আগের দিনে বর্ষাকাল এলে আকাশ কখনো ঘনকালো মেঘে ছেয়ে যেত। চমকাত বিদ্যুৎ, শোনা যেত বজ্রপাতের বিকট শব্দ। বেশিরভাগ বজ্র তখন আকাশেই মিলিয়ে যেত। কদাচিৎ দুয়েকটা মাটিতে এসে পড়তেই দেখা যেত উঁচু তাল কিংবা সুপারি গাছের মাথায় এসে ঠেকে গেছে। কিন্তু আজকাল বজ্র যেন যমদূতের রূপ ধারণ করে সব মাটিতে এসে ঠেকছে, মেরে ফেলছে মানুষ। গত ২ মে বর্ষার সঙ্গে বজ্রপাতে কক্সবাজারের পেকুয়ায় দুই, রাঙামাটিতে তিন, কুমিল্লায় চার, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় এক এবং সিলেটের কানাইঘাটে একজনের মৃত্যু ঘটে। সূত্রমতে জানা যায়, গত ১০ বছরে দেশে প্রায় তিন হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে এ বজ্রপাতে। আবহাওয়াবিদদের মতে, বর্তমান সময়ে বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ। এ ছাড়া নদী ও জলাভূমি শুকিয়ে যাওয়া, গাছপালা ধ্বংস হওয়ার কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত ঘটায়।
প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বজ্রপাত হতে দেখা গেলেও মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বেশি বজ্রপাত হয়। অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়। ১৯১৬ সালে বজ্রপাতের ঘটনা অনেক বেশি ঘটেছে। ওই বছরের মে মাসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় একই দিনে ৫৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। আর ৬ জুন একদিনেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণ হারিয়েছে ২৫ জন। কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির মানুষই বেশি বজ্রপাতের শিকার হন। এরপরই ১৭ মে বাংলাদেশের জাতীয় দুর্যোগের তালিকায় বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আগে গ্রামগঞ্জে বট, তাল ও নারিকেলগাছের মতো উঁচু গাছপালায় পরিপূর্ণ ছিল। তালগাছের মতো উঁচুগাছ বজ্রপাতকে আকর্ষণ করে কাছে টেনে নিয়ে বজ্রপাত ঠেকিয়ে দিত। ফলে বজ্র মাটির কাছে খুব একটা পৌঁছাত না। তাই বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুও কম ঘটত। এখন উঁচু গাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় বজ্র সরাসরি মাটিতে লোকালয়ে এসে পড়ে এবং মানুষের মৃত্যু ঘটায়। বজ্রপাতের কারণে সাধারণত দুটি উপায়ে মানুষের মৃত্যু হয়। একটি কারণ প্রত্যক্ষ আঘাত, যা মানুষের শরীরের ওপর সরাসরি পড়ে। এ ধরনের ঘটনা কম ঘটে এবং প্রত্যক্ষ কারণে মানুষের মৃত্যুও হয় কম। পরোক্ষ বজ্রাঘাতেই অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এ ক্ষেত্রে যেখানে বজ্রপাত আঘাত হানে সেখানকার পুরো জায়গাটি বিদ্যুতায়িত হয়। ভূমির এ ধরনের বিদ্যুতায়নে বেশিরভাগ মানুষ মারা যায়। বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণার পর ২০১৭ সালে বজ্রপাতে প্রাণহানি হ্রাসে দেশব্যাপী ৬০ লাখ তালগাছ লাগানো হয়। উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে গাছগুলো বেড়ে উঠতে পারেনি। ২০২১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে দেশের আটটি স্থানে বসানো হয় বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা দেওয়ার অত্যাধুনিক যন্ত্র। এ যন্ত্রের সেন্সরগুলোতে ধারণ করা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে বিদ্যুৎ চমকানো এবং বজ্রপাতের মাত্রা জানা সম্ভব। কোন এলাকায় কতক্ষণ ধরে বজ্রপাত হবে বা হয়েছে সে সংক্রান্ত সুস্পষ্ট তথ্য মিলবে। মোবাইলে ওয়েদার অ্যাপের মাধ্যমে যে কেউ সে তথ্য জেনে নিতে পারবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ্রপাতের মেঘের প্রকাশ বেশ জটিল। বজ্রঝড় সাধারণত ৩০ থেকে ৪৫ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। এ সময়ে বাড়ির বাইরে বের না হওয়া শ্রেয়। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রেখে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে সরে থাকতে হবে। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে রাবারের জুতা পরে নিতে হবে। বজ্রপাতের সময় ঘরের বাইরে অবস্থান করলে খোলা মাঠে বা উঁচু স্থানে থাকা যাবে না। একান্তই যদি থাকা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে, তবে পায়ের আঙুলের ওপর ভর করে কানে আঙুল দিয়ে চেপে ধরে নিচু হয়ে বসে পড়তে হবে। আর যত দ্রুত সম্ভব কোনো ভবন বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া নিরাপদ। বজ্রপাতের সম্ভাবনা দেখা দিলে উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি বা তার, সেলফোন টাওয়ার থেকে দূরে চলে যেতে হবে। এমনকি আকাশে ঘন মেঘে বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখলে নদী, পুকুর বা ডোবা এবং যে কোনো জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে। এসব স্থান বজ্রকে বেশি আকর্ষণ করে। বজ্রপাতের সময় গাড়ি বা বাসের ভেতর থাকলে কোনো ধাতব অংশকে শরীরের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা যাবে না। বজ্রপাতের সময় লোহা বা অন্য ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহারও নিরাপদ নয়। একইভাবে বজ্রপাতের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ স্পর্শ করা যাবে না। বজ্রপাতের সময় সেলফোন ও কম্পিউটার ব্যবহার এবং টেলিভিশন দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। ফ্রিজসহ সবরকম বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের সুইচ বন্ধ রাখতে হবে, তা না হলে বজ্রপাতে এসব নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার নামিয়ে আনতে সরকারের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি জোরদারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে দেশের সর্বত্র বেশি করে উঁচু গাছ লাগাতে হবে। উন্মুক্ত স্থানে বসাতে হবে লাইটনিং টাওয়ার বা উঁচু ধাতব পোস্ট। খোলা স্থানে উঁচু টাওয়ারে আরথিং করে নিলে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। তবে এ সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে পারলে মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী