জাকির হোসেন
প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৪, ০২:২৫ এএম
আপডেট : ২৩ মে ২০২৪, ০৮:০৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্বনেতা

বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্বনেতা

আজ ২৩ মে। ১৯৭৩ সালের এই দিনে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা তাকে বিশ্বনেতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। সেই মর্যাদার স্বীকৃতি হিসেবেই তাকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক দেওয়া হয়। এ পুরস্কার ছিল বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও প্রজ্ঞার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান।

বঙ্গবন্ধু সারা জীবন শাসন, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। এ গরিব দুঃখী শোষিত বঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন। মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রেখেছেন। এ অঞ্চলের মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা এবং সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছেন। এ দেশের মুক্তিকামী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মাধ্যমে তিনি শুধু বাঙালির অবিসংবাদিত নেতাই হয়ে ওঠেননি, তিনি এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের শোষিত বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষের নেতা হিসেবে একটি প্রতীকে পরিণত হন। সত্তরের দশকে কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিলিস্তিনির মুক্তিকামী মানুষের নেতা ইয়াসির আরাফাত, চিলির নির্যাতিত মানুষের নেতা সালভাদর আলেন্দে, ভিয়েতনামের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা হো চি মিন, সোভিয়েত রাশিয়ার নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভের সঙ্গে উচ্চারিত হতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণের মাধ্যমে সারা বিশ্বে একটি শান্তিপ্রিয় ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন। সবার প্রতি বন্ধুত্বের ভিত্তিতে বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’

এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি পরিষদের সভায় বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের প্রস্তাব দেন শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র। পৃথিবীর ১৪০টি দেশের ২০০ প্রতিনিধি এ সভায় অংশ নেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধুকে এ পদক দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ২০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ আয়োজিত এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ আমাকে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদান করেছে বলে আমারই দলের থেকে, আওয়ামী লীগের থেকে সংবর্ধনা জানাচ্ছে। সত্য কথা বলতে কি, আমি এর যোগ্য কি না আমি জানি না। তবে এ সম্মান আমার নয়, এ সম্মান লাখ লাখ শহীদ ভাইয়ের, শহীদ বোনদের, নির্যাতিত বোনদের, বাংলার দুঃখী মানুষের, সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণের, আমার মুক্তিযোদ্ধা ও পঙ্গু ভাইদের এবং দেশের সর্বসাধারণ মানুষের। এ সম্মান বাংলার জাগ্রত মানুষের, যারা সংগ্রাম করেছে শান্তির জন্য। শান্তি, শান্তির পথ ও সংগ্রামের পথ। শান্তি আনতে হলেও সংগ্রামের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমরা চাই, আমরা বিশ্বাস করি, শান্তিতে বাস করতে চাই, সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে চাই, পেট ভরে খেতে চাই, শোষণহীন সমাজ গড়তে চাই, দুনিয়া থেকে শোষণ বন্ধ হোক এটাই আমরা বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাস করি। আজ বিশ্ব শান্তির প্রয়োজন। বাংলার মানুষ শান্তিতে অত্যন্ত বিশ্বাস করে। শান্তিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বাংলার নাম আছে। কিন্তু অত্যাচার, অবিচার, জুলুমের বিরুদ্ধেও বাংলার মানুষ দাঁড়াতে জানে। সে প্রমাণও বাংলার ইতিহাসে পাওয়া যায়। যুগ যুগ ধরে আমরা বাঙালিরা পরাধীন ছিলাম। আমরা শোষিত, আমাদের সম্পদ লুট করে নেওয়া হয়েছে। অনাচার, অবিচারে বাংলার মানুষ আজ ওষ্ঠাগত। দুর্ভিক্ষ, মহামারি, চারদিকে হাহাকার। বাংলার সম্পদ লুট করে নিয়েছে শোষকরা। আমরা কাউকে শোষণ করতে চাই নাই, আমরা শোষিত হতে চাই নাই। আমরা শান্তিতে আমাদের সম্পদ ভোগ করতে চেয়েছি। কিন্তু বাংলা, বারবার সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমাদের ওপর আঘাত করেছে।... তাই বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে হবে। যাতে আমরা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। হানাহানি, দাঙ্গা, মারামারি, যুদ্ধ দুনিয়া থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে যাক—এটাই আমরা কামনা করি। জয় বাংলা। বিশ্ব শান্তি জিন্দাবাদ।’

১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবরের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের মে মাসে এশিয়ান পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি কনফারেন্স অনুষ্ঠান উপলক্ষে শান্তি পরিষদ ঢাকায় দুদিনব্যাপী এক সম্মেলনের আয়োজন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্ব শান্তি পরিষদের শাখাগুলোর বহু প্রতিনিধি এ সভায় যোগ দেন। অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদান করেন। এরপর তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’

বঙ্গবন্ধু ছাড়াও এ বিরল সম্মান অর্জন করেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু; কিউবা বিপ্লবের নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো; চিলির প্রথম কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে; ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রামের নেতা, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলওর চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত; দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা এবং দেশটিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা; সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী চিলির কবি, কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা; ব্রিটিশ দার্শনিক, যুক্তিবিদ, গণিতবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজকর্মী, অহিংসাবাদী এবং সমাজ সমালোচক বার্ট্রান্ড রাসেল; গোয়ের্নিকাখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী, কিউবিজম পদ্ধতির স্রষ্টা, ভাস্কর, কবি এবং নাট্যকার পাবলো পিকাসো; তুরস্কের মহান বিপ্লবী, খ্যাতিমান কবি নাজিম হিকমত; বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক ও সুরকার চার্লি চ্যাপলিন; আফ্রিকান-আমেরিকান মানবাধিকারকর্মী মার্টিন লুথার কিংসহ বরেণ্য ব্যক্তিরা।

১৯৫০ সালে প্রথম যাদের এ পুরস্কার দেওয়া হয় তাদের একজন হলেন চেকোস্লোভাকিয়ার সাংবাদিক, সমালোচক ও লেখক জুলিয়াস ফুচিক। তিনি চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং নাৎসিবিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। ১৯৪৩ সালে নাৎসি বাহিনী তাকে বন্দি করে এবং জার্মানিতে নিয়ে যায়। বার্লিনের জেলখানায় কয়েক মাস নির্মম নির্যাতনের পর ওই বছর ৮ সেপ্টেম্বর তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে।

দুই বছর আগে জাতিসংঘ সদর দপ্তর আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বিশ্ববন্ধু’ বা ‘ফ্রেন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ আখ্যা দেন সংস্থাটির সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী। সংগত কারণেই এ উপাধি বৈশ্বিক স্বীকৃতির দাবি রাখে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’ (ফ্রেন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড) হিসেবে জাতিসংঘ কর্তৃক আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্য যথাযথ উদ্যোগ ও কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। আমরা যদি বিশ্ববন্ধুর অফিসিয়াল স্বীকৃতি আদায় করতে পারি, তাহলেই সেটা আমাদের জন্য হতে পারে এক বড় অর্জন।

লেখক: সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজকের নামাজের সময়সূচি

শুক্রবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

ইতিহাসের এই দিনে যত স্মরণীয় ঘটনা

সুনামগঞ্জে নদীতে বালু উত্তোলনে দু’পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ১০

খালাতো বোনের বিয়ে খেতে এলেন ছাত্রলীগ নেতা, অতঃপর...

পাল পাড়া মিনিবার ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত 

সরকারি বাঙলা কলেজে ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির আনন্দ মিছিল

দেশে ফিরে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান ব্যারিস্টার রাজ্জাকের

সারা দেশে জাহাজ ধর্মঘট

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মারা গেছেন

১০

সাতক্ষীরায় ৩১ দফা বাস্তবায়নে বিএনপির আলোচনা সভা

১১

পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের আগুনে পুড়ছে শিশুরা

১২

ক্ষতিগ্রস্ত ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, কোথায় অফিস করবেন আসিফ মাহমুদরা?

১৩

ছোট ভাইয়ের বিয়েতে বর সেজে গেলেন বড় ভাই, অতঃপর...

১৪

সেন্টমার্টিন থেকে ফেরার পথে মাঝ সমুদ্রে জাহাজ বিকল

১৫

বিপিএল উত্তাপে আলোচনায় সাকিব

১৬

‘অপরাধীদের প্রতি কোনো ক্রমেই নমনীয় হবে না পুলিশ’

১৭

অপশক্তির প্ররোচনায় সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড, বাসার নিন্দা ও প্রতিবাদ

১৮

এবার সানা বিমানবন্দরে ইসরায়েলের হামলা

১৯

‘ভারত বাংলাদেশকে একটি নতাজানু দেশ হিসেবে দেখতে চায়’

২০
X