রিকশা বাংলাদেশের একটা আইকনিক বাহন। বিদেশি অনেকে এসে বাংলাদেশের রিকশায় চড়েন। বাংলাদেশের লাখো মানুষের জীবিকার অবলম্বন রিকশা। আর কিছু করার সুযোগ না থাকলে মানুষ গ্যারেজ থেকে একটা রিকশা ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। রিকশা চালাতে লাইসেন্স লাগে না, তাই যে কেউ চাইলেই রিকশা চালাতে পারেন। ঢাকা তো বটেই, দেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে রিকশা। যেহেতু স্থানীয় পর্যায়ে বানানো ও মেরামত করা যায়, তাই এটা অবাধে চলে সর্বত্র। রিকশা একটা খুব রোমান্টিক বাহন। হুডতোলা রিকশায় অনেকেই প্রেম করেন। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে রিকশায় চড়ে ভেজা আমার মতো অনেকেরই খুব প্রিয়। রিকশা নিয়ে অনেক গান লেখা হয়েছে, নাটক-সিনেমা হয়েছে। তবে একজন মানুষ গায়ের জোরে একটা বাহন টেনে নিচ্ছে আর আমরা পেছনে বসে আছি; এটা দেখতে এক ধরনের গ্লানি হয়। বিশেষ করে প্রচণ্ড রোদে রিকশা চালানোটা বেশ অমানবিক। খুব মানবিক অনেকে রিকশায় উঠতেও চান না। কলকাতা গিয়ে আমার স্ত্রী মুক্তি টানা রিকশায় ওঠেননি। কিন্তু পরিশ্রম যতই হোক আর কোনো উপায় নেই বলেই তো তারা রিকশা চালান। যারা মানবতার দোহাই দিয়ে রিকশায় উঠতে চান না, আমি তাদের বলি, আমরা যদি মানবতা দেখিয়ে রিকশায় না উঠি, তাহলে তারা খাবে কী? সেটা তো আরও অমানবিক হবে।
তবে গত কয়েক বছর রিকশা খাতে বৈপ্লবিক এক পরিবর্তন আসে। স্থানীয় প্রযুক্তিতে রিকশায় জুড়ে দেওয়া হয় ব্যাটারিচালিত ইঞ্জিন। আর সেই ইঞ্জিন যুক্ত করার ফলে অবস্থাটা হয়েছে ‘চলে আমার রিকশা হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া’। শুধু রিকশা নয়, এই ইঞ্জিন যুক্ত করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানান নামের, নানান ডিজাইনের তিন চাকার যানবাহন তৈরি করা হয়েছে। কোথাও বলে অটোরিকশা, কোথাও ইজিবাইক, কোথাও টমটম। আমার প্রিয় শহর কুমিল্লায় ইজিবাইকের অত্যাচারে পা ফেলাই মুশকিল। কক্সবাজারে পর্যটকদের প্রিয় বাহন টমটম। এই টমটমে খোলা হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে সমুদ্র দর্শনে যান প্রিয়দর্শিনীরা। মূলত তিন চাকার হলেও কোথাও কোথাও বাড়তি দুটি চাকা যুক্ত করে এ অটোরিকশা বা ইজিবাইক বা টমটমের যাত্রী ধারণক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।
ইজিবাইক বা টমটম তুলনামূলক শক্তপোক্ত হলেও ঢাকার রাস্তায় চলা ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো একেবারে পলকা। স্রেফ রিকশায় ইঞ্জিন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আর কোনো কারিগরি পরিবর্তন আনা হয় না। ঢাকার বাইরে ইজিবাইক বা টমটমে চড়লেও ঢাকায় কখনো ব্যাটারিচালিত রিকশায় চড়িনি। চড়িনি আসলে ভয়ে। পলকা একটা রিকশা যখন ইঞ্জিনের শক্তিতে হাওয়ার বেগে ছুটতে থাকে, আমার ভয় লাগে। মনে হয়, কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লাগলেই বুঝি উড়ে যাবে। ব্যাটারিচালিত রিকশায় দুর্ঘটনা ঘটেও বেশি। তবে বাস্তবতা হলো, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এ ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইক বা টমটম এখন কোটি মানুষের জীবিকার অবলম্বন। রিকশার মালিক, চালক, গ্যারেজ, যন্ত্রাংশ, ব্যাটারি মিলিয়ে বিশাল টাকার লেনদেন হয় এখানে। তাই ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাস্তবতার আলোকে।
কিন্তু গত ১৫ মে বনানীতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ভবনে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভায় সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ দেন। মূলত সড়কে শৃঙ্খলা আনতে এবং দুর্ঘটনা কমাতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মন্ত্রীর নির্দেশের পর কঠোর অবস্থানে যায় বিআরটিএও। এক বিজ্ঞপ্তি বিআরটিএ জানায়, ‘ব্যাটারি অথবা মোটরচালিত রিকশা বা ভ্যান বা অনুরূপ শ্রেণির থ্রি-হুইলার ঢাকা মহানগরে চলাচলের কারণে সড়কে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ব্যাটারি অথবা মোটরচালিত রিকশা বা ভ্যান বা অনুরূপ শ্রেণির থ্রি-হুইলার এবং ফিটনেসের অনুপযোগী, রংচটা, জরাজীর্ণ ও লক্কড়ঝক্কড় মোটরযান চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’ এরপর মাঠে নামে পুলিশ। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করেই ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তে রিকশাচালকরা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করে এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করেই ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং নির্দিষ্ট এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি দিয়েছেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিধিমালা করে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এসেছে। তিনি স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন, তাদের জীবিকার বিষয়টি উপেক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। ব্যাটারিচালিত রিকশা বিধিমালার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ (রেগুলেট) করতে হবে এবং তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। রিকশার জন্য নির্দিষ্ট এলাকা ভাগ করে দিতে হবে। এর মধ্যে চালকরা চালাবেন। এর বাইরে তারা যাবেন না। তবে কোনো অবস্থাতেই মহাসড়ক বা বড় সড়কে যেতে পারবেন না। সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সড়ক বিভাগ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’ মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী জানতেন না। জীবিকার ব্যবস্থা না করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যৌক্তিক মনে করেননি প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশার যন্ত্রের সঙ্গে উপযুক্ত কাঠামো বা মডেল করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
আমাদের সমস্যা হলো, আমরা মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে ওস্তাদ। আপনি গায়ের জোরে প্রযুক্তির অগ্রগতি ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। ব্যাটারিচালিত রিকশার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। রিকশায় ইঞ্জিন যুক্ত করার ফলে রিকশাওয়ালাদের কায়িক পরিশ্রম অনেক কমে গেছে। এখন আর আপনি চাইলেও এ ইঞ্জিন ঠেকাতে পারবেন না। সরকারকে আসলে এদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। নতুন ডিজাইনে আরও শক্ত কাঠামোর রিকশা বানাতে হবে। যাতে বাহনটি চালক এবং যাত্রী সবার জন্যই আরও নিরাপদ হয়। ‘মূর্খ’ ইঞ্জিনিয়াররা যা বানিয়েছে, তার সঙ্গে ‘শিক্ষিত’ ইঞ্জিনিয়ারদের দক্ষতা যুক্ত করে আরও মজবুত রিকশা বানানো সম্ভব। ব্যাটারিচালিত রিকশার মূল সমস্যা এর গতি। তাই রিকশায় কত ক্ষমতার ইঞ্জিন লাগানো যাবে, সেটা নির্ধারণ করলেই গতিও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ, বিদ্যুতের অপচয়। তবে ব্যাটারিচালিত রিকশায় যে শ্রম বাঁচে এবং যে বাড়তি গতি আসে; তাতে লাভক্ষতি বিবেচনা করলে আমার কাছে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে লাভজনকই মনে হয়। বড়লোকেরা এসি চালিয়ে যত বিদ্যুৎ খরচ করে, সারা দেশে রিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে তার চেয়ে কম বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার কথা। নিশ্চিত করতে হবে, ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার জন্য যে বিদ্যুৎ খরচ হয়, তার বিলটা যেন সরকার পায়। শুধু ব্যাটারিচালিত রিকশা নয়, বিদ্যুতের অপচয় আরও অনেক ক্ষেত্রে হয়। অপচয় বা সিস্টেম লস বন্ধ করতে হবে। সরকারের দায়িত্ব হলো, চাহিদা অনুযায়ী সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ সরবরাহে চেষ্টা করা। বিদ্যুৎ অপচয়ের অজুহাতে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সুযোগ নেই।
ঢাকার রাস্তায় ১৮ ধরনের যান চলাচল করে। সেটা শৃঙ্খলায় আনতে হবে। লেন ঠিক করতে হবে। ঢাকার অনেক রাস্তায় রিকশা চলাচলের অনুমতি নেই। সেটা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিভিন্ন গতির যানবাহন যেন একই লেনে চলতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকায় বা গ্রামের রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইক বা টমটম চললেও সড়ক-মহাসড়কে যেন এ যান চলতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। শৃঙ্খলা আনা আর শৃঙ্খলিত করা এক বিষয় নয়, মাথাব্যথার সমাধান কখনো মাথা কেটে ফেলা নয়।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ