সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৪, ০২:২৫ এএম
আপডেট : ২৩ মে ২০২৪, ০৮:০৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর

ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর কয়েক দিন কেটে গেছে। কিন্তু এই মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন থামেনি। হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ে মৃত্যু হয়েছে ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির-আবদোল্লাহিয়ানসহ নয়জন। মৃতদের মধ্যে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গভর্নরসহ একাধিক শীর্ষ সরকারি আধিকারিক রয়েছেন। গত রোববার পাশের দেশ আজারবাইজানের একটি বাঁধ উদ্বোধনে গিয়েছিলেন রাইসি। সেখান থেকে তেহরানে ফেরার পথে কপ্টারটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।

সোমবার ইরান প্রশাসনের তরফে জানানো হয়, ঘন জঙ্গলে প্রেসিডেন্টের কপ্টারের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। রাইসিসহ কপ্টারের সব যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। পরে রাইসি, বিদেশমন্ত্রী ও অন্য আধিকারিকদের দেহ উদ্ধার করা হয়।

এখন পর্যন্ত এটিকে দুর্ঘটনা বলা হলেও নাশকতা বা ষড়যন্ত্রের কথাও জোরে উচ্চারিত হচ্ছে। মুসলিম জনগোষ্ঠীর অনেকে মনে করেন, দুর্ঘটনা হলেও এর পেছনে ইসরায়েল ও আমেরিকার হাত থাকতে পারে। প্রশ্ন উঠছে প্রাসাদ রাজনীতি নিয়েও। কারণ যে হেলিকপ্টারটিতে তিনি সফর করছিলেন, সেটা নিয়েই জিজ্ঞাসা বেশি। বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বেল ২১২ মডেলের। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের আগে এ হেলিকপ্টারগুলো ইরানে এনেছিল তখনকার শাসক রেজা শাহ পাহলভির সরকার। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো ইরানে এনেছিল ১৯৭৬ সালে।

অতি পুরোনো এবং যন্ত্রাংশ সহজলভ্য না হওয়ায় এ হেলিকপ্টারের রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত জটিল। মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ থাকায় এসব যন্ত্রাংশ আমদানি করাও সহজ হয়নি ইরানের জন্য। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, এই বেল ২১২ হেলিকপ্টারগুলো মূলত পরিষ্কার আবহাওয়ায় চলাচলের উপযুক্ত। তাহলে এমন একটা বৈরী আবহাওয়ায় কেন সফর করানো হলো প্রেসিডেন্টকে? এখানেই প্রাসাদ রাজনীতির আভাস। ৬৩ বছরের রাইসি ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত রাইসিকে সর্বোচ্চ ধর্মগুরুর উত্তরসূরি হিসেবেও তুলে ধরা হচ্ছিল। আটের দশকে তেহরানে বিচারকের দায়িত্ব সামলেছেন রাইসি। সেই সময় কুখ্যাত ‘ডেথ কমিটি’র সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৮৮ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষকে বিচার না করেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। এর জন্য রাইসির নাম হয় ‘তেহরানের কসাই’।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও একের পর এক বিতর্কে জড়িয়েছেন রাইসি। দেশে কড়া শরিয়তি আইন প্রয়োগ, সরকারবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধে দমনপীড়ন শুরু হয়। পুলিশ হেফাজতে তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যুর পর দেশজুড়ে যে আন্দোলন শুরু হয়, তাকেও কড়া হাতে দমন করেছিলেন তিনি। নির্বিচারে খুন করেছেন অসংখ্য মানুষকে। তাই রাইসির হেলিকপ্টার ভাঙার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ইরানে উৎসবের ছবিও দেখা গেছে। বিভিন্ন জায়গায় বাজি ফাটানোর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াতেও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায় ইরানের বাসিন্দাদের একাংশকে। রাইসির মতো চরমপন্থি নেতার মৃত্যুতে খুশি হয়েছেন বলেও খোলাখুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় মতামত জানিয়েছেন অনেকে।

সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না বলে দেশবাসীকে আশ্বাস দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। আপাতত ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সামলাবেন। ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর ৫০ দিনের মধ্যে দেশে নতুন করে নির্বাচন হবে। তার মাধ্যমেই স্থির হবে, ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন।

রাইসির অবর্তমানে ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ইরানের নিজস্ব ক্ষমতা কেন্দ্রেও কোনো অস্থিরতা হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ মৌলিক শাসন কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনির প্রভাব স্পষ্ট। তাই ইসরায়েলের প্রতি ইরানের দৃষ্টিভঙ্গি, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, সিরিয়ায় কৌশলগত অবস্থান ধরে রাখাসহ পারমাণবিক কর্মসূচিতেও কোনো পরিবর্তন আসছে না।

রাইসি ছিলেন কট্টর মৌলবাদী। প্রতিবাদীদের ফাঁসিতে ঝোলানো থেকে শুরু করে মেয়েদের ওপর নীতি-পুলিশের অত্যাচার—সবই ছিল ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির শাসনে। তবুও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানসহ বিশ্বের নেতারা শোক জানিয়েছেন। ব্যতিক্রম আমেরিকা। আমেরিকা কোনো সমবেদনার পথে না হেঁটে সরাসরিই বলল, ‘এই মানুষটির হাতে যে অনেক রক্ত লেগে রয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।’ হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মুখপাত্র জন কার্বি বলছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দিচ্ছিলেন রাইসি। গোটা অঞ্চলকে অস্থির করে রাখার অভিযোগ ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকা ভবিষ্যতেও তুলবে।’

আপাতত একজন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করা এবং ৫০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন হলেও ইরানের জন্য রাইসির মৃত্যৃ বড় সমস্যা তৈরি করেছে। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার স্থলাভিষিক্ত হবেন ইব্রাহিম রাইসি, এমনভাবেই তৈরি করা হচ্ছিল তাকে। এখন নতুন কাউকে বিবেচনায় নিতে হবে। বছরের পর বছর ধরে রাইসিকে নানাভাবে তৈরি করেছিলেন আয়াতুল্লাহ আল খামেনি। এখন বাধ্য হয়েই খামেনি পরিবারের ভেতর থেকে কাউকে এ পদের জন্য ভাবা হচ্ছে। খামেনির পুত্র মুজতবার নামই বেশি বেশি আসছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।

ইরানবিষয়ক বিশ্লেষক তারিম সাদজাদপুর বলছেন, এ নিয়োগ ইরানে অস্থিরতা তৈরি করবে। কারণ তার কোনো জনপ্রিয়তা নেই এবং তিনি সম্পূর্ণ নির্ভর করবেন রেভল্যুশনারি গার্ডের ওপর এবং এর মাধ্যমে দেশটি আবারও সামরিক শাসনের দিকে যেতে পারে। অনেকেই ভেবেছিলেন খামেনি উত্তরাধিকার সিস্টেমে এ পদ নিজ পরিবারের কাউকে দেবেন না। আবার অনেক বিশ্লেষক এটাও বলছেন যে, খামেনি আসলে পরিবারের ভেতরেই এ ধর্মগুরুর পদ রাখতে চান।

মুজতবা একজন মধ্যমমানের ধর্মীয় নেতা যার এই মুহূর্তে কোনো পদপদবি নেই। পর্দার আড়ালেই তিনি সক্রিয়। ২০০৯ সালের সাধারণ মানুষের বিক্ষোভকে নিষ্ঠুরভাবে দমনের পেছনে তার হাত ছিল। আলি রেজা আরেফি নামে আরেকজনের নামও শোনা যাচ্ছে সম্ভাব্য ধর্মগুরু হিসেবে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে খামেনি কবে মারা যান তার ওপর। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর এটি হবে দ্বিতীয়বারের মতো সর্বোচ্চ ধর্মনেতা বদল।

ইরান ইসরায়েলের সঙ্গে পাল্লা দিলেও তার অভ্যন্তরে শাসনব্যবস্থা অতি নিপীড়নধর্মী। চরম দমননীতি এবং গুম-খুনের মাধ্যমে সব প্রতিবাদ থামিয়ে দেওয়া হয় বলে দেশটিতে কোনো সাংগঠনিক প্রতিবাদ সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না। রাইসির স্থলে কেউ একজন আসবেন, তবে খামেনির মৃত্যু হলে ইরানে বড় পরিবর্তন এমনকি সরকার বদলে যেতে পারে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।

ইরান এই সভ্য সমাজে এক বর্বর শাসনব্যবস্থা। ১৯৭৯-তে শাহ পাহলভির স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান ঘটে তাতে সমাজের সর্বস্তরের পুরুষ ও নারীরা অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু শাহের পতনের পর ইসলামী কট্টরপন্থিরা ইরানের ক্ষমতা দখল করে নারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নতুন নতুন সব আইন করে তাদের অধিকার খর্ব করে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রাখা হয়। মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানো, শিক্ষার অধিকার সীমিত করা, বিচারব্যবস্থা ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি আনা হয় হিজাব আইন, ৯ বছরের বেশি বয়সী কন্যার প্রকাশ্যে হিজাব পরিধান হয় বাধ্যতামূলক। প্রয়োজনে কড়া ব্যবস্থা নিতে গঠন করা হয় নীতি পুলিশ যারা ভয়ংকর দানব হিসেবে পরিচিত ইরানের সমাজে।

সংকীর্ণমনস্ক, রক্ষণশীল, অথচ রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে প্রবল রাষ্ট্রশক্তি ইরান। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। তিনি ১৯৮৯ সাল থেকে রাষ্ট্রের প্রধান এবং দেশটির পুলিশ বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব রাখেন। তিনি ইরানের সব থেকে সুসজ্জিত বাহিনী—ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার। এ বাহিনীটি দেশটির জাতীয় নিরাপত্তার জন্য দায়ী থাকে। এ ছাড়া দেশটির স্বেচ্ছাসেবক শাখা, বাসিজ বাহিনীকেও নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন খামেনি। দেশটির পুলিশ বাহিনীকে পরিচালনা করে থাকে ইরানের প্রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণাধীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে এই বাহিনীর কমান্ডার নিয়োগ করে থাকেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা। এতেই বোঝা যায় কতটা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এই বাহিনীকে। ইরান উপসাগরীয় অঞ্চলের এক অতি স্বৈরতান্ত্রিক দেশ যার জনগণ শুধুই নিপীড়িত হয়, মারা যায়। এমন এক দেশ যার নারীরা দুনিয়াতেই এক নরকে বাস করে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশে নজর জিনপিংয়ের

‘উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছে আ.লীগ সরকার’

২৩ নভেম্বর: ইতিহাসের আজকের এই দিনে

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

আজকের নামাজের সময়সূচি

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

১০

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

১১

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

১২

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

১৩

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

১৪

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১৫

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১৬

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১৭

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৮

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৯

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

২০
X