবব্যাধির দ্বারা নিজের শিক্ষায় হৃদ্য মানুষ হিসেবে সত্যকে চিনতে শিখেছেন। কাজেই নজরুলের এ সত্য একেবারেই নব আবিষ্কৃত চিরকালের সত্যের প্রকৃত নির্যাস। তিনি বলেছেন, “আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য। আমার যাত্রা শুরুর আগে আমি সালাম জানাচ্ছি—নমস্কার করছি আমার সত্যকে। যে-পথ আমার সত্যের বিরোধী, সে পথ আর কোনো পথই আমার বিপথ নয়। রাজভয়-লোকভয় কোনো ভয়ই আমায় বিপথে নিয়ে যাবে না।”

নজরুল কখনো আশাহত হননি, খুব কাছে থেকে তিনি অন্যায় অবিচারকে দেখেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এ অন্যায় অবিচারের তথাকথিত শক্তিকে পরাজিত করে সত্য এবং ন্যায় ও কল্যাণের ঝান্ডা অবশ্যই ওড়ানো সম্ভব। সব প্রতিকূল অবস্থাতেই নিজের আদর্শে অটল থেকে নিরন্তর সত্য, ন্যায় এবং কল্যাণের পথে নিবেদিতপ্রাণ কাজ করেছেন। যে কাজের গুণ এবং গতি অবশ্যই হাজার মানুষের চেয় ব্যতিক্রমভাবে উন্নত এবং রুচিশীল, মানসম্পন্ন ছিল। যারা অন্যায়কে চোখ বুজে হজম করে, নজরুল তাদের নিজের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস রাখতে বলেছেন বারবার। ধর্মের নামে যারা প্রতারণা করে অন্যের অধিকার হরণ করে তিনি তাদের ঘৃণা করতেন। নজরুল পরাধীন বাংলা বা ভারতের রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার জ্ঞান এবং শক্তি দিয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে এসেছিলেন বারবার। আসলে শুধু পরাধীন ভারতের মানুষের জন্যই নয়, তিনি বিশ্বাস করতেন অন্যায়, অবিচার ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিবেকবান মানুষ মাত্রই প্রতিবাদ করবে এবং অত্যাচারিতের পক্ষে এসে দাঁড়াবে। তিনি দুর্বল প্রতিবাদহীন সামাজিক অবক্ষয় দেখে ব্যথিত হয়েছেন বারবার এবং সবসময়ই মানবতার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার মানবিক গুণকে উচ্চমূল্যে মূল্যায়ন করেছেন। তিনি তাই বলেছেন, “আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলে, শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই; আমি সকল দেশের, সকল মানুষের।”

৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা নজরুলের গান এবং কবিতার শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করেছি। আজকেও দুনিয়ার বিভিন্ন জনপদে মুনাফালোভী অস্ত্র ব্যবসায়ী পুঁজিবাদী শক্তির মদদপুষ্ট দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক-রাষ্ট্র শক্তিগুলো নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছে, বাস্তুচ্যুত করছে, নারী-শিশুসহ অযুত-লক্ষ মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। আমি বিশ্বাস করি নজরুল বেঁচে থাকলে তিনি যত বড় অমানবিক রাজনৈতিক বা রাষ্ট্র শক্তিই হোক, তার বিরুদ্ধে তার অতুলনীয় শক্তিধর লেখনীর মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করতেন, সত্য উচ্চারণ করতেন এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতেন। যে কোনো প্রতিকূল অবস্থায় নজরুলের মেধা এবং আদর্শ তাকে অলৌকিকভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি জোগাত। এ সময়ে আমরা নজরুলের কাছ থেকে কিছু কবিতা এবং গান পেতাম, যা শুধু ফিলিস্তিনি জনগণের জন্যই নয়, পুরো পৃথিবীর মানুষের জন্য কালজয়ী কার্যকরী উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতো।

নজরুলের ন্যায়ের বাণী বা অন্যায়ের প্রতিবাদ শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধেই নয়, এটি ছিল ধর্মের নামে বা সামাজিক কুসংস্কারের নামে ব্যক্তি, সমাজ বা যে কোনো জনগোষ্ঠীর অত্যাচারিত নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের পক্ষে। নজরুল তার মেধা এবং মানবিকতার গুণে অপ্রকাশিত অনুদঘাটিত সত্যকে আবিষ্কারের দুর্দমনীয় শক্তি ধারণ করতেন, যার ফলে তার সত্য উচ্চারণের প্রকাশভঙ্গিকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা সবার পক্ষে সবসময় অর্জন করা সম্ভব হয় না। কিন্তু মনে রাখতে হবে নজরুলের সত্যের বাণী কখনো স্বার্থপরতার নিরিখে নির্ণীত হয়নি, তিনি ছিলেন নির্লোভী, নির্মোহ, আকাশসম উদার মানুষ। তার অন্যায়ের প্রতিবাদের ভাষা বোঝার ক্ষমতাও সবসময় সবার হয়ে উঠত না। তার মনের কষ্টকে তিনি সাহিত্যের ভাষায় প্রকাশ করেছেন, “আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়-দ্রোহী নয়, সত্য-দ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে, কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ, সত্য-স্বরূপ।”

একেবারেই নিষ্পাপ শব্দমালাকে অভিযুক্ত করে নজরুলকে দোষারোপ করা হয়েছে। অথচ নজরুলের এ বাণী শুধু বাংলায় নয়, সারা বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয়, উচ্চমার্গীয়, কঠিন, শক্তিধর, অমূল্য, শব্দমালা হিসেবে মানবজীবনে বিবেচিত হবে—যতদিন রবে এ মানবসভ্যতা। নজরুলের জন্মদিনে এই মহান হৃদয়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক: অধ্যাপক, সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিশ্বসেরা ২ শতাংশ বিজ্ঞানীর তালিকায় বাকৃবির ১০ জন গবেষক

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৪৮ ফিলিস্তিনি নিহত

দীর্ঘ ১ মাস পর কর্ণফুলী পেপার মিলসের উৎপাদন চালু

চবিতে শহীদদের স্মরণে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৯ সেপ্টেম্বর : নামাজের সময়সূচি

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রুরা ওত পেতে আছে

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ গ্রেপ্তার

‘গণহত্যায় উসকানিদাতা কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে’

১০

জাবিতে গণধোলাইয়ের শিকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু ঘিরে রহস্য

১১

বৈদেশিক ঋণ আবার ছাড়িয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার

১২

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা পদক পেলেন নৌবাহিনীর ২শ’ সদস্য

১৩

সিলেট জেলা ও মহানগর যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা

১৪

জাহাঙ্গীরনগরে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে গণপিটুনি, হাসপাতালে মৃত্যু

১৫

ডিপিডিসি কর্মকর্তা-কর্মচারী সমবায় সমিতির নতুন কমিটি

১৬

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হয়ে আলী রীয়াজের ফেসবুক স্ট্যাটাস

১৭

আলজাজিরার অনুসন্ধান / যুক্তরাজ্যে ৩৬০টি বাড়ি কিনেছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী

১৮

রূপপুর পারমাণবিকের প্রথম ইউনিটে ডামি ফুয়েল লোডিং শুরু

১৯

মহেশখালী থেকে অস্ত্রসহ একজনকে আটক করেছে নৌবাহিনী

২০
X